somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাগর পাড়ের ছন্দ গুলো (কল্পগল্প)

১০ ই জুন, ২০০৮ বিকাল ৪:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তমেশার এসব ঢংগিপনা পছন্দ করে না আশেপাশের ঘরের জেলে বৌ রা। তার স্বামীর ফিরতে একটু দেরী হলেই সে গিয়ে বসে থাকে সাগর পাড়ের একটা নারিকেল গুড়ির উপর। তার মেয়েটা তখন এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে, ‘মা কৈ, মা কৈ’ করতে করতে পাড়া মাথায় তুলে ফেলে। এক সময় নিজেও হাজির হয় সেই নারিকেল গুড়ির কাছে। তারপর দুজনে চুপ করে বসে থাকে সেখানে।

বড় বড় ঢেউ গুলো পাড়ের কাছে এসে ভেঙে চুরে এক ধরণের সাদা ফেনা তৈরি করে। সেই সাদা ফেনা আবার চাঁদের আলোয় জ্বল জ্বল করতে করতে পেচিয়ে ধরে সাগড়ের পাড়। তারপর ঢেউ এর তালে তালে দুলতে থাকে একটা মুক্তা হারের মত। একটানা, একটা চিরায়ত ছন্দে। মা আর মেয়ে অবশ্য এসব খেয়াল করেনা। তাদের চোখ চলে যায় সেই মুক্তা হার পেরিয়ে আরো দূরে। যেখানে চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে সেই কাল অন্ধকার সাগর। যার ওপাশেই আকাশ। মা আর মেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন সেই আকাশ ফুড়ে উদয় হবে একটা বিন্দু! অবশ্য আশেপাশের কিছু অসময়ের টুরিস্টও সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই আলো আধারীর মধ্যে মা-মেয়ের চোখে সেই আশা আর আশঙ্কার খেলাটা খেয়াল করে না তারা।

মাঝে মাঝে তাদের কেউ কেউ সাগর পাড়ের সেই সরব মৌনতা ভেঙে বলে ওঠে, “আরে আরে! কি কিউট একটা মেয়ে!! এই মেয়ে তোমার নাম কি?”। কিউট মেয়েটা বিপদে পড়ে যায়। আসলে তখনো তার তেমন কোন নামই রাখা হয়নি। ছুড়ি, বুড়ি, তমেশার বেটি বলেই চালিয়ে দেয় সবাই। তাই একদিন সেই টুরিস্টদের মধ্যে কেউ তার নাম রেখেদেয় স্বর্ণা। সোনা রঙের মুখটাকে হাসি হাসি করে সে নাম মেনে নেয় মেয়েটা। ততক্ষনে কালো বিন্দুটা উদয় হয়েছে সেই চকচকে আকাশ আর সাগর সন্ধিতে। মা আর মেয়ে তখন এগিয়ে গিয়ে সেই মুক্তা হারে পা ডুবিয়ে দাঁড়ায়।

সাগর পাড়ের আর দশটা পরিবারের মত এই জেলে পরিবারেরও জীবনযাত্রায় কখনো ছন্দপতন হয়না। জোয়ার ভাটা আর পৌনপনিক ঢেউ এর মত সেটা ঘুরতেই থাকে, একটা একঘেয়ে পুনরাবৃত্তির আবর্তে। মাঝে মাঝে ঝড়বাতাসে তাদের ছাপড়া ঘর উড়িয়ে নেয়। কখনো বা ভাসিয়ে নেয় জলোচ্ছাসে। জাল বৈঠা মাটি চাপা দিয়ে তাদের ঠাই হয় সাইক্লোন সেন্টারে। তবে সময়ের ব্যপ্তি একটু বাড়িয়ে নিলেই দেখা যাবে সেই ছাপড়া ঘরটাও উড়ে যাচ্ছে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে। সাইক্লোন সেন্টারের দরজাটাও খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে সেই একই পৌনপনিকতায়। সাগর পাড়ের মানুষরা এসব ভাবার সময় পায়না।

বর্ষার শুরুতে চিংড়ির পোনা ধরার মৌসুম। এসময় তাদের জীবনে আরেকটা ছন্দ যুক্ত হয়। জোয়ান পুরুষরা সব চলেযায় ইলিশ আর লইট্যা ধরার ট্রলারে। বয়োবৃদ্ধ, শিশু, আর মহিলারা মেতে ওঠে চিংড়ি পোনা ধরার ‘উৎসবে’। মশারির মত একটা জাল, যাকে এরা বলে ‘লেট’, সেই লেট নিয়ে সবাই চলে আসে সৈকতে। অনেকটা নৌকার গুন টানার মত করে কাধের উপর দিয়ে জালের দড়িটা ধরে টানতে থাকে তারা। কখনো হাটু, কখনো মাজা পানিতে। তাদের গৃহস্থলির যা হাল, তাতে কাজকর্ম থাকার তেমন সুযোগ নেই। জেলে বৌরাও তাই এই লেট টানার কাজে যোগ দেয় পুরোদমে। সৈকত বরাবর আড়াআড়ি বিশ-তিরিশ ফুট যায়গা নিয়ে তারা টানতে থাকে জাল। একবয়ার বায়ে একবার ডাইনে। আবারো সেই চিরায়ত ছন্দে! মাঝে মাঝে দুজন মুখোমুখি হয়ে যায়। তখন সাগরের গর্জন উপেক্ষা করে টুকটাক দুয়েকটা কথা সেরে নেয় তারা। নেট টানতে টানতেই। কখনো নিজের সীমানার এক পাশে যাবার পর দেখা যায় পড়শী তখনো অন্য পাশে। গল্পের সুযোগ হারিয়ে একটু দমে যায় তারা। এর পর নিজের গতি হিসেব করতে থাকে যাতে পরের বার দেখা হয়ে যায় একই পাশে।

তমেশার মেয়েটা ছোট। আরো এক বছর পরে হয়তো তাকেও একটা ‘লেট’ ধরিয়ে দেওয়া যাবে। এখন সম্ভব না। অগত্যা মেয়েটা পাড়ে বসে থাকে একটা ‘সিলভারের’ গামলা নিয়ে। পনের বিশ বার টানা হয়ে গেলে তমেশা ফিরে আসে তার কাছে। নেট থেকে শেওলা ময়লা পানি ফেলে গামলায়। তার পর মা-মেয়ে মিলে সেখান থেকে খুজে বের করে চিংড়ির পোনা। রাতে ঘেরের লোকেরা সেসব কিনে নেয়। প্রতিপোনা দেড়টাকা-দুইটাকা দরে। এমনিতে তিরিশ চল্লিশটা পোনা ধরে সবাই। ভাগ্য ভাল থাকলে কোন কোন দিন আশি নব্বইটা পোনাও পাওয়া যায়। গামলা থেকে বেছে সেগুলো পানিভরা একটা প্যাকেটের ওঠায় তারা। তারপর ফিরে গিয়ে আবারো সেই ‘লেট’ নামক ঘানি টানতে থাকে।

তমেশার মেয়েটা চাইলে উঠে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে পারে। কিন্তু তা সে করে না। একমনে গামলায় আটকাপড়া অন্য জাতের পোনাদের নিয়ে খেলা করতে থাকে। অবশ্য এই খেলাটা এত আকর্ষনীয় মনে করার কোন কারণ নেই। সে আসলে অপেক্ষা করে তমেশার ফিরে আসার জন্য। তমেশা ফিরে আসলে পোনা বাছতে বাছতে তাকে গল্প শোনায়। কখনো জল রাক্ষসের, কখনো জল রাজকন্যার, আবার কখনো ইয়া বর একটা চিংড়ি মাছের, যে মাছটা একবার একটা কাটা দিয়ে আটকে দিয়েছিল তার বাবার ট্রলার। এরকম দুই চারটা গল্পই জানে তমেশা। সেসব গল্প হাজার বার শোনা হয়েগেছে স্বর্ণার। তারপরও সে শুনতে চায় বারবার। জলরাজকন্যার গল্পটা সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে তার। এই গল্প যেদিন শোনে, সেদিন সে সবচেয়ে খুশি। যেমন আজ।

একটু আগে সওদাগর চাঁদসাগর রাজকন্যাকে উদ্ধার করেছে জলদানোর হাত থেকে। তার পরই তমেশা উঠে গেছে লেট টানতে। গল্প অবশ্য এখানেই শেষ। কিন্তু স্বর্ণা তার পরও বসে আছে। প্রতিদিনই থাকে। এরপর কি হল, তারপর কি হল? এসব প্রশ্ন করে করে পাগল করে তোলে তমেশা কে। তমেশা তখন বানিয়ে বানিয়ে আরো কিছু বলে। সেইটুকু হয় একেক বার একেক রকম। ওইটুক শোনাই আসল মজা। স্বর্ণা তার সোনা রাঙামুখ গামলার দিকে ঝুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে তার মায়ের ফিরে আসার। বির বির করে গামলায় আটকা পড়া মাছ গুলো কে গল্প শোনায় নিজেও। একসময় তমেশা ফিরে আসে।
দুজন মন দিয়ে চিংড়ি পোনা খুজতে থাকে গামলায়। একসময় স্বর্ণা প্রশ্ন করে, ‘এর পর কি হইল মা?’
‘কি আর হইবো সওদাগর রাজকন্যারে নিয়ে গেল বাড়ি?’
‘এরপর?’
‘এরপর তারা বিয়া করল!’
‘তারপর কি হইল?’
‘মর্‌ হারামজাদি! গল্প এখানেই শ্যাষ’
স্বর্না তাও বায়না ধরে, ‘বল না, বল না মা!’
‘এর পর তাগো একটা বাচ্চা হইল। ঠিক তোর মত’ বলে স্বর্ণার মুখের দিকে তাকায় তমেশা। মনে মনে ভাবে, আসলেই কি রাজকন্যারা তার স্বর্ণার মত হয়!
‘এরপর কি হইল?’
‘এরপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকলো’
‘সুখে শান্তি বাস করে কেমনে?’
চমকে উঠে চোখ তোলে তমেশা। একটা অচেনা ঘোলা চোখে মেয়েটাকে একবার দেখে নিয়ে বলে, ‘এইডা তো মা কইতে পারি না...’ একটা বড় ঢেউ এসে হুশ করে চাপা দেয় তার দীর্ঘ্যশ্বাস।

সে আবার বলে, ‘দেখতো! তর বাপে আসছে কিনা?’ গামলা থেকে মুখ উঠিয়ে স্বর্ণা তাকায় সেই আকাশ আর সাগর সন্ধিতে। না বোধক মাথা নাড়ে একবার। তমেশার ঘোলা চোখ পরিষ্কার হয়ে গেছে ততক্ষনে।

মা মেয়ের এই হঠাৎ থমকে যাওয়াতে সাগর পাড়ের ছন্দের কোন ব্যাত্যয় হয় না। একসময় তমেশা উঠে গিয়ে সেই ‘লেট’টাই টানতে থাকে। একই চিরায়ত ছন্দে। স্বর্ণাও উকি দেয় তার গামলায়। যে গামলার পানিতেও তখন উকি দিয়েছে আরেকটা স্বর্ণরাঙা চাঁদ।
৩৬টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×