আজ থেকে চার বছরেরও বেশী সময় আগে সামুতে একটি লেখা দিয়েছিলাম, “বাঙালির আত্মপ্রতিকৃতিঃ কীর্তিহীন এক জাতিসত্ত্বা ” শিরোনামে। খুব স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছিলাম, আমি বাঙালি ও বাংলাদেশী পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করি। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছিলাম যে, এই জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থেই গর্ব করার মতো কোন অর্জন নেই, নেই কোন সুউচ্চ কীর্তিগাঁথা। প্রাচীন বিশ্ব থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পেরিয়ে রেনেসাঁ, শিল্প বিপ্লব, উপনিবেশকাল মায় এই আধুনিক কালেও সভ্য মানুষের যাপিত জীবনের সকল শাখা-প্রশাখায়, গলি-ঘুঁপচিতে বাঙালি একটি দীনহীন জাতি হিসেবেই করুণভাবে টিকে ছিল এবং আছে – আমরা না চাইলেও এটিই ইতিহাসের অমোঘ সত্য। বাণিজ্য-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-দর্শন-সংস্কৃতি-সাহিত্য-ক্রীড়া-রাজনীতি-মূল্যবোধ, মূল্যায়নের প্রতিটি নিয়ামকের তলানিতে বাঙালির বেদনাদায়ক অবস্থান।
কিন্তু ইতিহাসের একটি হিসাব আমি মেলাতে পারিনি, বার বার হোঁচট খেয়েছি, বিস্মিত- বিহ্বল হয়েছি, হাজার বছরের খেরোখাতায় একটি মাত্র ঘটনার বাঁকে। উনিশ শ’ একাত্তুরে বাঙালির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সুমহান মুক্তিযুদ্ধ !! এই একটি ঘটনায়, মহত্ত্বে, বাঙালি তার সকল অতীতকে ছাপিয়ে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে, এইখানে এসে আমার দৃষ্টি শ্রদ্ধায় অবনত হয়, আমি বাঙালিকে অভিবাদন জানাই, আমাকে অভিবাদন জানাই।
তবে এই কালজয়ী অর্জনে বাঙালি জাতিকে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা শুধু এই যুগে নয়, গোটা মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল ও করুণ। এই ভূ-খণ্ডের সমসাময়িক জনগোষ্ঠীর এক সুবৃহৎ অংশ নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়, যার তুলনা পৃথিবীর সুদীর্ঘ সময়ের ঘটনাপ্রবাহে কদাচিৎ পাওয়া যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ভয়াবহ নৃশংসতায় নিহত হয় ত্রিশ লক্ষ মানব প্রাণ; নারীর সম্ভ্রম নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর তুলনায় যে জনপদের অধিবাসীরা বহুলাংশে বেশী স্পর্শকাতর, সেই জনপদেই সম্ভ্রমহানি করা হয় প্রায় দুই লক্ষ উনত্রিশ হাজার নারীর। আরেকটি ভয়ানক সংযুক্তি হচ্ছে যে, হত্যা এবং ধর্ষণের শিকার মানুষের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক। এমন জঘন্য কর্মকাণ্ডটি সংঘটিত হয় দখলদার পাক বাহিনী, যারা কিনা সশস্ত্র যুদ্ধের কোন সভ্য নিয়ম-কানুনকে মোটেও পরোয়া না করে বন্য পশুর মতো আদিম বর্বরতা দেখিয়েছে, তাদের দ্বারা, আর বাঙালি জাতির একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায়।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের যে একমাত্র অর্জন, মুক্তিযুদ্ধ, তাতে এক মণ দুধে এক ফোঁটা গো-চুনা এই স্বদেশী ঘাতকের দল, যারা সমগ্র সাফল্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, অর্জনকে উপহাসে পরিণত করেছে। যে যুদ্ধের পরিণতিতে এই দেশের ললাটে শোভা পাবার কথা ছিল সাফল্যের দীপ্ত রাজটীকা, পরিবর্তে জুটেছে মানবতার শত্রুদের অভয়স্থল হবার মতো অসভ্য দেশের কলঙ্ক-তিলক। সুদীর্ঘকাল ধরে আমি অপেক্ষায় ছিলাম, এটি দেখতে যে, এই অবিমৃষ্যকারী আত্মবিস্মৃত জাতি কি তার সহস্র বছরের ব্যর্থতার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করবে, না প্রমাণ করতে পারবে যে, একটি বিশ্বমানের কীর্তিকে তারা ধরে রাখার মতো যোগ্য হয়ে উঠেছে শেষতক। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবার সময় থেকেই আমি সন্দিহান ছিলাম, এরা কি পারব, আদৌ ?? মধ্যবর্তী সময়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম সম্পূর্ণভাবেই !! একি, এ কোন জাতি, এ কোন দেশ, এ কোন জনপদ, এ কোন প্রজন্ম ?!! চারশত বছরের পুরানো শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাজপথের চৌমাথায় ‘শাহাবাগ’ নামের এ কোন অগ্নিগর্ভ সাহসী জাতিসত্ত্বা ? আমার চেনা-জানার, পড়া-শোনার, গবেষণার, ইতিহাসের দীনহীন বাঙালি জাতির সাথে কোনভাবেই আমি মেলাতে পারছি না। আমি নিশ্চিত দেখছি বেঁচে থেকে, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, জার্মান কিংবা জাপানী অথবা হালের চীনা জাতি না, এটি আমার পিতৃপুরুষের সেই বাঙালি জাতি ! যাঁদের ইতিহাস বিষয়ে একটু নির্মোহ আগ্রহ আছে, তাঁরা হয়ত আমার বিস্ময়ের কারণ ও মাত্রাটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছেন। যাই হোক, আমি যৌক্তিক মানুষের মতো নিজের এতদিনের পর্যবেক্ষণকে ভুল বলে স্বীকার করবার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম;- কিছু পরাজয়ও বুঝিবা চোখ ভিজিয়ে দেবার মতো মধুরতর হয়, আহা !
কিন্তু, হায়রে, এ কি মধু দত্তের প্রহসন ?
সোমবার, ৩১ আষাঢ়, ১৪২০ বঙ্গাব্দ, ৫ রমযান, ১৪৩৪ হিজরী, ১৫ জুলাই, ২০১৩ সন – আমি বাঙালি জাতির মুখে, আপনার মুখে একদলা থু থু দিয়ে গেলাম, -- থুঃ।
(জন্মসূত্রে, জাতিসূত্রে, মাতৃ ও পিতৃসূত্রে আমিও একজন নিখাদ বাঙালি)
[পরিশিষ্টঃ যে পশুটি নিজের মাকে ধর্ষণ করে জন্মের সময় আঁতুর ঘরে গলা টিপে এই দেশটিকে খুন করতে চেয়েছে, বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় সেই দানবকে আরও দীর্ঘকাল এই দেশের আলো-হাওয়ায় বেঁচে থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আয়েশী জীবনের ব্যবস্থা করে দিতে পেরে সকলে ধন্য ও পুলকিত বোধ করছে ! হে বাঙালি জাতি, গোলাম আযম কি তার নব্বই বছরের মানব(!)জন্মে একবারের জন্যও বলেছে যে, একাত্তুরে সে যা করেছে তা অন্যায়, তা মহাপাপ ? সে কি একবারের জন্যও বলেছে, ‘আমি অপরাধ করেছি, মাতৃসম দেশের সাথে বেঈমানী করেছি, কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আমি অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি, আমাকে আপনারা মাফ করে দিন, দয়া করুন’ ... বলেছে কখনও ... নাকি এই নরঘাতক পিশাচটি তার কৃত কর্মকাণ্ডের জন্য গর্ব করে দম্ভভরে লাখো শহীদ, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করে গেছে ক্রমাগত ?? হে বাঙালি জাতি, যে তোমাদের কাছে একটি বারের জন্যও কখনই ক্ষমা চায়নি, বরং অপরাধ করে উদ্ধত থেকেছে, কোন্ সুমহান মানবিক বিবেচনায় তোমরা এই নরপশুকে তথাকথিত এই উদারতা দেখাতে পারলে ? তা কি মার্কিন দূতের নিমন্ত্রণের আড়ালে নির্বাচনী বৈতরণীর সরকারী আঁতাতের পাশা খেলায় ? নাকি বিরোধী দলের ভুবনমোহিনী সন্ন্যাসী মৌনব্রতের জাদুমন্ত্রে ? এই দুর্ভাগা দেশে জাতির জনকও স্বাভাবিক মৃত্যুর সুযোগটি পাননি, জগৎশ্রেষ্ঠ বাঙালি তাজুদ্দিনের মতো মহৎ পুরুষের মৃত্যু হয়েছে ঘাতকের আঘাতে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা বীরউত্তম জিয়াকে মরতে হয়েছে বেঘোরে, আর এই সময়ের শ্রেষ্ঠ ইবলিস গোলাম আযম পেয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি ক্লজ !! কি বিচিত্র এই মানব, দুঃখিত, বাঙালি জন্ম ! সব পরিচিত মুখগুলো, চেনা বুদ্ধিজীবিরা, এমনকি এতদিনের পরিচিত সামু্র ব্লগাররাও যেন সব কিছু মেনে নিয়েছেন, কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব সবার ভেতর !? কিন্তু কারো কি কিছুই বলার নেই, কেউ কি আসবে না বুকের আগুনটুকু বাইরে জ্বালিয়ে দিতে, কেউ কি নেই একটি গগনবিদারী চিৎকার দেবার ... “আয় তোরা ... ”]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৯:৪০