চোখগুলো কী সুন্দর! আর নাক, একদমই আমার মত বোঁচা না। চুল, ঠোঁট সবই একেবারে যাকে বলে নিখুঁত। এখানে আমার আর কী করার আছে কিছুক্ষণ ধরে তাই চিন্তা করছি।
গত একমাস ধরে এমনটা হচ্ছে। হয়ত কেউ চুল কাঁটাতে এল। আমি বলে বসলাম, "আপা আপনাকে এভাবেই খুব সুন্দর লাগছে। চুল কাটালে হয়ত খারাপ লাগবে।"
"যেভাবে বলেছি সেভাবে করুন।" খুবই বিরক্ত হয়ে তারা উত্তর দেয়। কেউ কেউ প্রশংসা ভেবে খুশি হয়। কিন্তু আমার কথায় কান দেয় না।
এটা শুরু হয়েছে এবার বাড়ি থেকে এসে। রাঙ্গামাটির এক পাহাড়ি গ্রামে আমার বাড়ি। বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে জুম চাষ করার মত শক্তি আর অবশিষ্ট নেই ওদের। আর নানান আইন-কানুনের বেড়াজালে সেই সুযোগও কমে আসছে দ্রুত। তাই যখন ঢাকায় এই বিউটি পার্লারে কাজের সুযোগটা পেলাম, আর দেরি করিনি।
এবার বাসায় গিয়ে সব কিছু কেমন অচেনা ঠেকছিল। অনেক নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। অনেক নতুন নতুন মানুষ পথেঘাটে। কিন্তু আমি কেন জানি সবাইকেই চিনি বলে মনে হচ্ছিল। ঢাকায় প্রতিদিন এদের সাথে আমার দেখা হয়। বাসে ভীরের সুযোগে যে লোকটা শরীরে হাত দিয়েছিল, একদিন বাসায় ফিরতে দেরী হলে রাস্তার মোড়ে যে ছেলেগুলো আমার দু'শ টাকা দামের হাতঘড়িটা কেড়ে নিয়েছিল অথবা পাড়ার দোকানী যে ভেজাল ওষুধ বিক্রি করে তাদের প্রত্যেককে আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম আমারই বাড়ির আশেপাশে। এটা কি চোখের ভুল? হয়তবা। আমি জানি না। কিন্তু তাদের কাউকে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না, এটা সত্যি। আমার চির আপন, চির পরিচিত পাহাড়ের এই পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুতেই।
তারপর একদিন সূর্যোদয়ের সময় আমি যখন পাহাড়ের চুড়ায় বসে কাঁদছিলাম, কে যেন আমাকে বলল, "পরিবর্তন পাপ। এর চাইতে ধ্বংস উত্তম।" চেয়ে দেখি কেউ নেই আমার আশেপাশে। আমি কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
আমাদের গ্রামের সবচাইতে বয়স্ক যেই পুরোহিত, সে আমার কথা শুনে বলে আমি সূর্য-দেবতার সাক্ষাত পেয়েছিলাম। ওইদিনই আমি ঢাকায় ফিরে আসি। কিন্তু তারপর থেকে কোন কিছুর পরিবর্তনই আমি মেনে নিতে পারি না।
"এই যে, তাড়াতাড়ি করুন।" মেয়েটার কথায় আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আজ ওর গায়ে হলুদ। একটু পর পর ওর কাজিনরাও এসে তাড়া দিচ্ছে। পুরো প্যাকেজ অনুযায়ী আজকে ওকে সাজাতে হবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে ওর বাবা-মাও ওকে চিনতে না পারে।
কিন্তু পরিবর্তন তো পাপ। এর চাইতে ধ্বংস করে দেয়া ভাল। মুখে মাস্ক দিয়ে মেয়েটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওর পুরো শরীরে অনাগত জীবনের রোমাঞ্চ খেলা করছে। আমি 'FLAMMABLE*' লেবেল আঁটা বোতলটা তুলে নিলাম। এতে পেট্রোল জাতীয় কি যেন রয়েছে। আমি আগে শুকে দেখেছিলাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে। বোতলটা উপুর করে দিলাম মেয়েটার মাথায়, শরীরে। অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ে। প্রায় নিখুঁত। মোম জ্বালানোর বার্নারটা জ্বালিয়ে মেয়েটার মুখে ঠেসে ধরলাম।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল মেয়েটার পুরো শরীর। তার জান্তব আর্তনাদে সবাই দৌড়ে আসছে। কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। মেঝেতে কপাল ঠুকে গেলেও আমি হাসছি; পরিবর্তন এর চেয়ে ধ্বংস উত্তম! আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে চলেছে, "পরিবর্তন পাপ। পরিবর্তন পাপ। পরিবর্তন পাপ। পরিবর্তন পাপ। পরিবর্তন পা...."
আরও দু'টি গল্পঃ লোভী , ইচ্ছে পূরণ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৫:৩৮