somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুই হাজার নতুন বইয়ের দুই লাখ অবিক্রিত কপি ছাপানোর চাইতে দুইশোটি মনের আনন্দে পড়ার মতো নতুন বইয়ের লাখ খানেক বিক্রিত বই এর কপি চাই।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে নব্বই এর দশক অবশ্য নব্বই এর দশক বলতে কাগজে কলমে ৮১ থেকে ৮৯ হলেও আবলে ৯০ থেকেই বোঝাচ্ছি। মনে আছে, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বারান্দায় দাড়িয়ে পুলিশ মানুষের ধাওয়া পাল্‌টা ধাওয়া দেখতাম। বিকাল পাচটায় বিটিভির বিনোদন আর খেলা বাদে একমাত্র বিনোদন ছিলো বই। কোন এক জন্মদিনে খুকি আপুর দেয়া ছোটদের গল্প সংকলনের একটা গল্প শেষ করতে পারলে দাগ দিয়ে রাখতাম।আর ভাবতাম নিশ্চয়ই পুরো বইটি শেষ করতে করতে বড় হয়ে যাবো! এ সময়ে প্রগতি প্রকাশনীর মালাকাইটের ঝাপি বইটির মলাট এখনও চোখে জ্বলজ্বল করে। একটু বড় হয়ে যাবার পর বইমেলা নামের একটি মেলায় বাবা নিয়ে যেতো। কি প্রবল আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতাম মেলায় যাবার দিনটিতে। বইমেলা থেকে কিনেছিলাম জীবনের সবচেয়ে সেরা বই (আমার কাছে সেরা আর কি) "সেরা সত্যজিত"। প্রতি বইমেলায় আব্বু যে কয়টা ইচ্ছা বই কিনো বললেও মধ্যবিত্ত বাবার কাছ থেকে তিনটি বা চারটির বেশী কেনার আব্দার করতাম না। আর একটু বড় হয়ে যাবার পর নিজে একা বই মেলায় যেতাম। প্রতি ফেব্রুয়ারীতে অন্তত দশবার মেলায় না গিয়ে ভাত হজম হতো না। আগের দুই তিনমাস টাকা জমিয়ে আম্মুর কাছ থেকে পাচশো টাকা নিয়ে হাজার খানেক টাকার বই কিনে ফেলতাম। তার পরও সাধমিঠতো না। অনেক কে চোখের সামনে হাজার হাজার টাকার বই নিয়ে যেতে দেখে আফসোস লাগতো। জীবনের প্রথম ইনকামের বছর প্রথম বই মেলায় মনের সাধ মিটিয়ে দুই ভাই মিলে হাজার পাচেক টাকার বই কিনে ফেলেছিলাম তার মধ্যে মনে পড়ছে, সত্যজিত সমগ্র, হুমায়ুন আজাদের একটা সমগ্র, আর আবদুল্লাহ আবু সাইদের বিবলিওগ্রাফি।

এসব তো গেলো আমার অভিজ্ঞতা, আমার ধারণা আমার সমকালীন প্রায় সবারই (যাদের বই পড়বার নেশা ছিলো, এ রকমই অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবার আসি আরেক অভিজ্ঞতায়। স্কুল জীবনে ফেব্রুয়ারীতে কেনা চারটি বই য়ে যে সপ্তাহ যেতোনা বলাই বাহুল্য। ছেলেবেলার বন্ধু সাকিব কে নিয়ে বাসা থেকে বেশ দূরে একটি লাইব্রেরীর সন্ধান পাই। যারা বই ভাড়া দেয়, বিশেষ করে সেবা প্রকাশনীর বই্। মাস খানেক ধরে টিফিনের টাকা যোগাড় করে কুড়ি টাকা জমা দিয়ে দুজন মিলে একটি নামে নাম লিখাই। আর দুই টাকা দিয়ে একটা করে বই ভাড়া এনে ভাগ করে পড়ে ফেলি, একদিন সাকিব, পরদিন আমি। আর ছোট বই হলে সকালে সাকিব, দুপুরে আমি। এর মধ্যে প্রধানত তিন গোয়েন্দা পড়া হলেও একটা দুটো করে আস্তে আস্তে পড়ার সিলেবাস দখল করে ফেলে সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ণ আর বিশেষ করে কিশোর ক্লাসিক। সেবার কিশোর ক্লাসিক দিয়ে বিশ্বসাহিত্যের হাতেখড়ি হয়। ওয়ালটার স্কট, জুলভার্ণ, মার্ক টোয়েনের মতো সাহিত্যিকদের সাথে পরিচিত করবার জন্যে এখনও সেবা প্রকাশনীর নাম শুনলে মাথা নুয়ে পড়ে। হুমায়ুন আহমদ, জাফরইকবালদের বই হটকেক হলেও কেনার সামর্থ ছিলো না দেখে পাড়ার কোন বড় ভাইয়া/আপু কিনলে একদিনের জন্য ধার নিয়ে এনেই পড়তে হতো। ঐ দোকানটা এইসব দামী বই রাখতোও না। মাধ্যমিকের কাছাকাছি সময়ে এসে পরিচয় হয়, সুনীল/শীর্ষেন্দুদের সাথে। সুনীলের সূদুর ঝর্ণার জলে শুধু নিজেই পড়ি নি বরং পরে অনেক বছর কোন প্রিয়জনকে গিফট দেবার সময় এই বইটিই আগে রাখতাম।

২০০০ সালের পর থেকে কেমন যেন সব একটু ওলট পালট হয়ে গেলো। বোধ হয় প্রিন্ট প্রযুক্তির কোন এক অসাধারণ বিপ্লবের জন্যে বই প্রকাশ বেশ সহজ হয়ে উঠলো। মাত্র বছর দশেক আগেও যখন দু পাতার একটি মাসিক পত্রিকা ছাপার জন্যে সাংবাদিক চাচাতো ভাইটিকে দুই সপ্তাহ প্রেসে পড়ে থাকতে দেখেছি, বছর দশক পরের সময়ে একটি পান্ডুলিপি দিলে দিন দুয়েক পরই ঝকঝকে বিশাল বই হয়ে বের হয়ে আসে। ফলে প্রকাশনা ব্যবসা হঠাৎ করেই সহজ হয়ে ওঠে। টাক মাথার বয়স্ক প্রকাশকের জায়গা দখল করে ফেলেন অল্প বয়সী প্রেসের বয়। লেখকেরা প্রকাশকে মাসের পর মাস তেল দিতে দিতে হয়রান হয়ে হাল ছেড়ে দিতে, এই সময়ে দেখা গেলো নতুন প্রকাশককে বইয়ের খরচ টা দিয়ে দিলেই বই ছেপে দেন। ফলে ছাপা হওয়া বইয়ের লেখকের সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যায়। বইমেলায় ঘুরতে গেলেই প্রায় প্রত্যেকেরই কয়েকজন করে পরিচিত বের হয়ে যায় লাজুক মুখে জানান তার এতোটা বই ছাপা হয়েছে। ও আচ্ছা তোমার বই, তাহলে তো একটা কিনতেই হয়- এই কোটায় তার কয়টা বই বিক্রি হয়ে যায়।


প্রকাশনা সহজীকরণের বিপ্লবে বই শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবণা আপাত দৃষ্টিতে থাকলেও বইয়ের ব্যবসা ব্যপক ধস খায়। মিডিয়ার আগ্রাসনে মানুষের পড়ার অভ্যাস ভয়ঙ্করভাবে কমে যাওয়ার পাশাপাশি ছাপা বইয়ের সংখ্যাধিক্যে বইয়ের দিক থেকেই মুখ থুবড়ে পড়ে মানুষের। আমার জানা মতে ২০০৪/৫ এর পর থেকে কোন বইমেলায়ই প্রকাশ হওয়া বইয়ের সংখ্যা দুই হাজারের কম না! মানুষ কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই হুমায়ুন আহমদ, জাফর ইকবাল, সত্যজিৎ রায়ের মতো লেখকদের বই ই কিনছে।


" চটি বই লিখে হুমায়ুন আহমদ বিখ্যাত হয়ে গেলো আর আমি পারুম না" বলে ভাতিজাও বই ছাপিয়ে ফেলে ছয়টি, তার এই বইগুলো বিক্রির জন্যে আবার চাচা কে বইমেলার ভিড়ে দাড়িয়ে পাবলিসিটি করতে হয়। দুই হুয়ায়ুনের মৃত্যুর পরও পাজলিং য়ের মতো এই বইয়ের সাথে ওই বই মিলিয়ে এই সমগ্র, সেই সমগ্র করে ছাপা বইগুলো এখনও বেস্ট সেলার হয়। সরকার দলের বিশাল চামচায় নিজেকে হাস্যকর ভাবে বারবার প্রমাণ করায় চেস্টায় রত জাফর ইকবালের লেখা কলামের বিশাল বিশাল সমালোচনা করবার পরও বইমেলায় গিয়ে সবার আগে জাফর ইকবালের বইটাই কেনায় মনোযোগ দেয় পাঠক। নীলক্ষেত প্রিন্ট দেখবার পরও সুনীলের সেবারই সময়, প্রথম আলো কেনার লোভ সামলানো যায় না।

লেখা আর লেখার স্টাইল প্রথমত প্রকৃতি প্রদত্ত, দ্বিতীয়ত অনেকে সেটা তপস্যা করে অর্জন করেন। এটা পাবলিসিটি করে বেচবার কোন বিষয় না। এ সময়ে সব ভি আই পি পাঠকরাই বলা শুরু করলেন হরিশংকর জলদাসের লেখা বইগুলো তাদের প্রিয়। প্রশংসা শুনে আগ্রহভরে তার বইগুলো পড়ে অনেকেরই মনে হলো, ফ্রিস্টাইলে গ্রামীন গালাগাল লেখবার জন্যে ভদ্রলোক অসাধারণ দক্ষ (কোন কোন পাঠকের মনে হতেই পারে)। সুতরাং এতো ভি আই পি দের সার্টিফিকেট নিয়েও কিন্তু বেস্টসেলারের খাতায় তার নাম উঠে না। বরং ওঠে হুমায়ুন আহমদের নাম। লেখা পড়ে বই ভালোবাসা এমন এক জিনিস, যা অন্য কেউ আপনাকে প্রভাবিত করতে পারবে না, লেখাই আপনাকে প্রভাবিত করে- সেটা বই ঝকঝকে ছাপার ওপরও নির্ভর করে না। প্রসঙ্গত আর এক জনের কথা মনে পড়ছে, যিনি শুধুমাত্র চার পাচ লাইন জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিয়েই অনলাইন জগতে প্রচন্ড বিখ্যাত হয়ে গেছেন। তার লেখার পাবলিসিটি কেউ করে নাই। তিনি নিজেও কিন্তু কোন অ্যাডভার্টাইজ করেন নাই। তার অসাধারণ প্রাকৃতিক লেখনী থেকেই জনপ্রিয়তা এসেছে তার। বর্তমানে প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে হাজার হাজার লেখার পাশাপাশি বই মেলার হাজার হাজার বই থেকে বই খুজে বের করা কিন্তু এক অর্থে নব্বই দশকের মতোই সহজ কাজ বেশীরভাগ পাঠকের জন্যে। তবে সেই সাথে দুঃখ কিছু প্রতিভাবান লেখকদের জন্যে, যাদের ভালো লেখা এইসব হাজার হাজার বইয়ের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে।

বই লেখা সহজ হয়ে গেছে, বই ছাপাও সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু কয়টি লেখা আজ থেকে চারশো বছর পর মানুষ পড়বে? আমরা তো চারশো বছর আগের লেখা ওয়াল্টার স্কটের লেখা মনের আনন্দে পড়েছি, চারশো বছর পর পরে আনন্দ নিয়ে কি পড়বে, তখনও দেখা যাবে হুমায়ুন আহমদের বইটিই বেচে আছে।


কাজেই বইমেলায় দুই হাজার নতুন বইয়ের দুই লাখ অবিক্রিত কপি ছাপানোর চাইতে এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় না, যাতে দুইশোটি মনের আনন্দে পড়ার নতুন বইয়ের লাখ খানেক বিক্রিত বই ছাপানো যায়।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×