৭১ এর যুদ্ধ নিয়ে মানুষজনের বিভিন্ন কথাবার্তা ও স্মৃতিচারণা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে। আম্মুর কাছে বেশ অনেকদিন আগে তার জীবনের মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন ঘটনা শুনতে চেয়েছিলাম। বেশ আগ্রহ নিয়েই আমাকে শুনালেন সেইসব ঘটনাগুলো।
কিন্তু আমি এতই ভুলোমনের মানুষ যে ঘটনাগুলোর অনেক কিছুই ভুলে গিয়েছি। তারপর ও যা কিছু মনে আছে,তাই আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। কোন বানান বা শব্দ নির্বাচন ভুল হলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আম্মুরা তখন ছিলেন ৪ ভাইবোন। ৩ বোন ১ ভাই। বড়খালাম্মির পরে আম্মু তারপর বাকি দুই ভাই ও বোন। সবার বয়স পিঠাপিঠি। আম্মুর বয়স ছিল ৭/৮ বছর।
নানা গাজীপুরে একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। সেখানেই সংসার। দেশে যুদ্ধাবস্হা বিরাজ করছে।সবার বুক দুরুদুরু করছে।হঠাৎ স্বাধীনতার ঘোষনা এলো।যুদ্ধে যাবার জন্য দলে দলে মানুষ বের হয়ে আসছে রাস্তায়। হৈচৈ অবস্হা চারিদিকে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে আম্মু তাই দেখছিলেন।হঠাৎ নানির কথায় ছেদ পড়লো।''চলো চলো । এখানে আর থাকা যাবেনা'' নানা নানি ঠিক করলেন আগে ঢাকা যাবেন।তারপর অন্য কোথাও। ঢাকায় নানির বাপের বাড়ি।
তারপর এককাপড়ে হাতে সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সপরিবারে বের হয়ে পড়লেন তারা। দোয়াদরুদ পরতে পরতে কোনমতে ঢাকায় এসে পৌঁছলেন তারা। সেখানেও খারাপ অবস্হা। তারপর ও মাসখানেক ছিলেন তারা ওখানে। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। কোনরকম আওয়াজ করা যাবেনা বা রাতের বেলা বাতি জ্বালানো যাবেনা। নইলে পাকবাহিনী টের পেয়ে যাবে। মাথার উপর দিয়ে দিনরাত পাকবাহিনীর হেলিকপ্টার বিকট শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। আশেপাশে কানফাটানো শব্দে বন্দুকের গুলি । বোমাবারুদ ফাটছে অবিরাম। মানুষজনের হৈচৈ ও অ্যাম্বুলেন্সের ভয়ধরানো সাইরেনের আওয়াজ। কী ভয়ংকর অবস্হার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা। মুরুব্বিরা সারাটাক্ষণ দোয়াদরুদ ও কোরান তেলাওয়াত করছেন।আম্মুর ২খালা ও ২ মামা সর্বদা সতর্ক ও সবাইকে সাবধান করছেন যাতে কোনরকম বিপদাপদ না ঘটে। রাতের বেলা চুপি চুপি বেতারে অনেক অল্প শব্দে যুদ্ধের অবস্হা শুনতেন সবাই। পোষ্টার বানিয়ে রাতের আঁধারে সেগুলো বাইরে দেয়ালে লাগিয়ে আসতেন আম্মুর মামারা।
সেইসময়কার একদিনের ঘটনা। সময়টা সম্ভবত কোন এক দুপুরে। চারদিক খুব নির্জন ও নিশ্চুপ। হঠাৎ এক বিকট শব্দে সবার বুক কেঁপে উঠলো। পাশের বাসায় পাকবাহিনী হামলা করছে।ধুমধাম শব্দে সবকিছু ভেঙে তোলপাড় করে দিচ্ছে। আর হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু ঐ বাসায় তখন কেউ ছিলনা। আম্মুরা সবাই ভয়ে আতংকে কাঠ। সবার মুখ সাদা। এই বুঝি এখানেও হামলা করলো তারা। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত। সৈন্যরা ঐ বাসা থেকে লুটপাট করে চলে গেল। এই বাসার দিকে তাকাল না।
এই ঘটনার পর নানা ঠিক করলেন এখানে আর থাকা যাবেনা,যেকোন সময় এখানে হামলা হতে পারে। আর তখন ঢাকার অবস্হা খুবই খারাপ। রাতের আঁধারে দলে দলে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে।
সময়সুযোগ বুঝে একদিন রাতের আঁধারে নানা তাঁর পরিবারসহ ঢাকা ছাড়লেন। অনেক চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে ৩ ঘন্টার রাস্তা পাড় হলেন ৩ দিনে। ময়মনসিংহে এক আত্নীয়ের বাসায় উঠলেন। খুব আন্তরিক ছিলেন তারা। কিন্তু যুদ্ধের সময় অন্যের বাসায় আর কতই থাকা যায়। একদিকে নিজেদেরই নিরাপত্তা ও খাবার নাই। তার উপর আবার মেহমান। তবু তারা খুব খাতির করলেন। কিন্তু সেসময় এই গ্রামটাও নিরাপদ ছিলনা। সময় অসময় গোলাগুলি হতো। কয়েকদিন এখানে থেকে আবার আম্মুরা সবাই বেরিয়ে পড়লেন। এবার অজানা গন্তব্য। একটি পরিবারে মাত্র একজন পুরুষ। ৪ জন বাচ্চা। নানার কীযে দিশাহারা অবস্হা হলো। তারউপর আবার ৫ বছর বয়সী মামার কয়েকদিন আগে মুসলমানী করা হয়েছে। হাঁটতে পারছেননা। একবার নানা একবার নানি একবার বড়খালাম্মি পালা করে মামাকে কোলে নিয়ে হাঁটছেনতো হাঁটছেনই। কিছুদূর হাঁটলে পিছন ফিরে দেখা যায় ৩ বছর বয়সী ছোটখালাম্মি রাস্তার ধারে ফুল ছিঁড়ছে,বা খেলা শুরু করেছে। তাকে ধরে এনে আবার হাঁটা। কতো শহর কতো গ্রাম যে এভাবে পার হতে হয়েছে। পথে কয়েকটি পরিবারের সাথে দেখা হয়েছিলো। সবাই পালাচ্ছে।
দূর থেকে বিমান বা হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনলেই গর্তে বা আড়ালে কোথাও লুকাতো সবাই। রাতের বেলা হাঁটা আর দিনের বেলা একটু কোথাও কোন বাসায় মানুষ থাকলে সেখানে কিছু বিশ্রাম নেয়া আর খাওয়ার কাজ সারা হত। এই ফাঁকে নানা চেষ্টা করতেন কিছু খাবার কেনা যায় কিনা। পয়সা থাকলেও খাবার কেনাটা ছিলো বিরাট কষ্টসাধ্য কাজ।যুদ্ধের সময় কে দোকান খুলে বসে থাকবে?
এভাবে মাসের পর মাস কাটলো। শেষের ২/৩ মাস বাংলার কোন এক গ্রামে(নামটা আমার মনে নেই) একজনের বাসায় কিছুটা আরামে কাটানো গেল। সেই গ্রামটি কয়েকদিন আগেই মুক্তিবাহিনী জয় করে নিয়েছিল।ক্লান্তশ্রান্ত পরিবারটি দীর্ঘ কয়েকমাস পর একটু আরাম ও নিরাপত্তার সন্ধান পেল। নানি অসুস্হ হয়ে পড়েছিলেন। নানার পা যেন আটকে গিয়েছিল। মামার কথাতো বলাই বাহুল্য।পরে আবার উনাকে নিয়ে নানার অনেক ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিলো। কয়েকমাসের যত্নের অভাবে উনার অবস্হা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
যাই হোক,এই গ্রামে থাকতেই একদিন। আম্মুরা ভাইবোন মিলে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন।হঠাৎ তাকিয়ে দেখেন একটি বিরাট মিছিল আসছে।রং বেরঙের পোশাক,ব্যানার ইত্যাদি নিয়ে।সবার হাতে বাংলাদেশের পতাকা। গালে, হাতে, পেটে, পিঠে সব ছেলেরা পতাকা এঁকেছে।সবাই রং ছিটাছিটি করছে। উন্মাদ হয়ে গেছে যেন সবাই। গ্রামের সব নারী পুরুষ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। সবাই শুধু বলছে বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ!!
আম্মু আর বড়খালাম্মি দৌড়ে নানির কাছে গেলেন,তিনিও কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বললেন ''নাজু শেফু আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে!!''বিজয়ের খবর পেলেন, আর যান কোথায়? দুই বোন মিলে যে কান্না শুরু করেছিলেন, নানার কথায় থামতে বাধ্য হলেন। অশ্রুসজল চোখে সবাই মিলে ২ রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ে দেশজয়ে কৃতিত্বের দাবীদার শহীদ গাজী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন।
তার পরদিন নানা সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসলেন। আম্মুর নানাবাড়িতে উঠলেন। ঐ বাসার সবাই যুদ্ধের পুরোটা সময় ওখানেই ছিলেন এবং আল্লাহর রহমতে সবাই ভালোই ছিলেন। সেখানে এসে পৌঁছতেই সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
কয়েকদিন ঢাকায় থেকে আম্মুরা সবাই আবার গাজীপুরের বাসায় ফিরে এলেন। এসে দেখেন বাসা লন্ডভন্ড।কিন্তু কিছুই নিতে পারেনি,তাই তারা বাসার যা খাবার ছিল তাই খেয়ে বিদায় হয়েছে। ফ্রিজ থেকে এক বোতল দুধ ও খেয়েছে দেখে সবার হাসাহাসি শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
বাসা থেকে কিছু নিতে না পারলেও পাশের গ্যারেজ থেকে নানার অতি শখের গাড়ি(যেটা তিনি ফ্রান্স থেকে বিপুল দামে কিনে এনেছিলেন) নিয়ে গেছে। নানার তো মাথায় হাত। পরে অনেক চেষ্টা তদবির করা হয়। একদিন রাস্তায় মাইকিং এর আওয়াজে নানা রাস্তায় এসে দেখেন তার গাড়ির বর্ণনা দিয়ে বলা হচ্ছে ''মালিক মতিয়ুর আপনার গাড়ি পাওয়া গিয়েছে,জলদি উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে নিয়ে যান।''
নানা এখনো আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করেন তার গাড়িটি ফিরে পাবার জন্য।যদিও গাড়িটি এখন আর নেই। কোন এক মিউজিয়ামে সেটি আছে। গাড়িটি পরবর্তীতে নানার অনেক কাজে এসেছিলো।
প্রিয় ব্লগার বন্ধুরা,এই হল আমার আম্মুর কাছ থেকে শুনা তার জীবনের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরবর্তী কিছু ঘটনাবলী। এইখানে কিছু ঘটনা লিখলাম, ইতিহাসতো অনেক লম্বা,কিন্তু আমার টাইপ করার কষ্ট আর আপনাদের বিরক্তির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য এখানেই লেখাটি শেষ করছি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




