ডাক্তারের নেমপ্লেট লাগানো একটা ঘরে ঢুকে রাজু চোখ বড় বড় করে তাকায়। ঘরভর্তি চেয়ার, চেয়ারভর্তি মানুষ। সামান্য একজন প্রাইভেট টিউটর নির্বাচনের জন্য এতো প্রার্থী ডাকা হয়েছে!! পরে বুঝা গেল এই ফ্ল্যাটটা আসলে রোগী দেখার চেম্বার। ঘরে বসে থাকা লোকগুলো সবাই ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। যদিও ডাক্তার এখনো আসেননি। কখন আসবেন তাও বুঝা যাচ্ছেনা। সে একটা চেয়ারে বসতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে তাদের মেস ম্যানেজার রফিক ভাইয়ের মুখটা। যিনি আজ সকালেও বলেছেন- রাজু কি অবস্থা? তোমার ট্যাকাতো শ্যাষ। আর কদ্দিন খাওয়ামু ভাই? চাউলের কেজি পঞ্চাশ..। কি কষ্টটাই না গেছে গত দেড় বছর! এই শহরে তার পরিচিত এমন কেউ নেই যাকে সে একটা টিউশনি যোগাড় করে দেওয়ার কথা বলেনি। তারপর অনেক প্রতীক্ষা আর ধৈর্যের পর আজ সকালে সে খবর পেয়েছে এক ডাক্তার তার ছোট মেয়েকে পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিচার খুজছেন, তাই রাজুকে ডেকে পাঠিয়েছেন ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার পরেও ডাক্তার না আসায় সে একটু অধৈর্য হয়। কখন আসবেন তিনি? প্রায় আড়াইঘন্টা বসে থাকার পর তিনি আসলেন রাত আটটায়। এসেই রোগী দেখা শুরু করলেন। এক মিনিটো দেরী করলেন না। দেরি করার সময়ও তাদের নেই। এক মিনিট সমান দুইটা রোগী, দুইটা রোগী সমান এক হাজার টাকা। ১০০০ ইন্টু...। হিসাবে গন্ডগোল। বসে থাকতে থাকতে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। চেহারা হয়েছে শুটকির মতো। একটু চা পানি খেতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। ডাক্তার এসে পড়েছেন। যেকোন সময় তাকে ডাকতে পারেন কথা বলার জন্য। অতএব সে বাইরে যায় না। চেয়ারেই বসে থাকে। লোকজনের ভিড়ও বাড়তে থাকে ঘরটায়, বাড়ে কোলাহল। একটা ছোট বাচ্চা তিড়িং বিড়িং করে তার সামনে এসে দাড়ায়। রাজু তার গাল টিপে দিয়ে বলে কেমন আছো সোনামনি? তোমার নাম কি? সোনামনি তার নাম বলেনা। কেমন আছে তাও বলে না। শুধু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে রাজুর দিকে। রাজু তাকায় ঘরে বসে থাকা ঘরে বসে থাকা লোকগুলোর দিকে। এরা কেউই তার প্রতিযোগী নয় এটা ভেবে তার ভালোই লাগে। কিন্তু সবাই খুব কথা বলছে এটা তার ভালো লাগে না। এরা সবাই কি অসুস্থ? কিংবা রোগী? ভাবে রাজু। তাহলে মুখ বন্ধ হচ্ছেনা কেন? এমন কোন রোগ বালাই কি নেই যা মুখের কথা বন্ধ করে ? নিজের কাছে প্রশ্ন করে সে নিজেই আবার উত্তর দেয়- হ্যাঁ আছে। প্রেমরোগ। হা-হা-হা-, হাসতে থাকে রাজু। হাসি থেমেও যায় কিন্তু প্রেম শব্দটা মাথার ভেতর নাচতে থাকে। প্রেম! প্রেম! হয়েছিল কি তার জীবনে। কখনো? কী দীপ্তিময় অদ্ভুত সুন্দর দুটো চোখ ছিল মেয়েটির! রাজুর বুক ভারী হয় কী এক দুঃখ বেদনায়। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে আবার উত্তেজিত হয়। দশটা বাজে! সে প্রায় ধমকের সুরে পিয়নকে দিয়ে ভিতরে খবর পাঠায় যে সে এসেছে। পিয়ন ছেলেটা ঘুরে এসে খবর দেয় রোগী দেখা শেষ করে স্যার তার সাথে কথা বলবেন। রাজু বিরক্ত হয়ে বসে থাকে। কখন রোগী দেখা শেষ হবে আর কখন শুরু হবে তার ইন্টারভিউ! যাক তাও হবেতো শুরু একসময় এই ভেবে কিছুটা স্বস্তি সে পাওয়ার চেষ্টা করে বিরক্তি এড়ানোর জন্য। উত্তেজনা কিছুটা কমলে মনটাও একটু নরম হয়। আহা, এই দুর্দিনের অবসান হবেতো? কতোবেলা তার কেটেছে না খেয়ে ভার্সিটির বেতন আর মেস ভাড়া দিতে গিয়ে। বাড়ি থেকে যা সামান্য কিছু টাকা আসে তা দিয়ে মেস খরচই চলেনা ঠিকমতো। এতো বড় শহর, লক্ষ লক্ষ মানুষ। সামান্য একটা টিউশনি সে জোগাড় করতে পারছেনা! কি করে চলবে পড়াশোনা? এসব ভাবতে ভাবতে তার ধন্দ লাগে। চোখের পাতা নেমে আসে ক্লান্তিতে। তার মনে হয় এই অপেক্ষা এই বসে থাকা বুঝি কোনদিনই শেষ হবে না। মনে হয় সে এক মৃত মানুষ। মৃত্যুর পর তাকে আবার জীবিত করা হয়েছে বিচারের জন্য। বিচারে তার রায় ঘোষনা হয়েছে একজন ডাক্তারের অপেক্ষায় টিউশনির প্রতীক্ষায় একটা কাঠের চেয়ারে তাকে বসে থাকতে হবে সারাজীবন। যে জীবনের মৃত্যু নেই, ক্লান্তি আছে। যে সময়ের উৎস আছে, পরিণতি নেই। সময় বয়ে যাচ্ছে অনন্ত অসীমতার দিকে। বইতে বইতেই একসময় যখন রাত এগারোটা বাজে তখন হঠাৎ কীযে হয়। পেটটা মোচড় দিয়ে উঠে খিদেয়। সে একটু বাইরে যায় কিছু খাওয়ার জন্য এবং মাত্র দশ মিনিটের জন্য বাইরে গিয়ে ফিরে এসে দেখে ডাক্তার নেই। বাসায় চলে গেছেন!!
[email protected]