আমি বহুদিন ধরে অদিতিকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি- স্বপ্ন দেখার উপরে মানুষের হাত থাক বা না থাক, স্বপ্ন রচনা করাটা একান্ত নিজের ব্যাপার। ইচ্ছেমতো, রুচিমতো, সাধ্যমতো ভাঙাগড়াও সম্ভব। কিন্তু স্বপ্ন দেখার পুরো প্রক্রিয়াটিই নিজের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত। স্বপ্নের ভেতরে মানুষ আর মানুষ থাকে না, চেনা চরাচরের বাইরে সেই ভিনজগতে প্রবেশের পর মানুষ হয়ে যায় দৃশ্যাতীত কারো হাতের সুতোয় বাঁধা নাচের পুতুল। এসব আতালি-পাতালি যুক্তির কথা বুঝিয়ে বলার পর অদিতিকে আমি প্রশ্ন করেছি- এমন আবেগ থরো থরো মানুষ তুমি; সেই তুমি কেন সুতোয় বাঁধা পুতুল হতে যাবে? পুতুলের কি প্রাণ থাকে? ভালোবাসার মতো হৃদয় থাকে?
কে পুতুল নয় বলো!
অদিতি হুট করে ভারি এক দার্শনিক প্রশ্ন মেলে ধরে। তারপর নজরুলের গান থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করে। গানের বাণী মনে নেই- ‘খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনেঃ,’ খেলার পুতুল কিংবা নাচের পুতুল যা-ই বলো না কেন, পুতুল আমরা সবাই।
আমি হা করে তাকিয়ে থাকি অদিতির মুখের দিকে। একান্তে ভাবি- বলে কী মেয়েটা! এতসব ভারি ভারি কথা কবে কবে শিখল? তবে কি সময়ের বাস্তবতা সবাইকেই যথাযথ শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করে? হবে হয়তো বা। তাই বলে সেটা যে অদিতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, এমন করে আমি ভাবতেই পারি না। অদিতি ঘুরিয়ে আমাকেই প্রশ্ন করে, তুমিই কি তোমার ইচ্ছেমতো সব কিছু করতে পারো?
সত্যিই আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না, তাকিয়েই থাকি।
অদিতি বলেই যায়, ইচ্ছেমতো চলতে পারো? ইচ্ছেমতো বলতে পার?
সত্যিই আমি যেন আর যুক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারি না। চুপ হয়ে যাই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার অন্তর্গত প্রশ্নের ঘাই কিছুতেই থামে না। স্বপ্নভুক এই মেয়েটিকে আমি কতটুকু জানি? চেনাশোনা নেহায়েৎ কয়দিনের নয়। একই সঙ্গে ছাত্র জীবনের সুবর্ণ সময় কাটিয়ে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধনাঢ্য পিতার খেয়ালি কন্যা। রাজহাঁসের মতো সাদা ধবধবে গাড়ি হাঁকিয়ে ক্যাম্পাসে আসে-যায়, রাজ্যের বন্ধুবান্ধব নিয়ে হই হল্লা করে, ইচ্ছে হলে বিস্তর টাকা উড়িয়ে বন্ধুদের চাইনিজ খাওয়ায়, প্রাণখুলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে কারো গায়ে, কাউকে হয়তো অকারণেই গাট্টা মেলে উঠিয়ে দিল নিজের পাশ থেকে, অন্য কেউ দ্রুত এসে শূন্যস্থান পূরণ করল- এসবই আমি দেখেছি নিরাপদ দূরত্ব থেকে। এই দূরত্বের পাঁচিল আমি নিজে থেকে কোনোদিন টপকাইনি। সহপাঠী হিসেবে আর সকলের মতো স্বাভাবিক পরিচয় ঠিকই আছে। এটা-সেটা নিয়ে টুকিটাকি কথাবার্তাও হয়। আসলে তার চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে- ডাঁটফাট বলতে কিছু নেই। পরিচয়ের অনেক পর আমার মনে হয়েছে তার বুকের মধ্যে অতিশয় নির্মল ও স্বচ্ছ একটি ঝর্নাধারা আছে এবং সেটি সতত প্রবহমান। সামনে যা-ই পড়ুক না কেন, খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই ঝর্ণাধারা।
বড়লোক বাবার বিত্তভৈভব নিয়ে এক-আধটুকু অহঙ্কার থাকলেও অদিতির জন্য সেটা বেমানান হয় না হয়তো। কিন্তু তার সেসবের বালাই নেই। বন্ধু বান্ধবের পেছনে অকাতরে পয়সা খরচ করে বটে, সেটুকুও করে নাকি তার নিজের আনন্দের জন্য; এতে অন্যরাও যদি আনন্দিত হয় তাহলে সে হচ্ছে বাড়তি পাওয়া। অদিতির জন্য সেটা পরম আনন্দের। রূপচেহারা নিয়েও অদিতির কোনো আদিখ্যেতা নেই। বিউটি কনটেস্টে নামার মতো সুন্দরী নয় সত্যি, তবু তার নাক, মুখ, চোখ, ভ্রƒ ঠোঁট- কোনোটি যে অসুন্দর তা নির্ণয় করাও অসম্ভব প্রায়। নিজের এই সৌন্দর্য সম্পর্কেও অদিতিকে বরাবরই ভয়ানক উদাসীন মনে হয়েছে। তার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়ে তাকানোরও উপায় নেই কারো। অমনি তার ঘাড় মটকে ধরে দুম করে মুখের ওপর বলে দেবে- আমার দিকে ও রকম ড্যাবড্যাব করে তাকাও কেন বন্ধু। ক্যাম্পাসে আমার চেয়ে অনেক সুন্দরী আছে, চোখে পড়ে না?
অদিতি এ রকমই। রাখা- ঢাকার বিষয়টা যেন ভালোমতো বোঝেই না। যা মনে আসে তা-ই করে ফেলে, যা মুখে আসে তা-ই বলে ফেলে। আমি তো আমার জগৎ থেকে সবই দেখতে পাই, শুনতেও পাই। স্বনির্মিত দূরত্ব পাঁচিলের ওপর দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মেরে এসব দেখি আর একাই হাসি। মনে মনে বলি, কী যে পাগলামী মেয়েটার! এভাবেই চলছিল বেশ। এরই মধ্যে অনার্স ফাইনাল এগিয়ে এলে পরীক্ষার নোটপত্র আদান-প্রদানের সুবাদে আমার সঙ্গে তার যোগাযোগের সোপান রচিত হয়। কিন্তু সেটাও কি খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিকভাবে ঘটে? সেদিনের সে ঘটনা আমার এখনো বেশ মনে পড়ে। প্রাণেশ স্যারের ক্লাস থেকে বেরিয়ে আমরা বেশ ক’জন এক সঙ্গে নামছি আর্টস বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি ভেঙে, একেবারে শেষ মাথায় এসে অদিতির সঙ্গে দেখা। তাকে দেখে আমার সঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই চঞ্চল হয়ে ওঠে, কে যেন প্রশ্নই করে বসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে- কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ক্লাসে দেখলাম না যে!
কারো কোনো কৌতূহলের জবাব না দিয়ে সোজা আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুম করে বলে, এই শোনো!
আমি তো একেবারে হতভম্ব। এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হতে চাই, জিগ্যেস করি, আমাকেই ডাকছেন!
জি জনাব। পরিহাস ছলকে ওঠে অদিতির কণ্ঠে, আপনাকে ডাকতে পারি না?
না মানে, আমার সঙ্গেঃ।
তোমার অত ডাঁট কিসের বলো তো!
ডাঁট! আমার?
আচ্ছা, আমরা কি পরস্পরের বন্ধু নই?
সঙ্গে সঙ্গে আমি মাথা নাড়াই, ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি জানাই- হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই; সহপাঠী তো বটেই!
আমি বুঝতেই পারি না মূল আক্রমণটা কোনদিক থেকে আসছে। আমার ডাঁটের কী-ই বা এমন দেখা গেল! আমি সকৌতূকে জানতে চাই, হঠাৎ বন্ধুত্বের কথা উঠছে কেন?
তাই তো- বন্ধুত্বের কথা উঠছে কেন! বন্ধু বলে তো তুমি স্বীকারই করো না!
সে কী! সহপাঠী বন্ধু বললাম যে!
বন্ধুকে কেউ আপনি বলে?
বলে তো! আমি তো প্রায় সব বন্ধুকেই আপনি বলি।
সেসব তাহলে বন্ধুত্ব না ছাই!
না না, তা হবে কেন!
তোমার ডাঁট তো সেখানে- মুখে বন্ধুত্ব বলবে; কিন্তু অন্তরে দূরত্ব রাখবে।
তোমার সঙ্গে কেউ বন্ধুত্ব করে?
আমি সত্যিই খুব বিব্রতবোধ করি। বুঝতেই পারি না- এ আবার কী ধরনের আলোচনার মধ্যে পড়লাম! আমি খুব বিনম্র ভঙ্গিতে বলি, তা ঠিক। কিন্তু এতদিন পর বন্ধুত্বের কথা উঠছে কেন?
উঠছে, আমি তোমার বন্ধুতা চাই বলেই উঠছে।
এবার আমার ভিমরি খাওয়ার দশা। ওর দিকে ভালোমতো তাকাতেও পারি না। কোনো মতে ঢোক গিলে বলি- বন্ধুতা কি চাইবার জিনিস! হলে তো এমনিতেই হয়।
হয়? তাহলে আমাদের হচ্ছে না কেন?
আমি আবারও অবাক হই। ক্লাসজোড়া সবাই যার বন্ধু, তার কেন এই আদিখ্যেতা? বন্ধুত্বের জন্য তার কেন এই কাঙালিপনা! আমি অদিতির চোখ-মুখের দুষ্পাঠ্য আঁকি-বুকি থেকে উত্তর খুঁজি- কী হয়েছে মেয়েটির? আমি একটু আশকারা দিয়ে, একটু এগিয়ে এসে বলি, আমাদের তো বন্ধুত্ব হয়েই আছে। আবার নতুন করে হবেটা কী!
বড্ড খুশি হয় অদিতি। খপ করে আমার ডান হাত তার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, সত্যি বলছ কবির!
আমি নিজেকে গুছিয়ে ওঠার আগেই অদিতি আমাকে টেনে নিয়ে আসে বারান্দার চওড়া পিলারের আড়ালে। আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে হঠাৎ করে বলে, আজ রাতে তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছি। উহ! কী যে স্বপ্ন! স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন কে জানে! আচ্ছা, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম কেন, বলো দেখি!
এ প্রশ্নের জবাব দেব কী, আমার তো আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়! শুনেছি অদিতি এক প্রকার স্বপ্নগ্রস্ত মানুষ। বলতে গেলে সব সময় নাকি স্বপ্নের ঘোরের মধ্যেই থাকে। গত বছর তার নামে নববর্ষের খেতাবও জুটেছিল বেশ- ‘স্বপ্নমানবী।’ কেউ কেউ তাকে দেখে হিন্দি গানের সুর ভাঁজে ‘মেরা ছপ্নকা রানীঃ’ এসবই আমি কিছু কিছু জানি। কখনো বিশেষ কৌতূহল দেখাইনি, এমনিতে নানাজনের মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। আমি নীরবে শুনেছি। কিন্তু এতদিন পর আমার মতো নিভৃতচারী মানুষ যে অদিতির স্বপ্নের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে, এই সংবাদ আমাকে উ™£ান্ত করে তোলে। অদিতি কিন্তু নির্বিকার। কত অবলীলায় বলতে পারে, বাব্বা! স্বপ্নের ভেতরেও তোমার যা ডাঁট!
কী রকম!
আমি নির্লজ্জের মতো প্রেম নিবেদন করছি। অথচ তুমি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছ না!
এত বড় আস্পর্ধা!
স্বপ্নে তো তাই দেখলাম! এখন বাস্তবে কী যে ঘটে কে জানে?
আমার বুকের মধ্যে দুরুদুরু কেঁপে ওঠে। দুর্ভাবনায় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তবু মুখে অম্লান হাসি ফুটিয়ে বলি,
না না, স্বপ্ন আর বাস্তবকে একাকার করে গুলিয়ে ফেললে চলবে কেন! বাস্তব আরো কঠোর, আরো নির্মম। বাস্তবের কসাঘাত সইবার মতো শক্তি সঞ্চয় করাটা সবার জন্য জরুরি।
খুব ভয়াবহ কিছু শুনছে- এ রকম ভঙিতে লাফিয়ে ওঠে অদিতি, ওরে বাবা! তাহলে আমার স্বপ্নই ভালো!
কিন্তু কেবল স্বপ্নের ভেতরেই মানুষ বাঁচে না অদিতি, পায়ের তলে মাটি চাই। বাস্তবতার এঁটেল মাটি।
কপট ভ্রƒভঙ্গ করে অদিতি আমার চোখে চোখ রেখে বলে, আচ্ছা, তুমিও যে ভারি জ্ঞানের কথা ঝাড়ছ দেখছি!
এটা বড় একটা জ্ঞানের কথা নয় কিন্তু! খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক কথা।
থাক তোমার ঐ সাধারণ কথা! আমার সেই অসাধারণ গানই ভালো- ‘স্বপ্ন যদি মধুর এমন হোক হোক সে মিছে কল্পনাঃ’।
অদিতি এ রকমই আপাদমস্তক স্বপ্নময় মানুষ। স্বপ্নের মধ্যই তার দিন কাটে, রাত কাটে। কখনো যদি বা ঘুম ভাঙে তো স্বপ্ন ভাঙে না। সেই অদিতির স্বপ্নের মোহজালে পতঙ্গের মতো উড়ে এসে আটকে পড়ার মানুষের তো অভাব নেই! আমাদের সহপাঠী এবং সিনিয়র ভাইদের মধ্যে অনেককেই অদিতির চারপাশে ব্যাকুল হয়ে মাথা কুটতে দেখেছি; তাদের সবার পতঙ্গ জীবনের পরিণতির কথা ভেবে আমি দুঃখ অনুভব করেছি; কিন্তু ঈর্ষাবোধ করিনি কখনো।
কেবল একদিন বুকের বাম পাশে ঈর্ষার মতোই কী যেন এক গোপন কাঁটায় খচখচানি অনুভব করি। খুব সূক্ষ্ম, খুব গোপন। ইকবাল আমাদেরই সহপাঠী, সবাই জানে মেয়ে পটানোর যম। তাই বলে ম্যাডামকে পর্যন্ত পটিয়ে ফেলবে। যা খিটখিটে মেজাজ ফরিদা ম্যাডামের! ইকবাল সেই ফরিদা ম্যাডামের বাসা থেকে থার্ড পেপারের সাজেশন এবং নোট এনে আমার সামনেই অদিতির হাতে তুলে দেয়, সঙ্গে এক ভোজ পরামর্শের পুরিয়া- আজে-বাজে নোট পড়ে আর কাজ নেই, বুঝেছ অদিতি! আমিই তোমাকে স্ট্রং সাজেশন এনে দেব। অদিতি অবলীলায় ঘাড় দোলায় এবং স্নিগ্ধ হাসিতে সম্মতি জানায়। এ ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া আমি ওকে জানতে দিতে চাইনি। অথচ পরদিন ক্যাম্পাসে এসে অদিতি নিভৃতে আমাকে বলে- গতকাল বাড়ি গিয়ে অগ্ন্যুৎসব করেছি।
আমি চমকে উঠি- মানে?
ইকবালের সব নোট আগুনে পুড়িয়েছি।
বলো কী! আমি শিউরে উঠি। এদিকে অদিতি খিল খিল করে হাসতে থাকে।
এভাবেই অদিতি আমাকে পদে পদে জিতিয়ে দিতে চায়, বুঝি বা এভাবে জয় করতেও চায়। মাঝে মধ্যে একান্তে ভাবি- আমি কী এমন মানুষ যে আমাকে জয় করার জন্য কারো আবার সাধ্য-সাধনার প্রয়োজন পড়ে! একটু সাদা চোখে তাকিয়ে দেখলেই টের পাই, খুব সযতেœ খুব নিপুণ হাতে অদিতি আমার চারপাশে স্বপ্নের জাল ছড়িয়ে চলেছে। সে জালের সূক্ষ্ম তন্তু দৃশ্যমান হোক বা না হোক, নিশ্চয় তা প্রবল শক্তিশালী। সচেতনভাবে নিজেকে অহর্নিশ শাসাই- ওই মায়াবী জালে আটকা পড়লে আমার কিছুতেই চলবে না।
এ কথা বললে হয়তো পরিহাসের মতো শোনাবে- শৈশব থেকে বাবা-মা ভাইবোনের একরাশ স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে চলেছে। নিভৃত পাড়াগাঁয়ের এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান আমি। ‘লেখাপড়া করে যেই, গাড়িঘোড়া চড়ে সেই’। কী এক স্বপ্নমন্ত্র জপতে জপতে বড় হয়েছি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাবা-মায়ের স্বপ্ন, খোকা বড় হলে তাদের দুঃখ ঘুঁচবে; ভাইবোনের স্বপ্ন- বড় ভাই নিশ্চয় আমাদের কথা ভাববে। এসব স্বপ্নরা সেই কবে থেকে ডালপালা মেলে চলেছে। শুধু কি ডালপালা, এতদিনে পত্রপুষ্পে ঘন ছায়াবীথি রচনা করেছে। আমার সাধ্য কি সেই ছায়ার বিস্তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই! তাই আমি মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই আবার ক্লাস ওয়ান-এর শিশুপাঠ্য ছড়ায় ফিরে যাই, মনে মনে আওড়াই- অ-তে অজগর আসছে তেড়ে, স্বপ্নগুলো নেবে কেড়ে।
একরাশ স্বপ্নের তাড়া খেয়ে হাঁপিয়ে-ধুঁকিয়ে এত পথ এসে এখন যদি সামনেই দেখি স্বপ্নগহ্বর, তাহলে আমার কী করা উচিত? অদিতি যতই আমার চোখের সামনে স্বপ্নের সোনালি ঝালক টাঙিয়ে দিক, ভয়ে আমার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে, শরীর ঠাণ্ডা-হিম হয়ে যায়, দু’চোখের মণি ছিটকে বেরুতে চায়। তখন আমি কিছুই বলতে পারি না। বাগযন্ত্রও যেন বা আড়ষ্ট হয়ে যায়।
অথচ অদিতির দু’চোখভরা স্বপ্ন পেয়ালা উপচে পড়ার মতো কানায় কানায় পূর্ণ। ছাত্র জীবন শেষ হয়ে এলো, এখন সংসারী হবে। উপযুক্ত জায়গা থেকে একাধিক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে বাড়িতে, অদিতির কারণেই সেগুলো প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে পরীক্ষার অজুহাতে। কিন্তু পরীক্ষাও যে ফুরিয়ে এলো, তারপর? অদিতির সোজাসাপ্টা হিসাব- তারপর আবার কী! আমরা বিয়ে করে ফেলব, ঘর বাঁধব।
আমার প্রবল হাসি পায়। হাঃ হাঃ করে হেসে উঠি। অদিতি আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে হাসি থামাতে চায়। আমাকে আশ্বস্ত করতে সে জানায়, বাবা-মা মেনে নিলে ভালো। না নিলেও অসুবিধা নেই। আমার নামে দশ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে, ভাবনা কী!
আশ্বস্ত হবার বদলে আমার ভেতরে তোলপাড় করে হাসির বন্যা এসে আছড়ে পড়ে। মনে মনে আমারই ভয় করে- এই বেয়াড়া হাসির তোড়ে কি স্বপ্নগ্রস্ত এই মেয়েটি ভেসে যাবে! আহা! ঘর বাঁধার কী যে স্বপ্ন! প্রতিদিন স্বপ্নের মধ্যেই ঘর সাজায়, ঘর গোছায়। অথচ এই শহরের অনেক সাজানো গোছানো ঘর অপেক্ষা করছে তারই জন্য। কিন্তু না, তার চাই স্বপ্নের ঘর-সংসার এবং সেটা আমার মতো একজন স্বপ্নতাড়িত ও সন্ত্রস্ত বেকার যুবকের সঙ্গে। তাই কিছুতে হয়! আমি ওকে জীবনের নিষ্করুণ বাস্তবতার গদ্য বোঝাতে চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো কাজে লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনটিতে সে কী বুক ভাঙা কান্না তার! যেন বা নদীভাঙনের মুখে দাঁড়ানো মানুষের আতঙ্ক তার চোখেমুখে। আমি তখন কী বলে আশ্বস্ত করি! মমতার রুমালে মুছিয়ে দিই অদিতির চোখের তটিনি উপচানো অশ্রুরেখা এবং বলি- স্বপ্নের ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবের মাটিতে পা রাখো, আমাকে পাবে নিশ্চয়। আমিও ওই মাটিতেই খুঁজছি আমার দাঁড়ানোর জায়গা। হোক স্বপ্নের ঘরবাড়ি, তবু সেটা মাটির ওপরেই গড়তে চাই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




