somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুভি রিভিউ - জেড (Z) - অসাধারণ একটা পলিটিক্যাল থ্রিলার

৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পরিচালক কোঁস্তা-গাভরাসের মুভি প্রথমে দেখেছিলাম বছর দেড়েক আগে, মিসিং। চিলির সামরিক অভ্যুত্থানের উপর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত অসাধারণ একটা মুভি। এরপর আইএমডিবিতে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম এই পরিচালকের সবচেয়ে বেশি রেটিং পাওয়া মুভি হচ্ছে Z (1969)। আইএমডিবি রেটিং 8.2, কিন্তু ফ্রেঞ্চ ভাষায় নির্মিত ছবিটির ভোটসংখ্যা কম হওয়ায় আইডিবির নিয়ম অনুযায়ী এটা টপলিস্টে উঠতে পারেনি। যাইহোক, খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য এই মুভিটি মিডিয়া ফায়ারে তো পেলামই না, টরেন্টেও ৭০০ মেগার যেই লিংকটা পেলাম সেটার সীড একেবারেই কম। কাজেই ডাউনলোড করা হল না। লিবিয়া যুদ্ধে দীর্ঘ আট মাস ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পর বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় এসে যখন ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দিল, তখন আবার নতুন করে সার্চ দিলাম। এবার পেয়ে গেলাম বেশ ভালো সীড সহ একটা লিংক, সাইজ দেড় গিগা। ত্রিপলীতে ছয়মাস ফ্রি এবং আনলিমিটেড থাকার পর গত মাস থেকে লিমিটেড করে দিলেও সিরতে এখনও এডিএসএল ফ্রি এবং আনলিমিটেড। কাজেই সাইজের চিন্তা না করে ঝটপট ডাউনলোড করে ফেললাম।

মুভিটি দেখতে বসে একেবারে প্রথমেই একটু নড়ে চড়ে বসতে হল। কারণ সাধারণত অধিকাংশ মুভির শুরুতে লেখা থাকে, এর সব চরিত্র কাল্পনিক, কারো সাথে মিলে গিলে তা নিছক কাকতালীয়। কিন্তু এই প্রথম একটা মুভি দেখলাম যার শুরুতে একেবারে বড় হাতের অক্ষরে লেখা, কারো সাথে মিলে গেলে সেটা INTENTIONAL অর্থাত্‍ ইচ্ছাকৃত। বুঝে গেলাম ঠিক এই রকম একটা মুভিই খুঁজছিলাম এতোদিন। কোঁস্তা-গাভরাসের পরিচালনার স্টাইল একেবারেই সিম্পল, ডকুমেন্টারি টাইপের। কিন্তু তার মুভির সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে, তার কাহিনীগুলো অসাধারণ। জেডেও তাই। প্রথম বিশ-পঁচিশ মিনিট খুব একটা আহামরি মনে না হলেও কাহিনী যত এগোতে থাকে, ততই স্ক্রীণ থেকে চোখ সরানো কঠিন হয়ে পড়ে।

মুভির কাহিনী গ্রীসের সরকার কর্তৃক এক রাজনীতিবিদের হত্যা এবং তার পরবর্তী তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে। ফ্যাসিবাদী সরকারের অস্ত্র এবং পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে র‌্যালির আয়োজন করায় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাতে বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে র‌্যালি আয়োজনকারী গণতন্ত্রপন্থী জনপ্রিয় নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পুলিশ কমিশনার এবং পুলিশের প্রধানের আয়োজনে এবং পুলিশ বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গোপন সংগঠনের সদস্যদের লেলিয়ে দিয়ে সেই নেতাকে মিছিলের মধ্যে হত্যা করা হয়। পুলিশ রিপোর্টে এবং সরকারী মিডিয়াগুলোতে এটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া এবং মিছিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিরোধী দলটির র‌্যালি আয়োজনকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হতে থাকলে ঘটনা তদন্তের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তদন্তে একের পর এক গোপন ষড়যন্ত্রগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এক সাংবাদিকের সহায়তায় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সাহসী তদন্তে সত্য বেরিয়ে আসতে থাকে। পুলিশের পক্ষ থেকে তো বটেই, এমনকি অ্যাটর্নী জেনারেল এবং স্বয়ং মন্ত্রীও পুলিশ এবং সরকারকে বাঁচানোর জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে বিভিন্নভাবে প্রভিবিত করার চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু সত্‍ এবং সাহসী ম্যাজিস্ট্রেট শেষ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং পুলিশ প্রধান সহ ঘটনার সাথে জড়িত সবাইকে হত্যা এবং হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করে।

কিন্তু এতো কিছু করেও শেষ রক্ষা হয় না। নোংরা রাজনীতির আড়ালে হারিয়ে যায় সকল প্রচেষ্টা। সরকারকে যদিও পদত্যাগ করতে হয়, কিন্তু ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। বিভিন্ন সাক্ষী এবং বিরোধীদলের নেতারা রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে থাকে, হত্যাকারীদের স্বল্প সাজা হয়, সরকারী কর্মকর্তারা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, এবং সর্বোপরি নিষিদ্ধ হয় সকল গণতান্ত্রিক কর্মকান্ড। সিনেমার একেবারে শেষে সেনাবাহিনী কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কর্মকান্ডের একটা তালিকা দেয়। সেই তালিকায় আছে লম্বা চুল, মিনি স্কার্ট, রাশিয়ান টোস্ট, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, টলস্টয়, দস্তভয়স্কি, মিছিল-মিটিং, নতুন গণিত এবং অক্ষর "Z"। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় Z তথা Zi এর অর্থ হল তিনি বেঁচে আছে। খুন হওয়া নেতার সমর্থকরা তাদের নেতার অমরত্বকে এই Z দ্বারা প্রকাশ করত। সিনেমাটার নামও তাই এই Z। উল্লেখ্য, এই সিনেমাটি এবং জার্মান সিনেমা M পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট নামের মুভি।

অসাধারণ এই সিনেমাটার বিভিন্ন ঘটনা এবং দৃশ্য দেখতে গিয়ে বারবার বাংলাদেশের রাজনীতির কথাই মনে হয়। সবচেয়ে হতাশ লাগে, গ্রীসে তবুও একজন সত্‍ ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, যে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেও সুষ্ঠুভাবে তদন্ত শেষ করে সত্যিকার দোষীদেরকে সাব্যস্ত করেছিল। কিন্তু আমাদের দেশে কি সেরকম কেউ আছে? যদি থাকে তাহলে কেন আমাদের তদন্ত রিপোর্ট গুলো প্রকাশিত হয় না? কেন কোন রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার হয় না, দোষীদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না?

কোঁস্তা-গাভরাস যখন এই মুভিটা বানিয়েছেন, তখনও গ্রীসে সামরিক শাসন। নিজ দেশে বানানো সম্ভব না, তাই তিনি এটা বানিয়েছেন আলজেরিয়ায়। মুভির প্রযোজকও আলজেরিয়ান। আর তাই এটা সেরা বিদেশী ছবি হিসেবে যে অস্কার পেয়েছে, সেটাকে আলজেরিয়ার প্রথম অস্কার হিসেবে ধরা হয়। এই মুভিটাই প্রথম মুভি যেটা একই সাথে বেস্ট পিকচার এবং বেস্টা পিকচার ইন ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্যাটাগরিতে অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল।

কোঁস্তা গাভরাসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কেন এই মুভিটা বানিয়েছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রথমত আমি একজন গ্রীক। আর দ্বিতীয়ত, মানুষ অনেক কিছু করে। কেউ মিছিলে যায়, কেউ পিটিশনে সাইন করে, আমি নাহয় ফিল্মই বানালাম। দুঃখের বিষয় আমাদের পরিচালকরা এই বিষয়টা বুঝল না!

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ রাত ১১:৫২
১১টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×