পুরনো ডাকটিকেট
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমরা অনেকেই মনে করে থাকি যতো আগের বা যতো পুরনো ডাকটিকেট হবে তার মূল্য হবে ততো বেশি এবং সেটিই হবে দুর্লভ ও মূল্যবান ডাকটিকেট। এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা অনেক পুরনো ডাকটিকেট রয়েছে যা এখনো প্রচুরসংখ্যক পাওয়া যায় এবং দামেও বেশ কম। অথচ এমন দেখা যায় বর্তমান সময়ের একটি ডাকটিকেটও বেশ দুর্লভ ও মূল্যবান। ডাকটিকেটের মূল্য সময়ের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে প্রাপ্যতার ওপর। এ মূল্য বাড়তে পারে ভুল ছাপার কারণে, প্রকাশের স্বল্পতার, প্রাপ্যতার স্বল্পতার মতো বিভিন্ন কারণে।
বিশ্বের কিছু দুর্লভ ও মূল্যবান ডাকটিকেটের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
১৯৯৬ সালের ৮ নভেম্বর জুরিখে একটি ডাকটিকেট বিক্রির ক্ষেত্রে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি হয়। সুইডেনের ট্রিস্কিলিং (ঞৎবংশরষষরহম) বা ৩ স্কিলিং মূল্যমানের হলুদ রঙের একটি ডাকটিকেট পচিশ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে বিক্রি হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাড়ায় প্রায় ২০ কোটি টাকা। বিষয়টি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনাটি সত্যি।
সুইডেনের ট্রিস্কিলিং (ঞৎবংশরষষরহম) ডাকটিকেটটি ১৮৫৫ সালে সবুজ রঙে প্রকাশিত হয়। এ সবুজ রঙ কিভাবে হলুদ হলো সে সম্পর্কে এবার জানা যাক। ১৮৮৫ সালে ব্যাকম্যান নামে একজন টিন এজ সংগ্রাহক তার দাদির কাছে যায় ক্রিসমাস উদযাপন করতে। ওই সময়ে তার দাদি একটা পুরনো আলমারি (পযবংঃ) থেকে ডাকটিকেটসহ খাম খোজার অনুমতি দিলেন এবং সে বেশকিছু পুরনো ডাকটিকেটের সঙ্গে এ হলুদ রঙের ৩ স্কিলিং মূল্যমানের ডাকটিকেটটি পায়। এ সময়ে হেনরিখ লিচেনস্টাইন (ঐবরহৎরপয খরপযঃবহংঃবরহ) নামে স্টকহোমের একজন ডিলার এ মর্মে বিজ্ঞাপন ছাপেন যে, প্রতিটি ৩ স্কিলিং ডাকটিকেট ৭ ক্রোনারে ক্রয় করা হবে। ব্যাকম্যান তার হলুদ রঙের ডাকটিকেটটি ওই ডিলারকে দেখালে তিনি বলেন এ ডাকটিকেট তো হলুদ হওয়ার কথা নয় Ñ এটি হবে সবুজ। তবুও তিনি এ ডাকটিকেটের জন্য ৭ ক্রোনার দিতে রাজি আছেন।
ব্যাকম্যান এ ডাকটিকেট হাতছাড়া না করে আরো বেশি মূল্যে বিক্রির জন্য অনেক বছর তার কাছে রেখে দেয়। এরপর ১৮৯৪ সালে কাউন্ট ফেরারি নামে একজন সংগ্রাহক এ ডাকটিকেটটি ৪,০০০ গুলডেন (এঁষফবহ) মূল্যে ক্রয় করেন। এরপর ১৯২২ সালে ব্যারন এরিক ৩২,২৫০ ফ্রাঙ্ক, ১৯২৬ সালে ট্যাম ১,৫০০ পাউন্ড, ১৯২৮ সালে জোহান রামবার্গ ২০০০ পাউন্ড, ১৯৩৭ সালে রোমানিয়ার রাজা ক্যারল ৫,০০০ পাউন্ড মূল্যে ক্রয় করেন। ১৯৫০ সালে রাজা ক্যারল এটি একটি গোপনীয় মূল্যে বিক্রি করেন। সর্বশেষ জুরিখে এটি ১৪,৯০,০০০ পাউন্ড মূল্যে বিক্রি হয় এবং এটিই এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রীত একমাত্র ডাকটিকেট। এ কারণে বর্তমানে এ ডাকটিকেটকে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ডাকটিকেট বলা হয়।
১৯৪৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মরিশাস ১ ও ২ পেনি মূল্যমানের দুটি ডাকটিকেট প্রকাশ করে। এ ডাকটিকেট দুটি মরিশাস পোস্ট অফিস নামে বেশি পরিচিত। এ ডাকটিকেট প্রকাশের পেছনে একটা মজার ঘটনা রয়েছে।
মরিশাস গভর্নরের স্ত্রী লেডি গম একটি ডান্স শো বা নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের কার্ড পাঠানোর সময় তার খেয়াল চাপে বৃটেনের মতো মরিশাসেও ডাকটিকেট ছাপাতে হবে এবং তিনিই প্রথম এ ডাকটিকেট ব্যবহার করবেন। জো বার্নার্ড নামের এক ব্যক্তিকে এ ডাকটিকেট ডিজাইনের দায়িত্ব দেয়া হলো। ডিজাইনে ফুটন ভিক্টোরিয়ার ছবির ডানদিকে চড়ংঃ ঢ়ধরফ কথাটি লেখা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১ ও ২ পেনি মূল্যমানের ৫০০টি করে ডাকটিকেট ছাপানো হবে। কিন্তু ছাপানোর সময় চড়ংঃ ঢ়ধরফ এর জায়গায় চড়ংঃ ঙভভরপব ছাপানো হয়। ১৮৪৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এ ডাকটিকেট প্রকাশিত হলেও ভুলটি ধরা পড়ে ১৮৬৪ সালে। এ ধরনের ২৬টি ডাকটিকেটের অস্তিত্ব রয়েছে বলে জানা যায়। ১৯৬৮ সালে ১ পেনি দামের এ ধরনের দুটি ডাকটিকেট লাগানো একটি খাম বিক্রয় হয় তিন লাখ আশি হাজার ডলারে। আর ২ পেনি মূল্যমানের একটি ব্যবহৃত ডাকটিকেটের মূল্য বর্তমানে প্রায় ৫ লাক্ষ পাউন্ড।
১৯১৮ সালের মে মাসে আমেরিকা নিয়মিত এয়ারমেইল সার্ভিস চালু করে এবং এ উপলক্ষে ৬, ১৬ ও ২৪ সেন্ট মূল্যমানের তিনটি এয়ারমেইল ডাকটিকেট প্রকাশ করে। এর মধ্যে ২৪ সেন্ট মূল্যমানের ডাকটিকেটে জেনি নামে একটি বাইপ্লেনের ছবি স্থান পায়।
উইলিয়াম টি. রোবে (ডরষষরধস ঞ. জড়নবু) নামে এক ব্যক্তি ওয়াশিংটনের নিউ ইয়র্ক এভিনিউ পোস্ট অফিস থেকে ১০০টি ডাকটিকেট সংবলিত ২৪ সেন্ট মূল্যমানের ডাকটিকেটের একটি সিট ২৪ ডলারের বিনিময়ে ক্রয় করেন। ক্রয়ের পর তিনি লক্ষ্য করেন ডাকটিকেটে এয়ারক্রাফটের ছবি উল্টোভাবে ছাপানো হয়েছে। রোবে এ সিট নিয়ে গেলেন ফিলাডেলফিয়ার এক স্ট্যাম্প ডিলারের কাছে। ডিলার তাকে এ সিটের জন্য ১৫,০০০ ডলার প্রদান করলো। ডিলার অল্প সময়ের ব্যবধানে এ সিটটি ২০,০০০ ডলারে বিক্রি করেন কর্নেল গ্রিনের কাছে। গ্রিন এ সিট থেকে তার জন্য ৪০টি ডাকটিকেট রেখে এবং বাকি ৬০টির প্রতিটি ১৭৫ থেকে ২৫০ ডলারের মধ্যে বিক্রয়ের জন্য সেই ডিলারকে দায়িত্ব দিলেন।
পরবর্তী সময়ে জানা যায় ২৪ সেন্টের এই একটি ডাকটিকেট ১৯৫৮ সালে ৩০০০ ডলার এবং ১৯৭১ সালে ১,১৫,০০০ ডলারে বিক্রি হয়। সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি অকশনে গ্রিন এ ডাকটিকেটের ব্লক অফ ফোর বিক্রি করেন ১১ লাক্ষ ডলারে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর মূল্য দাড়ায় প্রায় ১৬ কোটি টাকা অর্থাৎ একটি ডাকটিকেটের মূল্য ৪ কোটি টাকা।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ডাকটিকেট ছিল বৃটিশ গায়ানার এক সেন্ট মূল্যমানের ডাকটিকেট। যতোদূর জানা যায় বিশ্বে ওই ডাকটিকেটের একটির অস্তিত্ব বর্তমান রয়েছে। ১৮৫৬ সালের কথা। তখন বৃটিশ গায়ানার ডাকটিকেট ছাপা হতো বৃটেনের ওয়াটারলো অ্যান্ড সন্স নামক এক প্রেস থেকে। একবার ডাকটিকেটের অভাব দেখা দেয়ায় ডাক কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে ৪ সেন্ট মূল্যমানের কিছু ডাকটিকেট গায়ানাতেই ছাপায়। ডিজাইনে ছিল উপনিবেশের সীলমোহর, একটি জাহাজের ছবি ও একটি স্লোগান দেমাস পেতিমাস্ক ভিসিসি সিম। বাংলায় যার অর্থ দাড়ায় আমরা দেই ও পরিবর্তে পেতে চাই। ম্যাজেন্ডা রঙের কাগজে লালের সঙ্গে বেগুনি রঙ মেশানো কালো কালিতে এ ডাকটিকেট ছাপা হয়। ছাপার মান ছিল খুব নিম্নমানের। এ ডাকটিকেট জাল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় ডাক কর্তৃপক্ষ এ মর্মে আদেশ দেয় যে বিক্রির সময় ডাক বিভাগের কর্মচারী ডাকটিকেটে নামের আদ্যাক্ষর সই করবেন।
১৮৭৩ সালের দিকে ভার্গন ভগান নামে এক তরুণ পুরনো চিঠিপত্রের মধ্যে ওই নকশার এক সেন্ট মূল্যমানের একটি ডাকটিকেট পান। ডাকটিকেটটি ৪ সেন্টের স্থলে ভুলবশত ১ সেন্ট ছাপা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি তার জানা না থাকায় কিছুদিন পর ম্যাককিনন নামে এক সংগ্রাহকের কাছে মাত্র ৬ শিলিংয়ে ডাকটিকেটটি বিক্রি করে দেন। পাচ বছর পর ম্যাককিনন বিক্রি করে ১২০ পাউন্ডে। এরপর ফ্রান্সের বিখ্যাত ডাকটিকেট সংগ্রাহক ফেরারী এটি কিনেন ১৫০ পাউন্ডে। পরে অনেক হাত ঘুরে ১৯৮০ সালের ৫ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে এক অকশানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় কোটি টাকায় বিক্রি হয়। ২০০৭ সালে এর মূল্য তাহলে কতো দাড়াতে পারে?
১৯৭৬ সালের ২৯ মে বাংলাদেশ আমেরিকার দ্বিশততম স্বাধীনতা বার্ষিকী উপলক্ষে ৩০ পয়সা, ২.২৫, ৫ ও ১০ টাকা মূল্যমানের মোট চারটি স্মারক ডাকটিকেট এবং ২০ টাকা মূল্যমানের একটি ছিদ্রযুক্ত ও একটি ছিদ্রহীন সুভেনির সিট প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিকভাবে এ উপলক্ষ খুব গুরুত্ব পেয়েছিল। আর তাই আন্তর্জাতিক চাহিদার কথা চিন্তা করে আমেরিকার এক স্ট্যাম্প ডিলার প্রকাশিত ছিদ্রহীন সুভেনির সিটের অধিকাংশ কপি ক্রয় করে নিয়ে যান এবং খুব কম সময়ের মধ্যে এ সুভেনির সিট সংগ্রাহকদের নাগালের বাইরে চলে যায়। যতোদূর জানা যায় এ ছিদ্রহীন সুভেনির সিটের মাত্র ৩০ হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল। পরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সাধারণ সংগ্রাহকদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে ওই স্ট্যাম্প ডিলারের কাছ থেকে কিছু সংখ্যক সুভেনির সিট এনে ৪০ টাকায় বিক্রি করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি দু®প্রাপ্যের তালিকায় চলে যায়। বর্তমানে এর মূল্য দাড়িয়েছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। সুভেনির সিটের ডিজাইনার অস্ট্রেলিয়ার ই. ডাব্লিউ রবার্টস এবং প্রিন্টার স্পেনের বিখ্যাত ফুর্নিয়ার সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস।
সংগ্রাহকদের একটা স্বপ্ন থাকে মূল্যবান ও দুর্লভ ডাকটিকেট সংগ্রহে রাখার। এ কারণে অনেক পরিশ্রম ও গবেষণার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন দেশের ডাকটিকেটের খবর রাখতে হয়। আশা করি এ দেশের সংগ্রাহকরা ডাকটিকেট সংগ্রহের পাশাপাশি ডাকটিকেট বিষয়ক আর্টিকেল পড়ার বিষয়ে আগ্রহী হবে।
আর সংগ্রহ করতে করতেই এক সময় দেখা যাবে একটি ডাকটিকেট হয়ে গেছে দুর্লভ ও মূল্যবান। যেমন হয়েছে আমেরিকার দ্বিশত স্বাধীনতা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ছিদ্রহীন সুভেনির সিট। এ সিট যার সংগ্রহে আছে তিনি এখন একটি মূল্যবান ডাকটিকেটের সংগ্রাহক বা গর্বিত মালিক।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।