১.
একটা সময় ভাবতাম, প্রেমে পড়ে বোকারা, যারা দুঃখবিলাসী ও কল্পনাপ্রবণ। নিজেকে মনে হত এদের চেয়ে ভিন্ন কেউ, যে বাস্তবতার নিরিখে জীবনকে বিচার করে ও ভাল থাকে, কোন কষ্ট না পেয়ে.....ধারণাটা বদলে গেল হঠাৎ করেই, আকস্মিকভাবে, নতুন এক কোর্সের ক্লাসে গিয়ে, পিছনের সারিতে বসে থাকা এক লাজুক ও শান্ত ছেলের কারণে। প্রথম পরিচয়ের দিন যখন তার পাশে বসে টুকটাক কথা হল, সেটাই যেন বদলে দিল আমার পৃথিবী। মনে হল, এ কার কন্ঠস্বর, যা আমার সারা অন্তর জুড়ে শিহরণ বইয়ে দিল? মনে হল, পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে আছে, আর শুধুই সে আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছে। আমার হৃদয় জুড়ে সৃষ্টি হল হাহাকার, রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেল বেদনা ও আনন্দের মিশেলে এক তীব্র স্রোত.....এক পর্যায়ে জানতে পারলাম সে আমারই ইয়ারমেট, একই বছরে এইচ এস সি পাশ করেছি দুজনেই। নেমে এলাম আপনি থেকে তুমিতে, একটা অন্যরকম ভাল লাগা তৈরি হল মনের মধ্যে। যেহেতু ক্লাসে দেরিতে পৌঁছেছিলাম, তাই আমাকে সাহায্য করল নিজের খাতা থেকে লেকচার দেখিয়ে। ক্লাস শেষে যখন বিদায় নিল, মনের মাঝে বাজছিল সেই বিখ্যাত পংক্তিদ্বয়..."প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ".... তখন আমি যেন ছিলাম ঘোরের মাঝে, তাই খেয়ালই করি নি যে নামটা জিজ্ঞেস করা হয় নি তার! বাসায় ফি্রেও কিছুতেই তার কথা মন থেকে সরাতে পারছিলাম না, রাতে ভাল করে ঘুমও হচ্ছিল না, কেমন যেন সুখময় এক ব্যথা বাজছিল বুকের মাঝে.....
২.
পরবর্তী ক্লাসের দিন, আবারো তার পাশের সীটটি খালি দেখে সাহস করে বসেই পড়লাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে তার নাম জানতে চাইলাম, আর সেটাই হল কাল। যে আমি ২ দিন আগেও উড়ছিলাম প্রজাপতির মত, মনে হল কেঊ যেন ডানা দুটি আমার কেড়ে নিল, আর আমি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম। কারণ তার নাম শুনেই বুঝে গেলাম যে বৃথা এই স্বপ্ন দেখা তাকে নিয়ে, এ তো কখনোই সত্যি হতে পারে না-দু'জন যে আমরা দুই মেরুর, দুই ভিন্ন ধর্মের......মনে হচ্ছিল ছুটে বেরিয়ে যাই ক্লাস থেকে, সব অসহ্য বোধ হচ্ছিল....কিন্তু তার সহজ ব্যবহার, জড়তাহীন আচরণ দেখে আস্তে আস্তে নিজেকে সংযত করলাম। ভাবলাম, যা হবার তা হয়ে গেছে, সে তো আর জানে না কী আছে আমার মনের ভেতর, তাই আর ভয়ের কিছু নেই, আমার কাছে থেকে অন্তত তাকে কোন অপ্রীতিকর ব্যবহার পেতে হবে না। সে সাথে এটাও স্থির করে নিলাম যে তার সাথে দুরত্ব বজায় রেখে চলব, কারণ চাই নি যে সে আমার মনের কথা কোনদিন ভুলেও বুঝে যাক। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। ঐদিনই সে আমাকে অনুরোধ করল যেন আমি তাকে ছুটির পরে একটু সময় দিই, কারণ সে আমার সাথে ক্লাস লেকচার নিয়ে আলোচনা করতে চায়। কিছুটা অনীহা নিয়েই রাজি হয়েছিলাম, হাজার হোক, সে বলে কথা। কী যে এক অভিজ্ঞতা ছিল তা, বলে বুঝাতে পারব না। যদিও গ্রুপ স্টাডির সময় ওর এক বন্ধুও সাথে ছিল, কিন্তু আমি কিছুতেই সহজ হতে পারছিলাম না, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাব। খুব চেষ্টা করে সেদিন নিজেকে সামলাতে হয়েছিল। এরপর তার সাথে পাশাপাশি বসা বন্ধ করে দিলাম। সে ব্যপারটা হয়ত তেমন অনুধাবন করল না যে আমি আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে ফেলছি। এরই মাঝে একদিন লিফটে নামার সাথে দেখা তার সাথে, আমাকে দেখে কিছুক্ষণ অপলক নেত্রে চেয়ে রইল, আর মুচকি হাসি দিয়ে বলল, "তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে আজকে".....অবাক ব্যপার, তখন কিছুতেই পারলাম না নিজেকে দুরে সরিয়ে রাখতে, হেসে ফেললাম ওর কথায়, নিজের অজান্তেই অনেকটা সহজ আচরণ করতে শুরু করলাম আবার ওর সাথে.......
৩.
কিছুদিন পরের কথা, বন্ধুরা সবাই মিলে গল্প করছিলাম, সে-ও উপস্থিত ছিল। আচমকা এক বন্ধু জানাল, "সে" (তাকে এখন থেকে "ন" নামে উল্লেখ করব) নাকি সামনের মাসে দেশের বাইরে পড়তে চলে যাচ্ছে, ভাবলাম হয়ত নিছকই দুষ্টুমি, কিন্তু না, "ন" সম্মতি জ্ঞাপন করল ঐ বন্ধুর কথায়। সেই মূহুর্তে আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, বুকটা এত জোরে কাঁপছিল যেন হৃৎপিন্ড ছিটকে বেরিয়ে যাবে-এ আমি কি শুনলাম, কেন শুনলাম? বারবার এটাই মাথায় আসছিল যে সে আমার থেকে অনেক অনেক দুরে চলে যাবে, অথচ এতদিন আমি নিজেই চাইছিলাম যেন সে সরে যায় আমার জীবন থেকে। যখন সত্যিই এমন পরিস্থিতি তৈরি হল তখন কেন মেনে নিতে পারছিলাম না সেটা? একেই কি ভালবাসা বলে?
.........(চলবে)