আজকে দুপুরে এক প্লেট জম্পেশ খাবার খেয়ে আমি তখন বিছানাতে গড়াগড়ি করছিলাম। সামনে একটা চমৎকার সপ্তাহ যাবে ভেবে খুব আনন্দ লাগছিলো। কি মনে করে পাশের টেবিল থেকে মোবাইল টা নিয়ে একটু ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, সেই সময়ে খুট করে একটা শব্দ পেলাম। আমি খেয়াল করলে বুঝতে পারলাম শব্দটি আসছে আমার রুমের একদম নীচের রূমটি থেকে। আমার ফ্ল্যাটে আমি ছাড়া আর কেউ থাকে না। ভার্সিটি এক ব্লক পরে হওয়াতে আমি এই ফ্ল্যাটেই থেকে আসছি গত কয়েক বছর। বাবা-মা থাকে গ্রামে, সেখানেই চাষ বাসে ব্যস্ত। সেখানেই তারা বেশ আনন্দে আছে, মাঝে সাঝে আমরা মোবাইলে কথা বলি আর প্রতি ছুটিতেই বেড়াতে চলে যাই।
এই ফ্ল্যাট টাও বেশ ছিলো। এবং মালিক সাধারণত এখানে বেশি না আসাতে আমরা ভাড়াটিয়ারা বেশ মজাতেই দিন যাপন করছিলাম। কিন্তু আমার এই নীচতলার মানুষেরা আসার পর থেকেই ক্যামন জানি লাগছে আমাদের সবার। কিন্তু কারণ টাও ধরতে পারছে না। প্রায়ই অদ্ভুত শব্দ আসে ফ্ল্যাট থেকে। মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের ছাদ থেকে কিছু ফূড়ে আমার ঘরে চলে আসবে। লোকটিকে একবার আমি দেখেছিলাম, সে একজন বিজ্ঞানী বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে। এরপর মনে হচ্ছে যে আসলে ঠিক ই আছে, বিজ্ঞানীরা তো এমনই আজব হয়।
ভদ্রলোক সম্পর্কে যতদূর জানতে পেরেছি তা হলো উনি উনার পি এচ ডি শেষ করে এসেছে চীনের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখানে এখন তিনি রিসার্চের কাজ করছেন। কোন রিসার্চের কাজে মানুষ এমন আজব খুট খাট শব্দ করে তা বুঝা মুশকিল। তবে লোকটা যে একলা থাকে তাও নয়। মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা করতে কিছু মানুষ আসে। কেউ থেকেও যায়। কেউ চলে যায় নাকি থেকে যায় তাও কেউ খেয়াল করে না। তবে মন্দের খারাপ এই যে প্রায়ই উনি আমাদের ঘরে ঘরে এসে সুস্বাদু খাবার দিয়ে যায়। আমরা যতক্ষন না খাই ততক্ষন যে উতসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। সুস্বাদু বলার সাথে সাথেই বিজয়ী হাসি দিয়ে সে আমাদের ঘর ত্যাগ করে। তাই মাঝে মাঝে ভদ্রত করে আমরাও তাকে বিভিন্ন জিনিস দেই, সুস্বাদু খাবারের জন্যই হয়তো বাড়ির কেয়ারটেকার ও তেমন কিছু বলে না তাকে। আমি তার ফ্ল্যাটে দুই এক বার গিয়েছিলাম বটে। ড্রয়িংরুমটা কেমন জানি বদ্ধ বদ্ধ, আমি বলেছিলাম দম বন্ধ লাগে না বুঝি? উনি মৃদু হেসে বলেছিলেন এই ই বেশ।
কিন্তু আজকাল উনাকে দেখা যায় খুব কম। বের ই হয় না বলতে গেলে। এই সব ভাবতে ভাবতেই দরজায় নাড়া পড়লো, খুলে দেখলাম ভদ্র লোক দাঁড়িয়ে। হাতে বরাবর এর মতোই একটি ট্রে। আমি ভাবতে লাগলাম আজ আবার কি। দেখলাম বেশ স্যুপ টাইপের কিছু একটা সাথে কিছু ফ্রাই এখানে সেখানে ভাসছে। যতক্ষন না খাবো উনি তো যাবে না, তাই খেতে শুরু করলাম। দু'চামুচ মুখে দেবার পর কি করে জানি উনার পকেটে চোখ পড়ে গেলো, পকেট এর কোন গুলো কেমন জানি কালো হয়ে গেছে অনেক দিন পানি চোখে না পড়ার কারণে হয়তো। কিন্তু খেয়াল করলাম সেই পকেট থেকে একটা লম্বা তারের মত কিছু একটা বের হয়ে আছে, তবে তার টা শক্ত নয়। কেমন জানি মোটা থেকে সরু হয়ে গেলো। আমি আবার তাঁকানোর সময় খেয়াল করলাম আসলে দু'টি তার এভাবে আর সেগুলো এখানে সেখানে তির তির করে নড়ছে। কেনো জানি ভালো লাগলো না ব্যাপারটা। আবার চোখের কোনা থেকে খেয়াল করে দেখলাম যে তার শার্টের হাতার নিচ থেকেও এরকম তার বের হয়ে আছে। সেদিন আর খেতে পারলাম না তবে খাবার টা কিন্তু সুস্বাদু ছিলো বরাবরের মতোই। বরং আজকাল মনে হয় মজা বেশি ই হচ্ছে সেটাও জানালাম ওঁকে, উনার চোখ জোড়া মনে হয় জ্বলে উঠলো ক্ষনিকের জন্যই।
সেদিনের মতো উনি বিদায় নিলেও ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছিলো না। কেমন জানি পেট গুলিয়ে যাচ্ছিলো, এই অদ্ভুত জিনিস গুলো বেশ পরিচিত মনে হতে লাগলো, কোথায় দেখেছি কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতে হঠাত মনে পড়লো আসলে কি হতে পারে। এরপর ই ভাবলাম ধুত্তোর ছাই, কি সব ফালতু চিন্তা ভাবনা এ হতেই পারে না।
এভাবে আরো বেশ কিছুদিন চলে গেলো, ভদ্রলোকের দেখা পাওয়াই দূষ্কর। আমার ও পরীক্ষাও চলে এসেছিলো। পরীক্ষার জন্য সারাদিন রাত লাইব্রেরীতে পড়ে রইলাম। পরীক্ষা শেষে যেদিন আবার বাসায় আসলাম, গোসল সেরে সেই আগের অলস সময়ে ফেরত চলে গেলাম। এরপর আবার অদ্ভুত ফর ফর শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। মাথা টা নীচে তাঁকিয়ে খেয়াল করলাম, দেয়ালের কিনারার ফোকর গেলে একটা তেলাপোকা কোথা থেকে বের হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি গ্রামের মেয়ে, এসব আমার তেমন কিছু মনে হয় না কিন্তু সাধারণত আমার ফ্ল্যাটে এই পোকাটি এত দেখা যায় না। এরপর খেয়াল করলাম খাটের নীচ থেকেই আসলে ফর ফর শব্দ গুলো আসছে। আমার ফ্ল্যাটের সস্তা কাঠের মেঁঝেতে কি হলো ভেবে আমি আতংকিত হলাম, এত টাকা পয়সা কোথায় পাবো। এসব ভাবতে ভাবতে খাটের নীচে দেখার চেষ্টা করলাম,কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কি করবো বুঝতে না পেরে দ্রুত খাটটি সরিয়ে ফেললাম জায়গা থেকে। এরপর যা দেখলাম তা দেখে মুখ ভর্তি বমি চলে আসলো যেনো। দেখলাম খাটের নীচে এক আদ্র্য জায়গার তৈরী হয়েছে আর সেখানে অসংখ্য তেলাপোকা ঘোরাফেরা করছে। কেনো জানি মনে হলো এসবের উতপত্তিস্থল হলো নীচের ফ্ল্যাট টাই। আমি ছুটে গেলাম নীচে। দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তে লাগলাম।
দরজা যেনো স্বাভাবিক ভাবেই খুলে গেলো। ভেতরে উঁকি মারতেই দেখলাম অস্বাভাবিক ভাবে অন্ধকার হয়ে আছে ভেতরটা। একটু এগোতেই সর সর করে কিছু যেনো চলে গেলো। এদিক সেদিক তাঁকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক বসে আছে এক কোনায়। এত অন্ধকার বলে উনাকে হঠাত করে দেখি ই নি। আমাকে বললো, "বসো লিলি।" আমার ভেতর থেকে কেউ বলছে সেই তখন থেকেই যে বসো না, বিপদ ঘোর বিপদ। কিন্তু মাঝে মাঝে আগ্রহ বিপদের ভয় কেও হার মানায়। আমি বসে পড়লাম। উনি বললো, "কোনো সমস্যা?"
আমি বললাম, "জ্বী আপনি কি ঠিক আছে। আমার ঘরে খুব তেলাপোকা দেখা যাচ্ছে। এই কয়দিন ছিলাম না তো ভাল করে খেয়াল করিনি। আপনার কি এই সমস্যা দেখা দিচ্ছে?"
উনি হো হো করে হেসে বললেন, "ভয় পাও বুঝি?"
আমি বললাম, "ভয় না ঠিক তবে এত তেলাপোকা একসাথে দেখলে একটু শিড়শিড় করে তা মিথ্যে বলবো না।"
উনি বললো, "তবে যাই বলো, তেলাপোকা কিন্তু এক চমতকার জিনিস। আমি খুবই ইম্প্রেসড এটাকে নিয়ে। তুমি কি জানো আমি চীনে থাকতে রিসার্চ করেছি তেলাপোকা নিয়ে।"
আমার কেমন জানি ভয় করতে লাগলো, আমি বললাম, "জ্বী আমি তাহলে চলি
উনি বলতে লাগলেন আহা শোনোই না। এখানে আমি আসলে একটা তেলাপোকার ফার্ম তৈরীর চেষ্টায় আছি।"
কখন জানি উনি একটা মরা বাতি জ্বালিয়েছেন এবং আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়াতে আমি যা দেখতে থাকলাম তা দেখে আমার মাথা বন বন করে ঘুরতে লাগলো তা হলো, উনার শার্টের হাত বা পকেট থেকে গুটি কয়েক তেলাপোকা বের হয়ে আসতে লাগলো। আমি আজকে বুঝলাম সেই রহস্যময় তারগুলোর উতপত্তিস্থল কি। উনার শার্টের হাতা, প্যান্টের পকেট, পা এর কাছে, এমনকি কানের ফুঁটা দিয়ে যেনো অসংখ্য তেলাপোকা উঁকি মারছে।আমি উঠতে চাইলাম আবার।
উনি আবার বললেন এবার উনার রিসার্চের বিষয়বস্তু হলো তেলাপোকার খাদ্য এবং খাদ্য হিসেবে তেলাপোকা। ধীরে ধীরে উনি তেলাপোকার ডায়েট চেঞ্জ করছেন এবং বিভিন্ন রেসিপি ট্রাই করছেন।
আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে সব শুনছিলাম যেনো, উনি হাসতে হাসতে বললেন, "যা ভাবছো তাই ই আসলে। এতদিনের এই সুস্বাদু খাবার যা খেয়েছো তা আসলেই আমার রিসার্চের জন্য নানান এক্সপেরিমেন্ট। কিন্তু আমি এখন আরো বড় কিছু করতে চাই, এজন্য একটা ছোট এক্সপেরিমেন্ট করেছি। প্রথমে তেলাপোকাগুলোকে খাবার হিসেবে দিয়েছিলাম বিভিন্ন সবজী, এরপর ধীর ধীরে তাদের বিভিন্ন মাংস দিয়েছিলাম এবং প্রতিবার তোমাদের সবাইকে দিয়ে পরীক্ষাও করাচ্ছিলাম, তুমি ই বলো ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছিলো না স্বাদ?" আমি মাথা নাড়ানোর কথা ভুলে গেলাম।
উনি বলে চললেন, "তবে শেষ পর্যন্ত আরেকটা জিনিস ট্রাই করা বাকী ছিলো তাই ই করলাম। কয়েকটা তেলাপোকাকে একটু মাংস খেতে দিলাম এরপর তোমাকে দিলাম। বলো এইটাই সবচেয়ে ভালো ছিলো না আগের থেকে?"
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, "হু... উনি বললেন উত্তরে বলোতো কি মাংস ছিলো সেটা?" আমি কিছু বলার আগেই উনি উনার পা এর জুতোজোড়া খুলে ফেললেন। জূতো খোলার পর দেখলাম দুটো তেলাপোকা সর সর করে সরে গেলো। কিন্তু তার থেকে যা দেখে দৃষ্টি আঁটকে গেলো তা হলো উনার পা এর দু'টো আঙ্গুল নেই। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন, "কেঁটে ফেললাম। একটু তো ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়। তাই না? তবে পা এর মাংস খুব কম।"
আমি দূর্বল কন্ঠে বললাম, "এবার তাহলে যাই? উনি বললেন আহা প্ল্যানটা শোনোই না। এবারের প্ল্যান হলো মাংস একটু বেশি ই লাগবে কি বলো। মানুষের মাংসতে দেখি রেজাল্ট ভালোই হয়। কি বলো তাই না?"
আমার মুখ থেকে যেনো কথাই বের হচ্ছিলো না তাও সাহস নিয়ে বললাম, "মানুষের মাংস আপনি পাবেন কোথায় এতো?"
উনি মুচকি হেঁসে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলেন। আমি উঠে দাঁড়াতে ভুলে গেলাম। শুধু শুনতে পারলাম কিছু ছুটে আসছে চারপাশ থেকে এবং তা সংখ্যায় অনেক।
.
.
.
.
.
.
আজকে ফ্ল্যাটে বিশাল পার্টির আয়োজন করেছেন চীনদেশ ফেরত বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তার ঘর ভর্তি বিভিন্ন মানুষেরা। সবাই তার সুস্বাদু খাবারের প্রশংসা করছে আর রেসিপি জানতে চাচ্ছে। উনি মুচকি হেসে বলছেন, সিক্রেট সিক্রেট। সবাই উত্তরে হাসছে।
বাড়ির কেয়ারটেকার হঠাত বলে উঠলো, "আহা লিলি মেয়েটা যে কোথায় গেলো! এইসব গ্রাম থেকে আসা ছেলে-মেয়ে গুলো শহরে এসে কি কি যে করে বসে। মেয়েটাকে তো দেখতে ভালোই মনে হতো। হঠাত করে গায়েব হয়ে গেলো। কোথাও নেশা করে পড়ে আছে নাকি কে জানে।"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১:৩৩