ফেব্রুয়ারী মাস সবার মত আমারো অতি প্রিয় মাস। এর অন্যতম কারন অবশ্যই বইমেলা; যাকে সবাই এক কথায় বলেন প্রাণের মেলা। ঢাকা মেডিকেলে পড়ার সুবাদে বইমেলায় প্রতিবার না হলেও ১০-১২ বার যাওয়া পড়ে। কিন্তু এবছর গিট্টু লেগে গেলো, যাকে বলে রাম গিট্টু। দিল্লিকা লাড্ডু খেতে গিয়ে তা গলায় আটকে গেলো। তাতে শ্বাসের তেমন ক্ষতি হলো না বটে, কিন্তু প্রাণে দাগা দিয়ে গেলো। ২৯টি দিনের মাঝে যেতে পারলাম মাত্র একদিন। একদিনেই বইমেলা জয় করার অসম্ভব সিদ্ধান্ত নিলাম। জয়ী হলাম না বটে, তবে নিজেকে পরাজিতও মনে হচ্ছে না। এর ছোট্ট একটি কারণ অবশ্যই অপরবাস্তব ৬। স্বপ্নের বই মেলায় আমার মত অভাজনের একটা লেখা ছাপার অক্ষরে চমৎকার মলাটের মাঝে স্থান পেয়েছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের কমিকস বড়ই অবজ্ঞার পাত্র। একে গুরুজনেরা পয়সা নষ্ট এবং গুণীজনেরা সময়ের অপচয় বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। এবং ৮০ ভাগ মানুষই একে বাচ্চাদের বই বলে অবহেলা করেন। আমার মত সংখ্যালঘু কমিকপ্রেমিরা বইমেলায় অনেক কষ্টে থাকে। হাতে গোনা দুই চারটি প্রকাশনী ছাড়া কেউই কমিক প্রকাশ করেন না। তাদের মাঝে পাঞ্জেরী প্রকাশনী অন্যতম। প্রতিবারই তারা বই মেলায় নতুন কমিক নভেল প্রকাশ করেন। এবারেও তারা আমার প্রিয় কার্টুনিষ্ট শাহরিয়ারের একটা ঝকঝকে নতুন গ্রাফিক নভেল প্রকাশ করেছে, নাম ষড়যন্ত্র!!!


শাহরিয়ার কে?
ডেইলী স্টারের ডেপুটি এডিটর এবং কার্টুনিস্ট শাহরিয়ার কবে থেকে যে কার্টুন আঁকছেন তা আমি নিজেও জানি না। আমি তার ভক্ত রাইজিং স্টারের পিছনের পাতায় বাবু কমিক পড়ে। অসম্ভব ক্রিয়েটিভ এই কার্টুনিস্ট যেমন পারদর্শী সমসাময়িক এবং রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে, তেমন পারদর্শী নির্দোষ মনোরঞ্জনের কমিক বুক আঁকতে। তার বিখ্যাত চরিত্র গুলোর মাঝে বাবু আর বেসিক আলী অন্যতম। “লাইলী” তার প্রথম গ্রাফিক নভেল। শাহরিয়ারের লেখার যে দিকটা আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষন করে, তা হচ্ছে তার সেন্স অব হিউমার। কার্টুনিস্ট ইউদেরজোর মত ছবির পরতে পরতে মজা লুকানো থাকে; লেখা না পড়েও মাঝে মাঝে হাসি আটকে রাখা মুসকিল হয়ে যায়।


ষড়যন্ত্রের ঘটনা সংক্ষেপঃ
নামে চিত্রশিল্পী কাজে টো টো কোম্পানির ম্যানেজার তৌফিক হিরো সাইকেল চালিয়ে হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে অসম্ভব ধনী, সুন্দরী কিন্তু বেয়াদব তরুনী জোশীর সাথে।জোশী বিখ্যাত বড়লোক এবং ভালোমানুষ কবি মিরাজ তুরুম তারাজ ফিদা সাহেবের একমাত্র কন্যা। বাংলা সিনেমার সূত্র অনুযায়ী প্রথম দেখাতেই তৌফিক জোশীর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড়লোক ভিলেন সোবহান সাহেবের হোৎকা ছেলে ছোটনেরো পছন্দ জোশীকে। জোশীর উচ্চাকাংখী মা চায় ছোটনের সাথে জোশীর বিয়ে দিতে কিন্তু পাত্রী দেখতে এসে সোবহান আর ছোটন চরম অপমানিত হয়। অপমানিত সোবহান সাহেব প্রতিশোধ নিতে চান জোশীকে অপহরন করে। তার ইচ্ছা জোশীকে কাজের মেয়ে বানানো। একারনে সে প্রথমেই হাত করে মিরাজ সাহেবের ম্যানেজার সোহেলকে। সোহেলের পরামর্শে মিরাজ সাহেব রাজী হন জোশীর জন্য একজন বডিগার্ড নিয়োগ দিতে। কিন্তু ঘটনা চক্রে জানোয়ার কাদেরের পাঠানো পাউরুটি পকেনের জায়গায় ঢুকে পড়ে তৌফিক আর মিরাজ সাহেব তাকেই নিয়োগ দিয়ে দেন বডিগার্ড হিসেবে। জোশীর পাশে থাকার জন্য তৌফিক সানন্দে রাজি হয় বটে কিন্তু প্রথম দিনেই স্ক্রু ঢিলা জোশীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে তার জিহবা বেরিয়ে যায়। ওদিকে সোবহানের কিডন্যাপ করার প্লান পরপর দুইবার ব্যর্থ হলে ছোটন রাগ করে নিজেই বাপের ভল্ট লুট করে জোশীকে কিডন্যাপ করার কাজে নেমে পড়ে।তৌফিক নায়ক স্টাইলে মারামারি করতে গিয়েও বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ছোটন সক্ষম হয় জোশী আর তৌফিককে কিডন্যাপ করতে। অতঃপর গাজীপুর মঙ্গল ইন্ডাস্ট্রি, নর্তকী, মদ-গাঞ্জার আসর, নায়ক ভিলেনের মারামারি এবং মিলন—তবে সবই একটু অন্যভাবে!


আমার কথাঃ
কর্মব্যস্ত সারাদিনের পর বাসায় বাচ্চাদের হাউকাউএর মাঝে, অথবা গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়ার পরে, অথবা অফিসে বসের ঝাড়িপট্টির ফাঁকে কিংবা পরীক্ষার আগে কোন সাবজেক্টের দুই চ্যাপ্টার পড়ার মাঝখানে—অর্থাৎ মেজাজ খারাপরত অবস্থায় পড়ার জন্য একটি চমৎকার বই। পুরো বইএর মাঝে বাংলা সিনেমার প্রভাব লক্ষণীয়, অর্থাৎ নির্মল বিনোদন। শাহরিয়ার ক্লাসিক কিছু হিউমার দেখিয়েছে ভিক্ষুক, সোবহানের বউ এবং জানোয়ার কাদের চরিত্র অংকনে। তবে লাইলীর পর ষড়যন্ত্র একটু গতানুগতিক হয়েছে বইকি। বিশেষ করে যারা নিয়মিত শাহরিয়ার পড়েন তাদের কাছে অনেক ডায়লগই পরিচিত মনে হবে। কাহিনীটা যথেষ্ট সাদামাটা, আরেকটু ভিন্নতা আনা প্রয়োজন ছিলো। ভিন্নতা আনা দরকার ছিলো চেহারাতেও। এক চুলের দৈর্ঘ্য ছাড়া জোশীর চেহারার সাথে লাইলীর চেহারার যথেষ্ট মিল, তার উপর ভিলেন ছোটনের চেহারাও ভিলেন হিসেবে অনেক জায়গায় ব্যবহৃত। তবে সবকিছু মিলিয়ে ষড়যন্ত্র চমৎকার বিনোদন সন্দেহ নেই।

************************************
এক নজরে বইটিঃ
ষড়যন্ত্র
লেখকঃ শাহরিয়ার
ধরনঃ রঙিন গ্রাফিক নভেল
প্রকাশকঃ পাঞ্জেরী পাবলিকেসন্স লিঃ
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৯৬
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী ২০১২
মূল্যঃ ১৩০ টাকা
************************************




অফটপিকঃ চারমাস পর ব্লগে আসলাম। আপনারা সব আছেন কেমন?