ভুত আমার পুত
পেত্নি আমার ঝি৷
শাকচুন্নি সখি আমার
করবি আমার কি?
তাই আমি কোন বিড়ালকে আমার পয়ের তলা দিয়ে যাওয়ার কোন চান্স দিই না ৷ খেতে বসলে দুটো পা'ই চেয়ারের উপর তুলে পা ভাঁজ করে বসি ৷ কিন্তু বেড়ালও তো আমার পিছু ছাড়ে না ৷ সুযোগ পেলেই কটকট করে তাকিয়ে থাকে ৷ জানান দেয় যে ওরা আমার মতলব সব বুঝতে পারছে ৷ ছোটবেলা থেকেই বেশ ভীতু আমি ৷ সমবয়েসী বন্ধুদের বলা বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনা, রাত্রির অন্ধকারে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ কদম গাছ, রাতের অন্ধকার, কাজের বুয়া (মাসি) দের বলা সত্য-মিথ্যে সব গল্প আমাকে চিরকালীন ভীতু বানিয়ে দিয়েছে ৷
সেদিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল কাক ভিজে হয়ে বাড়ি ফিরে দেখি মা ঘুমাচ্ছে ৷ বারান্দা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম দোতলার টিনের চাল বেয়ে জলপ্রপাতের মত গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি ৷ মা ঘুমাচ্ছে কি না আরেকবার ভাল করে দেখে নিয়ে আমি সেই প্রপাতের তলায় ৷ বাড়ির পেছনটা এমনিতেই বেশ নোংরা ৷ পেছনের এই উঠোনটা বেশ বড় হলেও আবর্জনা ফেলা ছাড়া আর কোন কাজে লাগেনা ৷ যেখানে দাঁড়িয়ে আমি ঐ জলপ্রপাতের জলে স্নান করছি তার ঠিক পাশেই খোলা সরু ড্রেন ৷ এর আগেও এই ড্রেনে পা হড়কে পড়েছি বলে জানি থকথকে ঘন নোংরা জল জমে আছে ওতে যাতে আমার হাঁটু অব্দি দুবে যায় ৷ এখন এই তুমুল বৃষ্টিতে যা এক চওড়া নালার রূপ নিয়েছে ৷
তাই তাই তাই
মামার বাড়ি যাই
মামি দিল দুধভাত
পেট ভরে খাই
মামা আইল গদা লইয়া
পলাই পলাই
কখন যে দোতলার রেলিংএর কার্ণিশে এসে দাড়িয়েছে এক অচেনা বেড়াল খেয়ালই করিনি ৷ চোখ পড়া মাśই আমি বৃষ্টি জলপ্রপাত স্নান সব ভুলে ষ্ট্যাচু৷ বেড়ালের দিকে অপলক তাকিয়ে আমি আর বেড়ালও তার ঠান্ডা চোখে একদৃষ্টিতে আমাকেই দেখছে৷ সম্বিত ফিরতেই আম্মা বলে চেঁচিয়ে ছুটব বলে পা বাড়াতেই এক পা সোজা সেই ড্রেনে ৷ মা সেই চীত্কার শুনেছে আর পড়ে যাওয়ার শব্দও৷ ছুটে এসে কাওকে দেখতে না পেয়ে কেডা রে? কি হইসে, বলে জোরে আওয়াজ দিল ৷ আমি কোনমতে বলতে পারলাম 'আমি আম্মা'৷ ততক্ষণে বেড়াল উধাও৷ ড্রেনে পা হড়কে পড়ে গিয়ে চোটও লেগেছে বেশ, তার উপর মা আগে পিঠে দু ঘা বসিয়ে তারপর টানতে টানতে নিয়ে গেল কলতলায় ৷
মেয়েদের খোলা চুল নাকি বদ জীনেদের খুব প্রিয়৷ দাদী বলেছে তিন সন্ধ্যের সময় ( সূর্য ডোবার আগে ও পরে) সব জীন ভূত চলাচল করে ৷ তাই বিকেলের পর থেকে যেন কক্ষনো খোলা চুল করে বাইরে না যাই ৷ খোলা চুল দেখতে পেলেই বদ জীন এসে বাসা বাঁধে৷ আর যদি জীনের সেই মেয়েকে পছন্দ হয়ে যায় তাহলে তো আরও বেশি সমস্যা ৷ জীন সেই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে, তার সাথে সংসার করে৷ মানুষে তো জীনকে চোখে দেখতে পায় না ৷ জীন যাকে দেখা দিতে চায় শুধু সেই দেখতে পায় ৷ সেই মেয়েটা জীনের সাথে কথা বলে, হাসে৷ তার জন্যে রান্না করে ৷ সবার মাঝে থেকেও জীন থাকে অদেখা, তাই লোকে ভাবে সে পাগল হয়ে গেছে৷ ব্যস ৷ শুরু হয়ে গেল সেই মেয়েটার পাগলামো সারানোর ব্যবস্থা ৷ মৌলভী সাহেব আসেন৷ একগাদা তাবিজ পরিয়ে দেন ৷ সূরা ফাতিহা পড়ে পানি ফুকে দেন ৷ আলহাম্দুলিল্লা হিরাব্বিল আ লামিন...আস্তাগফার পড়ে কালো কারে ফুঁকে ফুঁকে ন'খানা গিট দিয়ে বেঁধে দেন জীনে ধরা মেয়েটির হাতে ৷ যাতে জীন আর মেয়েটির কাছে না আসতে পারে ৷ 'আস্তাগ ফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বি ওয়াতুবু ইলাইকা লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লা হিল আলিউল আজীম ৷' সেই পানিপড়া খেয়েও মেয়েটা ভাল হয় না ৷ জীন তো তাকে ছেড়ে যাবে না কিছুতেই ৷ অনেক জীন আবার পছন্দের মেয়েকে তুলে নিয়ে চলে যায় ৷ তাদেরকে আর কোনদিনও খুঁজে পাওয়া যায় না ৷
আমি তাই বিকেল হলেই আঁট করে চুল বেঁধে রাখি ৷ সন্ধ্যের পরে বারান্দায়ও যেতে চাই না ৷ বারান্দা থেকে পরিষ্কার দেখায় মাঠের কোণের ঐ কদম গাছটাকে ৷ চাপচাপ অন্ধকার দানা বেঁধে থাকে ঐ কদম গাছে ৷ যদি কোন কারণে বারান্দায় যেতে হয় তো জোর করে চোখ ফিরিয়ে রাখি ঐ কদম গাছ থেকে ৷ সবসময় মনে হয় ওখান থেকে কেউ আমাকে দেখছে ৷ লাল দুটি চোখ৷ তাতে পলক পড়েনা , তাকিয়ে আছে যেন আমার দিকে, আমি তাকালেই সে হাতছানি দিয়ে ডাকবে আমায় ৷ রাতের পর রাত অমি চোখ ফিরিয়ে থাকি ঐ কদম গাছের থেকে৷ ঘরের জানালা বন্ধ করে দেই বিকেল হলেই ৷ দিনের বেলা যে বেড়ালটা মিউ মিউ করে আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, খাওয়ার টেবিলের তলায় ঢুকে বসে থাকে, সেই যেন রাতে ঐ কদম গাছে চড়ে বসে থাকে৷ তখন তার চোখ লাল ৷ অপলক তাকিয়ে থাকে সে আমার দিকে ৷
অথচ বর্ষায় যখন কদম ফোটে, আমি তখন প্রায় দিন হেনা, মিলি, সেতুদের নিয়ে সেই কদম কুড়াতে যাই ৷ সেতুটাও কদম ফুল খুব ভালবাসে ৷ মিলিরা সুর করে ছড়া কাটে ৷
চান্দ উঠছে
ফুল ফুটছে
কদমতলায় কেডা?
খুকুমণির বিয়া হইব
ঘোমটা মাথায় দিয়া ৷
কখনো আমি একা ও যাই৷ কদম গাছটা আমাকে খুব টানে ৷ সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় যাই প্রথম চোখ পড়ে ঐ কদম গাছটার উপর ৷ তখন আর ঐ লাল চোখদুটো দেখতে পাই না৷ তখন আর সে কোন বদ জীনের বাসা নয় ৷ তখন সে শুধুই কদম গাছ৷ বাতাসে নড়ে তার ডাল, পাতা ৷ টুপটুপ বৃষ্টি পড়ে ফুলভর্তি ঝাঁকড়া কদম গাছে৷ কোন কোনদিন সকালবেলাতেই আমি একা চলে যাই ছোট্ট ঐ মাঠ পেরিয়ে কদম গাছের তলায়৷ ভয়ে দুরুদুরু করে বুক ৷ তবু যাই ৷ না গিয়ে পারি না ৷ আমাকে ভীষণ টানে ঐ কদমগাছ৷
ননীর বাপ বলে, আফাজান, রাইতে একদম ঘরের তেন বাইর হইয়েন না ৷ আমি রোজ রাইতে তাইনে গো দেহি ৷ আমি ননীর বাপকে জিজ্ঞেস করি, বুড়ো মিঞা, তোমাকে তারা কিছু বলে না? ননীর বাপ, আমাদের বুড়ো দারোয়ান উততর দেয়, আমি যে দোয়া পইড়া শরীরে ফুঁক দিয়া শরীর বন্ধ কইরা রাখি ৷ তাই হেরা আমারে কিসু করতে পারেনা ৷ নইলে তো কুন কালেই আমারে শ্যাষ কইরা ফ্যালাইত ! বুড়ো মিঞাকে অনুরোধ করি সে যেন আমাকেও শিখিয়ে দেয় শরীর বন্ধ করা ৷ আমি ও রাতে বাইরে বেরুতে চাই ৷ কুল গাছটার তলায় যেতে চাই ৷ সফেদা গাছের সরু লিকলিকে ডাল থেকে ঐ বড় সফেদাটা পেড়ে আনতে চাই৷ দোতলার রেলিংএ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখতে চাই ৷ বুড়ো মিঞা যদি শরীর বন্ধ করা না শেখা তবে তো আমি বেরুতেই পারবো না ৷ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এখন যেমন জোর করে চোখে বন্ধ করে গুটি সুটি মেরে পড়ে থাকি সব সময়েই তাই থাকতে হবে ৷ বুড়ো মিঞা কেমন মাথায় পাগড়ি বেঁধে হাতে তার লাঠিটা নিয়ে সারা রাত বাড়িটাকে পাক দিয়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় ৷ গভীর রাত্রে সে সুর করে দরুদ পড়ে,
নূর মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ
মাফি কালফি গায়রুল্লাহ
পড়ো সবে সাচ্চা দিলে
লা ইলা হা ইল্লাল্লাহ৷
আমার ঘুম ভেঙে যায়, চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি৷ বুড়ো মিঞা কি এখুনি তাদেরকে দেখল?
আমি কাওকে বলতে পারিনা আমার এই ভয়, উত্কন্ঠার কথা ৷ সকাল সাড়ে ন'টা বাজলেই সেতু এসে দাঁড়ায় ৷ স্কুলে যাওয়ার সময় হল ৷ আমি আর সেতু একই স্কুলে পড়ি৷ সাদা সালোয়ার কামিজ , কোমরে চওড়া সবুজ বেল্টে গুঁজে দিয়ে পরা ভাঁজ করা সাদা ওড়না ৷ ঝটপট রেডি হয়ে মায়ের কাছ থেকে টিফিনের পয়সা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি৷ সাইকেল রিকশায় আমি আর সেতু স্কুলে যাই ৷ আমার সবচাইতে প্রিয় ক্লাস, রুবিনা আপার ক্লাস৷ রুবিনা আপা বাংলা পড়ান ৷ বেশির ভাগ মেয়েদেরই সেই ক্লাসে পানির পিপাসা পায় ৷ রুবিনা আপা যে খুব ভাল৷ কোন মেয়েকে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করান না ৷ মেয়েরা যতবার পড়া বিষয়ে প্রশ্ন করে তিনি ততবার পড়া বুঝিয়ে দেন ৷
'বাড়ি তো নয়, পাখির বাসা, ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি ৷
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারই তলে আসমানীরা থাকে বছরভরে ৷
পেটটি ভরে পায় না খেতে বুকের ক'খান হাড়
সাক্ষী আছে অনহারে ক'দিন গেছে তার ৷
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপরাশি
থাপড়েতে নিভিয়ে গেছে দারুন অভাব আসি ৷
পরনে তার শতেক তালি শতেক ছেঁড়া বাস
সোনালী তার গা'র বরনে করছে উপহাস৷
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি ৷' ( জসীমুদ্দীন)
পড়ার ছলে গল্প করেন৷ যে গল্পটা অথবা কবিতাটা পড়ালেন সেই গল্পের হাত ধরে চলে যান আরও অনেক গল্পের দেশে ৷ কবির কথা বলেন৷ লেখকের কথা বলেন ৷ আমার মনে প্রশ্ন জাগে এত সুন্দর দেখতে রুবিনা আপা, তাকে কোন জীনের পছন্দ হয়নি? রুবিনা আপা তো মাথায়ও কাপড় দেন না ৷ তাহলে কি রুবিনা আপা জানেন কি করে শরীর বন্ধ রাখতে হয়? আমি সেতুকে জিজ্ঞাসা করি ৷ সেতু বলে, তোরে একদিন জীনে ঠিক লইয়া যাইব!
প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে বুড়ো মিঞা তাদেরকে দেখে৷ চার-পাঁচ জন নাকি থাকে তারা৷ ইয়া লম্বা লম্বা দেখতে৷ বিশাল বড় বড় পা ফেলে তারা আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে পেছনের টিলার দিকে চলে যায়৷ সে রাতে বারে বারে আমার ঘুম ভাঙে৷ ফ্যানের বাতাসে ঘরের পর্দা নড়লেও আমার মনে হয় ঘরে কেউ আছে৷ আমি আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিই ৷ 'আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাআ হুয়াল হাইয়ুল ক্কাইয়ুম৷ লা তা'খুজু হু সিনা তু ওয়ালা নাউম৷ লাহু মা ফিস সামা ওয়াতি ওয়ামা ফীল আরদ...৷'
রাতকে আমার ভীষণ লম্বা আর বড় বলে মনে হয় ৷
(গল্পটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল সোনাঝুরি ওয়েবজিনে )

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


