ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম ধর্মীয় বিভেদ এবং ক্ষতের নাম বাবরি মসজিদ। বাবরি মসজিদ সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত হলেও এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশ আমলে একদল হিন্দু জিগির তুলে যে মসজিদের জায়গায় রামের জন্মভুমি ছিল এবং সেখানে মন্দিরও ছিল। আর সেই মন্দির ভেঙ্গেই নাকি মসজিদ হয়েছিল। সেই থেকে আস্তে আস্তে এই বাবরি মসজিদ ইস্যুতে ভারতের ধর্মীয় রাজনীতি উত্তপ্ত হতে থাকে। একটা সময় এই মসজিদই হয়ে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক রাজনিতিকদের ক্ষমতা যাওয়ার সিড়ি। বাবরি মসজিদের জল অনেক দূর গড়ালেও বাবরি মসজিদের উপর সব চেয়ে বড় হামলাটি আসে ১৯৯২ সালে।
সেই বছর বিজেপি শীর্ষ নেতাদের মদদেও আরএসএস , ভিএইচপি কর্মীদের কে নিয় লাল কৃষ্ণ আদভানি বাবরি মসজিদ মুখী মার্চ করে এবং তারা মসজিদের মুল ফটকে ঢুকে মসজিদ গুড়িয়ে দেয়। যদিও মসজিদটি ১৯৪৯ সালের পর থেকে বন্ধ ছিল আর সেই সালে মুসলিমরা সর্বশেষ মসজিদটিতে নামাজ পড়তে পেরেছিল। ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে পুরো ভারত বর্ষ মুহূর্তেই তেতে উঠে। সে সময় পুরো ভারত ব্যাপী হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেই দাঙ্গা ভারত জুড়ে প্রায় ২০০০ মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য ঘর বাড়ি, দোকান এবং স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলে যার বেশির ভাগই মুসলিম এবং মুসলিমদের ছিল।
সেই দাঙ্গার তপ্ত আগুন বাংলাদেশ, পাকিস্থান এবং মিডল ইস্টে পৌঁছে যায়। সেই দাঙ্গার আগুনে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই দাঙ্গার রেশে প্রায় বাংলাদেশে ১০ জনের মত নিহত হয়। ১৯৯২ সালের সেই দাঙ্গার পরে বিজেপি নতুন শক্তিতে উজ্জেবিত হয়ে মোটামুটি ভোট পার করার একটা পথ পেয়ে যায়। বাবরি মসজিদ ইস্যুতে অবশেষে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় প্রদান করে। রায়ে নিম্নের পয়েন্ট গুলো জানা যায়।
১) বাবরি মসজিদের নিচে কোন মন্দির বা ধর্মীয় স্থাপনা পাওয়ার যথাযোগ্য কোন প্রমাণ নেই
২) তবে বাবরি মসজিদ একেবারে খালি জায়গাও বানানো হয় নি সেটার নিচে স্থাপনার ধংশাবশেষ পাওয়া গিয়েছে তবে সেটা ইসলামিক বা হিন্দু ধর্মীয়ও না। সাধারন স্থাপনা থাকতে পারে।
৩) শুধু মাত্র বিশ্বাসের উপর ভর করে কাওকে বঞ্চিত করা যায় না।
৪) মসজিদ ভাঙ্গা সম্পূর্ণ আইন বিরোধী কাজ ছিল
৫) সুন্নি ওয়াকপ বোর্ড জমির সম্পূর্ণ মালিকানা দেখাতে পারে নাই।
৬) মসজিদের বিতর্কিত জায়গা সরকারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে রাম মন্দির নির্মান করা যাবে।
৭) মুসলিমদের কে মসজিদ বানানোর জন্য অযোধ্যা ৫ একর জায়গা বরাদ্দ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মোটামুটি এই ছিল রায়ের পর্যবেক্ষণ বা অবস্থান। এই রায়কে কেন্দ্র করে ভারতের অনেক গুলো রাজ্য ইস্কুল কলেজ বন্ধ এবং উত্তর প্রদেশে ১৪৪ ধারা জারি করে রাখা হয়েছে।
উক্ত রায় সুন্নি ওয়াকপ বোর্ড মেনে নিয়েছে এবং তারা হাইকোর্টের রায় কে মেনে চলবে বলে জানিয়েছে। উক্ত রায় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে মুসলিমদের মধ্য।
তবে রায় থেকে এতটুকু বলা যায়, এত দিন আরএসএস এবং বিজেপি যেই ধরনের প্রচারণা চালিয়েছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেটাতে কিছুটা টান পড়বে। বিজেপি এবং আরএসএস এর প্রপাগান্ডা সেল গুলো এতদিন প্রচারণা চালিয়েছে যে, মুসলিমরা মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানিয়েছে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
এই রায়টি আসলে একধরনের সমজতা রায় বলে মনে হচ্ছে কারন হিন্দু মন্দিরের কোন প্রমাণ নেই আবার ওয়াকপ বোর্ড জমির মালিকানা প্রমানে ব্যার্থ। সংখ্যাগুরুর সেন্টিমেন্ট কাজ করেছে স্পষ্ট ভাবে রায়ের উপর। আর মুসলিমদের সান্তনা হিসেবে ৫ একর জমি অযোধ্যার কোন ভাল জায়গায় দিয়ে শান্ত রাখা হচ্ছে। যাইহোক ভারতের মুসলিমরা মেনে নিয়ে যদি শান্তি বজায় রাখতে পারে সেটাই কাম্য। আর ভারতের বিষয়ের কারনে আমাদের দেশে যেন কেউ হেইট ক্রাইমের শিকার না হয় সেটা আমাদের সবার কাম্য।
কারেকশন: সুন্নি ওয়াকপ বোর্ড রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং তারা জানিয়েছে তারা সম্পূর্ণ রায় পড়ে পরবর্তী করনীয় ঠিক করবে। তাদের আইনজীবী জানিয়েছে এটা এক টুকরো জমির মালিকানার বিষয় নয় এটা আগামী ভারতে মুসলিমদের অবস্থান বা অস্ত্বিত রক্ষার বিষয় এবং আগত দিনে মুসলিম স্থাপত্য বাচিয়ে রাখার সংগ্রাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৯