বইটা শেষ করার পরে বেশকিছুক্ষন মাথা ঝিম ঝিম করছিলো। শেষ বিকেলের অন্ধকার হয়ে আসা আলোতে পড়ার ফলে নাকি লেখকের সুতীক্ষ্ণ লেখনীর প্রভাবে- ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
বইয়ের শুরুতেই মালতীর জবানবন্দী দেখি, পাঠকের কাছে যেন জবাবদিহী করছে- “হ’য়ে গেছে- ওটা হ’য়ে গেছে- এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি। করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে।”
নয়নাংশুর ছাত্রী ছিলো মালতী। ছোকড়া বয়সের প্রফেসরের জ্ঞান আর মুখের ভারী ভারী কথা সহজেই কিশোরী মনে দোলা দিয়ে যায় ক্লাসরূম ভর্তী ছাত্রীদের। মালতীরও দিয়েছিলো বৈকি। সেখান থেকেই দুজনের একটু একটু করে এগিয়ে আসা বিয়েতে গড়ায়।
আকর্ষণ হয়েছিলো, ভালোবাসা হবার সময় কি পেয়েছিলো? বুদ্ধদেব বসু সেটা উত্তর দিতে গিয়েই ছবি এঁকেছেন গল্পের। হয়তো হয়েছিলো। একটু হলেও। কারন বিয়ের পরে মালতী হতে চেয়েছিলো আটপৌরে ‘বউ’ এর ভূমিকা পালন করতে। শ্বশুরবাড়ির মন জয় করতে, স্বামীর ভাগটুকু বুঝে নিতে। নারীত্বের পরিপূর্ণতা পেতে সংসার পালনের মাধ্যমে। আর দশটা মেয়ের জীবনই চেয়েছিলো।
কিন্তু নয়নাংশুর চোখে নারীত্বে বড্ড বেশি ‘মেয়েলিপনা’ ধরা পড়ে। ‘মেয়ে’ আর ‘মেয়েলিপনা’ – এই দুটো ব্যাপার যেন ঠিক খাপ খায় না তার কাছে। আত্নার উন্নতি নেই এতে। সে চায় ভরাট সংসার থেকে সরে গিয়ে আলাদা হয়ে যেতে। বেশি বেতনের চাকরি পেয়ে উঠে পড়ে বড় ফ্ল্যাটে যৌথ পরিবারকে ছেড়ে। যেখানে আগমণ ঘটতে থাকে তার বন্ধু-বান্ধবদের। চলে সাহিত্যিক আলোচনা, চলে চীন-তিব্বত নিয়ে বড় বড় বুলি, কাপের পর কাপ চা আসতে থাকে হেঁসেল থেকে।
নয়নাংশু চায় মালতীকে ভেঙে গড়তে। বইয়ে দেখা মানবীদের আদলে হয়তো চায় তাকে। কিন্তু সেই ভাঙা গড়াকে সে ছেড়ে দেয় সময়ের উপর। অপেক্ষায় থাকে মালতী একদিন বদলাবে। যে মালতী অংশুর বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে গুটিসুটি মেরে থাকবে না। মিশতে পারবে, কথা বলে নিজের জায়গা করে নেবে।
ভালোবাসার কথা বলে নয়নাংশু, ভালোবাসাকে ব্যাখ্যা করে। কবিতা পড়ে শোনায় মালতীকে, কবিদের জীবন বর্ণনা করে। কিন্তু ব্যাখ্যা করতে করতে ভুলে যায় যে ভালোবাসা মুখ ফুটে ‘I Love You/আমি তোমাকে ভালোবাসি’র মধ্যে বৃত্তবন্দী না। ভালোবাসা অনুভবের ব্যাপার। ভালোবাসা শরীরের ব্যাপার। শুধু মনের ক্যানভাসে তুলির পরশ বুলিয়ে গেলেই ভালোবাসা সার্থক হয় না। সার্থক হয় দুজনের শ্রান্ত শরীরের ঘামে, সার্থক হয় একে অন্যের উদ্দামতায় হারিয়ে যাওয়াতে।
নয়নাংশু-অংশু-নয়নাংশু! পুরোটা জুড়েই তার কল্পনা, তার কবিতা, তার লেখা, তার ব্যাখ্যা। এর মধ্যে মালতী কোথায়? ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে ক্লান্ত সে, ভালোবাসার বর্ণনা শুনে শুনে বিরক্ত। স্বামী ভালোবাসা চেনে দাবী করে, অথচ মুখ ফুটে বলতে পারে না। তাকে অনুভব করে না। পুঁথি প্রাপ্ত জ্ঞানের চাইতে শরীর থেকে উদ্গত আনন্দের জোর অনেক বেশি। কারন ভালোবাসায় শরীরের দাবি সবচেয়ে বেশি। স্বীকার কেউ করুক, কেউ না করুক তাতে কিছু আসে যায় না। একটা সময় মালতী ক্লান্ত হয়ে পড়ে অংশুর জীবন যাত্রায়। আর তখনই আগমন ঘটে জয়ন্তের, অংশুর অফিসেরই কলিগ।
সারা রাত অঝর ধারায় বৃষ্টির পরে সকাল বেলায় একটুকরো রোদের দেখা পেলে যেমন দেহ-মন চনমন করে ওঠে ঠিক তেমনি জয়ন্ত মালতীর জীবনে আসে একটুকরো রোদ্দুর হয়ে। প্রথমটায় আড়ষ্টতা থাকলেও মালতীর জীবনে ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়তে থাকে সোজাসাপ্টা, স্পষ্টভাষী কিন্তু উস্কোখুস্কো জয়ন্তের। অংশু কখনো মালতীকে চিনতে চায়নি বারো বছরের জীবনে, জানতে চায় কি তার প্রিয় রঙ কি, শৈশব-কৈশোর কেমন কেটেছে। চেয়েছে জয়ন্ত। ছোট ছোট আকাঙ্ক্ষা গুলো মেয়েরা মুখ ফুটে বলতে পারে না। অথচ এই আকাঙ্ক্ষা গুলো কতই না সাদামাটা- ছেলেটা তাকে জানুক, তাকে আপন ভাবুক, জিজ্ঞেস করুক কিসে সে খুশি হয়, কিসে মন খারাপ হয়। দরকার নেই ইউরোপিয়ান কবি-সাহিত্যিকের সাহিত্যের বর্ণনা শোনানোর, দরকার নেই রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা থেকে উদ্বৃতি দেবার, শুধু দরকার কান পেতে মেয়েটার অতীতের গল্প শোনার, দরকার মেয়েটার ভবিষ্যতের ছবি দেখতে চাওয়ার ইচ্ছাটার। আর তো কিছু না। আর সেটা করেছে জয়ন্ত। অংশুর যা করা উচিত ছিলো, করছে জয়ন্ত। দোষটা কি অংশুর নাকি মালতীর? বুদ্ধদেব বসু বিচারের গুরুভার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।
পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
জয়ন্ত বিবাহিত, মালতীও। সমাজের চোখে অপরাধী তারাই। অংশু পরিস্থিতির শিকার। তাইনা?
উত্তর আমার জানা নেই। দোষটা আসলে কার সেটাও জানা নেই। নয়নাংশুর ব্যর্থতা, আর মালতীর চাওয়া-পাওয়ার অসমান জের কিংবা এলোমেলো জয়ন্তর ধৈর্য্য আর মনোযোগের দোষ হতে পারে।
যৌনতা এই ২০১৮ সালে এসেও ট্যাবু আমাদের সমাজে। চোখের আড়ালে লক্ষ লক্ষ স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে ঘৃণা করে যাচ্ছে শারীরিক প্রাপ্তির হিসেব মেলাতে না পেরে। অথচ মুখ ফুটে বলতে অপরাগ দুপক্ষই। মালতীর কথা পড়তে পড়তে আমেরিকান লেখিকা লি বারডুগোর একটা কোটের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো বার বার-
Many boys will bring you flowers. But someday you'll meet a boy who will learn your favorite flower, your favorite song, your favorite sweet. And even if he is too poor to give you any of them, it won't matter because he will have taken the time to know you as no one else does. Only that boy earns your heart.
জয়ন্ত তো তাই করেছিলো। খুব বেশি কি খারাপ কিছু করে ফেলেছিলো? আর নারী-পুরুষের আকর্ষণের শেষটা হয় শরীর দিয়ে। তাদেরও তাই হয়েছিলো। যার বর্ণনা বইয়ের শুরুতেই দেখতে পাই আমরা। অথচ এই কাজটা করার কথা ছিলো নয়নাংশুর। করেছিলো? সে চেয়েছিলো ভবিষ্যতের উপরে সবকিছু ছেড়ে দিতে। কিন্তু সবকিছু সময়ের উপর ছেড়ে দিলে বর্তমানের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না মানুষের। অংশুরও থাকেনি। যার ফলাফল- মালতী আর জয়ন্তের অবৈধ মিলন।
পদস্খলন হলে দোষটা আসলে যে কার তা ব্যাখ্যা করা এক প্রকারের অসম্ভবই। কারন, একটা ঘটনার পেছনে শতটা ঘটনা থাকতে পারে, শতদিনের ঘটনা থাকতে পারে। বইয়ের শেষ লেখক আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, আশার বাণী শুনিয়েছেন- তবুও জীবন চলে জীবনের নিয়মে। কারন- “ভালোবাসা জরুরী নয়, স্বামী স্ত্রী জরুরী, বেঁচে থাকাটা জরুরী।”
১৯৬৭ সালে বের হওয়া ৫৫ পৃষ্ঠার উপন্যাসের প্রতিটা শব্দই জ্বলজ্বল করে নিজের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়। তখনকার দিনের পরিপ্রেক্ষিতে লিখলেও এখনও এই বইয়ের আবেদন কমে যায়নি বিন্দুমাত্র। বরং বলা যায় আরো বেড়েছে। সমাজ বিরোধী বিষয়বস্তুও যে শিল্পীর তুলিতে আঁকা যায়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই রাত ভ’রে বৃষ্টি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩১