somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা”

১৯ শে আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা”

-- তৌফির হাসান উর রাকিব



হুমায়ূন আহমেদ স্যার এর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৮ এর একুশে বইমেলায়! রৌদ্রদগ্ধ সেই তপ্ত দুপুরে কোনরকমে মুখে কিছু খাবার গুজেই দৌড়ে গিয়েছিলাম বইমেলায়। কারন আগেই খবর রটেছিল, আজ স্যার আসবেন। ভেবেছিলাম সবার আগে আগে গিয়ে অন্যপ্রকাশের সামনে গিয়ে বুক চিতিয়ে দাড়িয়ে থাকবো! কিন্তু কিসের কি? গিয়ে দেখি স্যার পৌঁছে গেছেন আমি যাওয়ার খানিক আগেই! আর অন্যপ্রকাশের সামনে লম্বা অজগরের মতো একখানা লাইনও ততক্ষনে দাড়িয়ে গেছে এই আগুনঝরা রোদ উপেক্ষা করে! হতবাক আমি সম্বিৎ ফিরে পেতে পেতে আরও কয়েকজনের পিছনে পরে গেলাম! ব্যাপারটা খেয়াল করতেই, তড়িঘড়ি করে লাইনে দাড়িয়ে পড়লাম। তারপর হালকা ধাক্কাধাক্কি আর রোদ-ধুলোর সাথে লড়াই করতে করতে কাছিমের গতিতে গোটা গোটা পায়ে এগিয়ে চললাম অন্যপ্রকাশের দিকে। মনে আছে, ঘাড় বাঁকিয়ে একটু পর পর স্যারকে দেখার চেষ্টা করছিলাম! যদি একবার চোখাচোখি হয়, যদি একবার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটু হাসি দেন! কিন্তু আমাকে আশাহত করে স্যার নিবিষ্টমনে অটোগ্রাফ দিয়ে চললেন, একটিবারের জন্যও মাথা তুলে তাকালেন না!
এভাবেই সময়ের সাথে সাথে অজগরের লেজের দিক থেকে আমি চলে এলাম অজগরের মাথার কাছে! ততক্ষনে কিনে নিয়েছি স্যার এর সদ্য প্রকাশিত দুটো বই। বই দুটো বগলদাবা করে একসময় পৌঁছে গেলাম একেবারে স্যার এর সামনে, হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যায় এমন দূরত্বে! বিস্ময় নিয়ে নয়নভরে দেখলাম স্যারকে, তারপরই মন্ত্রমুগ্ধের মত বাড়িয়ে দিলাম বইগুলো! অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত! এখনই স্যার আমার নাম জিজ্ঞেস করবেন, শুভেচ্ছা বার্তা লিখে সই করে দেবেন নিজের হাতে! আমি মনে হয় তখন উত্তেজনায় হালকা হালকা কাঁপছিও!
ঠিক তখন বলা নেই কওয়া নেই, আমার পিঠের উপর হঠাৎ করে যেন কেয়ামত নাযিল হল! কিছু বখাটে ছেলের লাইন ভেঙ্গে সামনে আসার চেষ্টার ফলেই যে এই আকস্মাত দুর্যোগের সৃষ্টি, সেটা আমি জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে! আমি তৎক্ষণাৎ একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সামনের দিকে। পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়েই, স্যারের মাথার সাথেই ঠুকে গেল আমার মাথা! লজ্জা অপমান আর ব্যথায়, দুচোখে তখন অন্ধকার দেখছি!
অন্ধকার খানিকটা কেটে যেতেই আবিষ্কার করলাম হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছি। আর স্যারের দুই ষণ্ডামার্কা পুলিশ দেহরক্ষী ঝুঁকে আছে আমার মুখের উপর! এদের দুজনার ভয়ংকর চাহনি দেখে আমার আবার অজ্ঞান হয়ে যেতে ইচ্ছে হল! কিন্তু ততক্ষনে ওরা আমায় ধরাধরি করে নিজের পায়ে দাড় করিয়ে দিয়েছে। শরীরের ধুলো ঝেড়ে খানিকটা ধাতস্ত হয়ে খেয়াল করলাম কপালে একধরনের চিনচিনে ব্যথা করছে। হাত দিয়ে বুঝলাম, সেখানে ইতিমধ্যে একটা উঁচু শিং গজিয়ে গেছে। দূর থেকে তাকিয়ে কেউ যদি তখন আমায় এক শিঙের ইউনিকর্ন ঘোড়া মনে করতো, তাকে আমি বিশেষ দোষ দিতে পারতাম না কিছুতেই!
আমার বিশ্ময়ের বুঝি তখনও অনেকটাই বাকি ছিল। তাকিয়ে দেখি, স্যার হাত নেড়ে আমায় ডাকছেন! আমাকেই কি? আশেপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম, নাহ আমাকেই ডাকা হচ্ছে। মাথা নিচু করে দুরু দুরু বুকে স্যারের কাছে গেলাম। একটু আগে যে ঘটনার জন্ম দিলাম, তারপরও মাথা উঁচু রাখার উপায় কি আর আছে?
আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন, ভিতরে এসো। আমি কিছুক্ষণ হতবিহব্বল হয়ে দাড়িয়ে থেকে, পা চালিয়ে দ্রুত স্টলের ভিতরে গেলাম। স্যার আমাকে ইশারায় তার পাশের টুলে বসতে বললেন। আর নিজে আবারো একমনে অটোগ্রাফ দিতে লাগলেন, যেন কিছুই হয় নি একটু আগে! ভাল করে তাকাতেই রীতিমত আঁতকে উঠলাম, স্যারের কপালের শিঙ, কোন মতেই আমার কপালের চেয়ে ছোট নয়! রক্ত জমে লাল হয়ে আছে, ফুলে আছে বা চোখের আশপাশটা! নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, কিন্তু এরমধ্যেও মানুষটা মুখে একটুকরো স্বভাবসুলভ হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে! আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে চরম বিশ্ময় নিয়ে বসে বসে তার অটোগ্রাফ দেয়া দেখতে লাগলাম!

একসময় স্যার যেন হাঁপিয়ে উঠলেন, উঠে দাড়িয়ে বললেন আজকের মত অটোগ্রাফ দেয়া শেষ। স্টলের সামনের দিক থেকে হালকা একটা অসন্তোষের গুঞ্জন ভেসে এলো। কিন্তু স্যার সেদিকে কান না দিয়ে হাতের ইশারায় আমাকে সাথে যেতে বলে হনহন করে হেটে স্টল থেকে বেড়িয়ে গেলেন। সাথে আঠার মত সেটে রইলাম আমি আর স্যারের দুই বডিগার্ড পুলিশ। আমাদের পিছনে পিছনে আসতে লাগলো বিচ্ছিন্ন জনতার একটি ছোটখাটো মিছিল। মেলা থেকে বেরিয়েই স্যার গাড়িতে উঠে গেলেন, আমি ভ্যাবলার মত গাড়ির পাশে দাড়িয়ে রইলাম।
স্যার রেগে বললেন, “সঙের মত দাড়িয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি ওঠো”। আমি সাথে সাথে বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। ভার্সিটি এলাকা পেরিয়ে আসার পর স্যার আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, “ব্যথা কি বেশি পেয়েছ? জোয়ান মানুষ এভাবে হুড়মুড় করে পরে বুঝি?” বলেই স্যার হা হা করে গাড়ি কাপিয়ে হাসতে লাগলেন।
আমি লজ্জা-সঙ্কোচে এতটুকু হয়ে গেলাম। চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারলাম না!

স্যার হাসি থামিয়ে বললেন, বইগুলো কি হারিয়ে গেছে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, জি স্যার।
স্যার আবার হা হা করে হাসতে লাগলেন, মনে হয় আমার চিৎপটাং হয়ে পরে থাকা এখনও স্যারের চোখে ভাসছে!
তারপর গাড়ির পিছন দিকটায় হাত বাড়িয়ে কয়েকটি বই নিলেন। চেয়ে দেখি, সবগুলোই এবার মেলায় আসা স্যারের নতুন বই।
মৃদুস্বরে বললেন, নাম কি তোমার?
আমি তারচেয়েও ক্ষীণস্বরে আমার নাম বললাম।
স্যার পরপর চারটি বইয়ে আমার নাম করে শুভেচ্ছা বার্তা লিখে অটোগ্রাফ দিলেন। তারপর পঞ্চম বইটি হাতে নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা একটি প্রেমের বই? এটা কি তোমার বিশেষ কাউকে দিতে চাও?
আমি লজ্জায় আক্ষরিক অর্থেই লাল হয়ে গেলাম। অনেক চেষ্টার পর কোনমতে তার নামটা উচ্চারণ করতে পারলাম।
স্যার মৃদু হেসে, বইটিতে অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন।
ড্রাইভারের কাছ থেকে একটা পাটের ব্যাগ চেয়ে নিয়ে নিজেই সবগুলো বই তাতে ঢুকিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি কম্পিত হাতে গ্রহন করলাম সেই অমূল্য উপহার!
তারপর জিজ্ঞেস করলেন আমাকে কোথায় নামিয়ে দিলে আমার সুবিধা হবে। আমি কোনকিছু না ভেবেই বললাম, এখানেই নামিয়ে দেন স্যার।
কথাটা কেন বললাম, নিজেও জানিনা! আরও কিছুক্ষণ স্যারের সাথে থাকার সুযোগ কেন আমি হাতছাড়া করলাম? মনে হয় চরম সেই আনন্দ আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না! চরম আনন্দ অথবা চরম দুঃখে, মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়!

স্যার আমাকে সেখানেই নামিয়ে দিলেন। নামার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রশান্তির একটা শিহরণ যেন ছড়িয়ে পড়েছিল আমার দেহের প্রতিটি কোষে কোষে!

যতক্ষণ স্যার এর গাড়ি দেখা গেল, আমি নিস্পলক সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। একসময় দৃষ্টিপথ থেকে হারিয়ে গেল স্যারের গাড়ির শেষ আবছা ছায়াটুকুও। আমার হাতে ধরা তখন স্যারের দেয়া সেই পাঁচটি বই। প্রাণভরে একবার বইগুলোর গন্ধ নিলাম, আর মৃদুস্বরে বললাম, ভালবাসি স্যার, বড় বেশি ভালবাসি!


((( উপরের লেখাটা পুরোটাই কাল্পনিক। এই মহান মানুষটির সাথে আমার কখনোই দেখা হয়নি। তাহলে কেন লিখলাম এমন একটা লেখা? কারন কি?
আজকাল পত্রিকায় অনেকেই স্যারের সাথে তাদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেন। সেগুলো পড়তে পড়তে বুকের অনেক গভীরে কোথায় যেন চিনচিন করে ওঠে। অনুভব করি, তাদের কারো চেয়ে আমি স্যারকে কম ভালবাসিনা! বারবার নিজেকে অভিশাপ দেই, কেন আমি অন্তত একটিবার স্যার এর সাথে দেখা করার চেষ্টা করিনি! সেই সুযোগ যেহেতু এখন আর নেই, এই লেখাটা তাই নিজের সাথে আরও একটিবার প্রতারণা করা। এই লেখাটা স্যারের প্রতি আমার অসীম ভালবাসায়, আমার নিজেরই অবগাহন! আপনাকে অনেক বেশি ভালবাসি স্যার! কখনও বাঁধভাঙ্গা জোছনায়, কখনও অঝোর শ্রাবণে, আমি আপনাকে খুজবই স্যার...... যতদিন বেঁচে থাকি...... কথা দিলাম! )))

৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×