২
সেই থেকে শুরু । দশ বছরে বাবা প্রায় ত্রিশ লাখ টাকার মালিক হয়ে গেলেন। সুদের কারবারে সাধারণত যা হয়। আসল শোধ দিতে পারলেও সুদ থাকে। যদি সুদ শোধ হয় তো আসল থাকে। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছালেও নির্বংশের ব্যাটা। খাতকদের কাউকেই ছ’মাসের বেশি সময় বাবা দিতেন না। এর ভেতর আসলসহ সুদের টাকা শোধ না হলে বন্ধকী সম্পত্তি কিংবা গয়না বাজেয়াপ্ত হতো। নিয়মানুযায়ী সুদসহ আসল কেটে রেখে সম্পত্তি বা গয়না বিক্রির উদ্বৃত্ত টাকা খাতককে দেওয়ার কথা। বাবা দিতেন না। বিশেষ করে, অসহায় বিধবা, এতিম অথবা অন্য জেলার লোকদের বেলায়। তার পোষা কিছু গুন্ডাপান্ডা ছিল। কেউ প্রতিবাদ করতে এলে তাদেরকে এরা ভাগিয়ে দিত।
৩
বাবা যখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন, দুটি বাড়ি কেনার পর তিন নম্বর বাড়ির বায়না করবেন বিপদ ঘটল ঠিক তখন। পৌষ মাসের এক মেঘলা দিনে সন্ধেবেলা অশীতিপর এক বৃদ্ধা রিকশা থেকে তার দোকানের সামনে নামল। মহিলা কালীঘাটে পুরোনো এক বাড়িতে থাকে। দুটো বালা বন্ধক রেখে টাকা ধার করতে চায়। বালা দুটো হাতে নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করলেন বাবা। পুরোনো জিনিস। আদ্যিকালের ডিজাইন। তবে জিনিস ভারী। দুটোতে কম করে হলেও পাঁচ ভরি সোনা আছে। বর্তমান বাজারদরে ওগুলোর দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা হওয়ার কথা। বাবা বললেন,
‘ওগুলো রেখে পাঁচশো টাকা নিয়ে যান। ছ’মাসের ভেতর সাতশো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বালা ফেরত নিয়ে যাবেন। দেনা পরিশোধ করতে না পারলে মাল বাজেয়াপ্ত হবে।’
বুড়ি কাগজে টিপ সই দিয়ে টাকা, রশিদ নিয়ে কালীঘাটে ফিরে গেল। ছ’মাস পার হলো। বুড়ির দেখা নেই। বাবা বালা দুটো বাসায় এনে তার শোবার ঘরে সিন্দুকে রেখে দিলেন। তখন ১৯৭৫ সাল। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া জাতীয় গণতান্ত্রিক দল বা জাগ দল নামে নতুন দল গঠন করেছেন। সেই দলের উঠতি নেতাদের সাংঘাতিক দাপট। এইরকম এক নেতা যার নাম মোটা মোসলেম বাবাকে বলল দোকান ছেড়ে দেওয়ার জন্য। মাড়োয়ারির ওই দোকান অর্পিত সম্পত্তি। ভেস্টেড প্রপার্টি। সরকারের কাছ থেকে নিরানব্বই বছরের লিজ নিয়েছে সে। কাগজপত্র আপটুডেট। বাবা বললেন, দোকান তার দখলে। আগের মালিকের কাছ থেকে তিনি কিনে নিয়েছেন। কাগজপত্র তারও আছে। বাবা যেমন বুনো ওল নেতাও তেমন বাঘা তেঁতুল। গন্ডগোল চরমে উঠল। নেতা বুঝল হুমকি-ধামকিতে কাজ হবে না। সে ধরল অন্য রাস্তা । থানার ওসিকে হাত করে দুটো মার্ডার কেসে বাবার নাম ঢুকিয়ে দিল। এর একটিতে তার পোষা গুন্ডাপান্ডার একজনকে বানাল রাজসাক্ষী। ভালো রকমের জটিল মামলা। টুটপাড়ার এক হিন্দু বিধবার নাতি খুন হয়েছিল। পুরোপুরি বখে যাওয়া এই নাতির বাবা-মা থাকত কলকাতায়। বিরাট বাড়িতে দিদিমা একা। কলকাতার ছোট্ট খুপরি বাসায় দাদিমার দম বন্ধ হয়ে আসে। নাতির কাজ কলেজে পড়াশুনো করা, দিদিমাকে দেখে রাখা। এই দুটোর কোনোটাতেই তার আগ্রহ ছিল না। তার সব আগ্রহ জুয়া, মদ, বাজে মেয়েমানুষে। দাদির গয়নাপাতি বন্ধক রেখে বাবার কাছ থেকে প্রায়ই টাকা ধার নিত নাতি। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা গেল, প্রায় বিশ হাজার টাকার গয়না বন্ধক রেখে বাবা তাকে দিয়েছেন মাত্র দুহাজার। খুনের মোটিভ ‘পরিষ্কার’।
বাবার ঠাঁই হলো জেলহাজতে। কেস চলল মাসের পর মাস। থানা, পুলিশ, কোর্ট-কাছারি, উকিল-মোক্তার করতে গিয়ে টাকা খরচ হতে লাগল হু হু করে। সুদখোরকে কেউ পছন্দ করে না। আমরা কারও সহানুভূতি পেলাম না। যেখানে পাঁচশোতে কাজ হওয়ার কথা, সেখানে দিতে হয় হাজার টাকা। ক্যাশ যা ছিল গেল। এরপর গেল জমিজমা, বাড়িঘর। বাবা হাজত থেকে আর বেরোতে পারলেন না। সাজানো মামলায় ফাঁকফোকর কম। উকিল সাহেব প্রথম প্রথম বলতেন, আগামী হেয়ারিংয়েই বেইল হবে। এখন কিছুই বলেন না। একদিন চেম্বারে অপেক্ষা করছি। উকিল সাহেব কোথায় যেন গেছেন। তার মুহুরি আস্তে করে বলল,
‘মনে হয় কনভিকশন হয়ে যাবে।’
এদিকে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। একদিন সকালে বসে ডায়েরি লিখছি, শোবার ঘরের সিন্দুক খুলে সেই পুরোনো বালা দুটো বের করে মা বললেন,
‘দেখ তো সঞ্জয়, এগুলো বেচা যায় কি না?’
প্রথম প্রকাশ-নভেম্বর ২০১০,রহস্যপত্রিকা
send the feedbacks direct to facebook.it is unfortunately not possible for the writer to view or reply in blog because of being very busy.
feel free to send any kind of feedback in fb http://www.facebook.com/muhammad.toimoor
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৮:১১