গ্রীন রোড ধরে আসছি, বাসে। হঠাৎ চোখে পড়লো একটি জমকালো দালানের সামনে গাছের একটা ঝোপ। ঝোপের ভেতরে আলোক সজ্জা করে একটি মনোরম দৃশ্য তৈরী করা হয়েছে। আর একটু আগাতেই দেখলাম একটি দেয়ালে লম্বা সারি দিয়ে দৈনিক পত্রিকা আঠা দিয়ে লাগানো। কতগুলো লুঙ্গি পড়া লোক অধির আগ্রহে ল্যাম্প পোষ্টের মৃদু আলোয় সকালের বাসি পত্রিকা পড়ছে। বাসায় এলাম রাত ১০ টা নাগাদ। ক্লান্তিতে শরীরটা প্রচন্ড ব্যাথা করছিলো। অনেক ক্ষুধার্ত থাকার সত্ত্বেও শরীর চাইছিলো না যে রান্না করে চারটে খেতে। ভাবলাম একটু জিরিয়ে নেই। হাত মুখে এক ঝাপ্টা জল দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম একটু বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ করে ল্যান্ড ফোনের আওয়াজে হকচকিয়ে উঠলাম। ফোনটা পিক করতেই মিষ্টি একটা কন্ঠে মনটা ভরে গেল।
-হ্যালো!
-স্যার, ওসমান বলে এক ভদ্র লোক আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
-কোথা থেকে এসেছেন? কি দরকার?
(জিজ্ঞাসাবাদের পরে)
-স্যার উনি ফার্মগেট থেকে এসেছেন। বলছেন আপনার সাথে জরুরী দরকার। বলছেন একান্ত ব্যাক্তিগত।
-OK. পাঠিয়ে দিন।
-OK স্যার।
লোকটা সামনে জুবুসুবু হয়ে বসা, এসি অনেক বাড়ানো থাকা স্বত্তেও দরদর করে ঘামছেন। জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকাতেই মনে হলো মনের ভেতরে অনেক কথা, অনেক কষ্ট। পান খাওয়া দাতে একটা কৃত্তিম হাসি কেটে ভয়ার্ত চোখ নিয়ে লোকটি বসে আছে। জামা কাপড় দেখে মনে হলো, রিসিপসনের মেয়েটাকে চাকরি থেকে আজই তাড়াতে হবে। ভদ্র অভদ্রের পার্থক্য বোঝে না। লোকটির গায়ের বিদঘুটে ঘামের গন্ধে ইচ্ছে করছে রুম থেকে বের করে দিতে। কিন্তু কেমন যেন একটা মায়া লোকটার চোখে।
-কি চাই?
-স্যার, আপনে মা বাপ। বাচান!
(হঠাৎ করে হকচকিয়ে গেলাম!)
-খুলে বলুন।
-ফুটপাথে থাহি। বউ বাসায় বাসায় কাম করে। আমি যহন যা পাই তাই করি। কয়দিন আগে পোলা দুইডায় বায়না ধরসে একটা মোবাইল কিন্না দিতে হইবো। অনেক কষ্টে ৫০০ টাকা দিয়া একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল কিন্না দিলাম। পরের দিন বড় পোলাডারে কে যেন মাইরা মোবাইলডা লইয়া গেসে। মোবাইলের লাইগা দুঃখ নাই স্যার। পোলাডারে এমন মাইর মারসে...
(বলতে বলতে ডুকরে কেদে উঠলো লোকটা।)
-ইট দিয়া ছেইচ্চা পাওডা থ্যাতলাইয়া ফালাইসে। মেডিকেলে ভর্তি করাইসি। ডাক্তার কইসে তিন দিনের মইধ্যে অপারেশন না করাইতে পারলে ডাইন পা ডা কাইট্টা ফালাইতে হইবো। স্যার আমার কিছুই নাই। কিডনী দুইডা আসে। বেচতে গেসিলাম। পুলিশে ধরাইয়া দিসে। কয় আমি নাহি ন্যাশা করি। কইসে আর যদি এই কাম করতে যাই তাইলে নাহি সারা জীবন জেলে পইচ্যা মইরতে হবি। স্যার, উপায় না পাইয়া ভিক্ষা করতে বইলাম বউ আর ছোড পোলাডারে লইয়া। যেই টাহা পাইলাম সারা দিন ভিক্ষা কইরা, সেই টাহা দিয়া এক বেলার খাওনো জুটবো না। উপায় না পাইয়া অপিসে অপিসে ঘুরতে লাগলাম যদি কিছু পাওয়া যায়...
কথা গুলো শুনতে শুনতে অন্যমনষ্ক হয়ে বাইরে তাকালাম। সামনের ঝোপের ভেতরের কৃত্তিম আলোকসজ্জায় চোখ ধাদিয়ে গেল। হঠাৎ চোখের সামনে সব যেন ঝাপসা হয়ে উঠতে শুরু করলো। কানের কাছে মোবাইলের এলার্ম! হকচকিয়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে চিন্তা করতে লাগলাম এ কি হল এতক্ষণ! এত কুৎসিত একটা স্বপ্ন কেন দেখলাম! চোখের সামনে ভাসতে লাগলো ছেলেটার পা। স্বপ্নে ছেলেটার বাবার মুখে যেমন বর্ননা শুনেছিলাম। মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। ভাবতে লাগলাম মানুষের জীবনের কত রকম রঙ!
আজ মনে মনে ছুটি ঘোষনা করলাম। ভাবলাম সারাটা দিন আজ নিজের সঙ্গে কাটাবো। মোবাইলে ফুল চার্জ আছে। একা একা ঘুরবো ভেবে একবার মোবাইলটা সঙ্গে না নেবারই চিন্তা করলাম। একটু পরেই আবার ভাবলাম একা একা ঘোরার সময় গান শোনা যেতে পারে। তাই ফোনটা দরকার। মোবাইলের সিমটা খুলে রেখে দিলাম টেবিলের উপর। কালকের কয়েকটা বাঁশি পাওরুটি ছিল। একটা ডিম ভেজে কোন মতে খেয়ে হেডফোনটা কানে নিয়ে বের হলাম ঘুরতে। বের হবার পর আর একটা বিচিত্র সিদ্ধান্ত নিলাম যে আজ সারা দিন যেখানেই যাব পায় হেটে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। হাটতে শুরু করলাম। উদ্দশ্য মিরপুর।
নিজের সাথে কথা বলতে বলতে প্রথমেই মনে হল একটা ভালো চাকরি দরকার। গত ৮ মাস যাবত এই একটি যন্ত্রনা আমার মাথা থেকে বের হচ্ছে না। এর পিছনে অনেক গুলো কারন আছে। প্রথম কারন হচ্ছে অনেক কষ্ট করে বাবা একটা বাড়ি করেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের কথা ভেবে, বাবা এত টুকু একটা চাকরি করে যে সাহস নিয়ে এই বাড়িটা করেছে তার থেকে মনে হয় মানুষ খুন করতে কম সাহস লাগে। দ্বিতীয় কারনটি হচ্ছে আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। মেয়েটা অনার্স চচুর্থ বর্ষের ছাত্রী। এই বয়স হল মেয়েদের বিয়ের আদর্শ বয়স। এ যুগে মেয়ের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর প্রথম শর্ত হল চাকরি। সার্টিফিকেট ছাড়া যেমন শিক্ষিত লোকের দাম নেই তেমন চাকরি ছাড়া মেয়ের বাড়িতে ছেলেরও দাম নেই। চাকরির ব্যাপারটা খুব বেশি করে মাথায় ঢোকে বাবার স্ট্রোকের পরে। চিন্তা মানুষকে সুস্থ থাকতে দেয় না। নিজের ভিতর থেকে কেমন যেন দায়িত্বের চাপ অনুভব করলাম। ছোট থাকতে অনেক বেশি ভালো ছিলাম। অন্তঃত মাথার উপরে এত দায়িত্ব ছিল না।
নিজের সাথে কথা বলতে বলতে কখন মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে চলে আসলাম বলতে পারবো না। সিদ্ধান্ত নিলাম আজ দুপুর পর্যন্ত এখানেই সময়টা কাটাবো। টিকিটের দাম দিলাম। আচমকা দেখলাম টকেটের বদলে একটা পুরোনো খবরের কাগজ ধরিয়ে দিলো। কাউন্টারের লোকটিকে লক্ষ্য করলাম। লম্বা চওড়া ধরবনের মুখে লম্বা দাড়ি। বয়স ৪৫ বছরের কিছু বেশি হবে হয়তো। লোকটিকে দেখে মনে হলো যেন অনেক দিন ধরে কারো উপর রাগ পুশে রেখেছে।
-মামা টিকেট দিলেন না?
-দূর মামা বিরক্ত কইরেন না তো, কাগজ নিলে ন্যান, না নিলে টাকা নিয়া চইলা যান।
-কিন্তু মামা...
ভাবলাম এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না। শুধু শুধু পরিবেশটা গম্ভীর হবে আর আমার একা একা থাকার পরিকল্পনাটা নষ্ট হবে। টাকা নিয়ে কাগজ দিলেও সে যখন আমাকে গেইট দিয়ে ঢুকতে দিচ্ছে তবে ক্ষতি কি!
গেইট দিয়ে ঢুকে ভেতরের সোজা রাস্তা ধরে হাটতে লাগলাম। ১০ টা বাজে ঘড়িতে। ভেতরে দেখলাম কতিপয় প্রেমিক প্রেমিকা যুগল পরম আনন্দে গার্ডেনের ভেতরে হাটছে। গার্ডেনের ভেতরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সকালের বিসাদ মনে হয় সব কেটে গেল মন থেকে। কিন্তু আনন্দটা বেশি সময় স্থায়ী হল না। ভেতরের ছোট গেইটটি দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে আবার বিপাকে পড়তে হল। টিকিট চেকার ভদ্রলোক টিকিট দেখতে চাইলেন।
-মামা টিকিটটা দেখান।
-গেইটে টিকিট কাটতে টাকা দিলাম পরে তো এই খবরের কাগজ ধরাইয়া দিসে মামা!
-ধুর মিয়া এই সব ধান্দাবাজি কই পাইসেন? আপনারে মেইন গেট দিয়া ঢুকতে দিসে কে?
(বুঝলাম এরা সব একই দলের। এদের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না।)
-আচ্ছা মামা ভুল হইয়া গেসে। এখন বলেন ঢুকতে কি করা লাগবে?
-১০ টাকা দেন।
কথা না বাড়িয়ে ১০ টাকা দিয়ে দিলাম। কিন্তু আসচর্যের বিষয় এখানেও একই ভাবে আর একটা খবরের কাগজ ধরিয়ে দিলো। আমি আর কিছু না বলেই ভেতরে চলে গেলাম। মনে মনে আর একবার ভাবলাম জীবনটা কতই বিচিত্র।
ভেতরে গিয়ে হাটতে হাটতে চলে গেলাম সোজা পদ্মপুকুরের কাছে। নিরিবিলি একটা যায়গা দেখে এক বাদামওয়ালার কাছ থেকে কিছু বাদাম কিনে বসে পড়লাম। মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আবার নিজের সাথে কথা বলতে লাগলাম। নিজের সাথে যখনি কথা বলতে যাই তখনই প্রথমেই একটা কথাই মাথায় আসে। সেটা হল চাকরি। অনেকের চেয়ে আমার চাকরি পাওয়াটা একটু বেশিই কঠিন। কারন হলো আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা। এস.এস.সি পাস করার পর অনেক বছর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে পড়ে। তারপর উন্মুক্ত বিশ্ব্যবিদ্যালয় থেকে এইচ.এস.সি শেষ করি। শিক্ষ্যাগত যোগ্যতার সনদ কম হলেও নিজের উপর এতটুকু ভরসা আছে আমার, যে আমি কম জানি না। কিন্তু জানলে কি হবে সার্টিফিকেটের এই বাজারে আরও ভারি ভারি পাল্লা নিয়েই মানুষের চাকরি হচ্ছে না আর আমি তো মামুলি। কিন্তু আমার যে একটা চাকরি খুব দরকার! মনে মনে ভাবি কত মানুষ কত কিছু করছে! আর আমার কিছুই হচ্ছে না। আসলে মধ্যবিত্ততা মানুষের জীবনে মনেহয় সব থেকে বড় অভিশাপ। মধ্যবিত্তরা পারে না রিকশা চালাতে, পারে না কোটি টাকার স্বপ্ন দেখতে। বিলাসীতার কথা চিন্তা করলে মধ্যবিত্তদের মানিব্যাগের চিপা থেকে পাঁচ টাকা দশ টাকার নোট গুলো তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম আমার একটা গতি করে দিতে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



