পাঠক নিশ্চই আমার প্রথম পোস্ট পড়েছেন। সেখানে আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক ঘটনার কথা লিখেছিলাম। সেখানে অনেকেই আমার প্রত সমবেদনা প্রকাশ করেছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাছি। এবারের পোস্টটিতে আমার জীবনের সবচাইতে আনন্দদায়ক ও স্মরণীয় ঘটনার কথা লিখছি।
২০১০ সালের প্রথমদিকে আমি দ্বিতীয়বারের মত প্রেগন্যান্ট হই। প্রথমেই আম্মুর কাছে চলে আসি, অনেক যত্ন ও পাই। কিন্তু এবারও প্রথমদিকে আমার সমস্যা হয়েছিলো। আমার কান্না ও ভয় দেখে আম্মুর মুখ ও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে দেখলাম। ডাক্তার চেকাপ করে আমাকে খাটে বন্দী করে ফেললেন, মানে টয়লেট এ যাওয়া ছাড়া বিছানা থেকে নামা নিষেধ করে দেন। এভাবে দিনের পর দিন পার করাটা সহজ কিছুনা। ভয় ও চিন্তা আমাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখত। প্রতিবার নামাযের পর আল্লাহর কাছে আকুল হয়ে শুধু একটি প্রার্থনাই করতাম, তুমি দেখ আমার বাবুটা যেন সবসময় ভাল থাকে, তাকে সবসময় সুস্থসবল রাখো, সহিসালামতে ওকে আমার কোলে তুলে দাও।
এরই মধ্যে আমার হাজব্যান্ডের হজ্বে যাওয়ার দিন ঠিক হয়। ডাক্তারের দেওয়া আমার ডেলিভারী ডেটের মাত্র কয়েকদিন আগে। আমাদের প্রথম বাবু হওয়ার সময় ও থাকবেনা, এটা ভেবে তখন খুব কষ্ট হত। তারপরও চাইতাম এই মহান কাজের উসিলায় আল্লাহ যেন আমার ডেলিভারীটা সহজ করে দেন। বেদনাসিক্ত মনে ওকে বিদায় জানালাম।
তার কয়েকদিন পর আমি শারিরীকভাবে কিছুটা অসুস্থতা অনুভব করলাম। ডাক্তারকে জানানোর সাথে সাথে তিনি আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি হতে বললেন। জানালেন ওই দিনই রাতে আমার সিজারিয়ান অপারেশন করা হবে। ভয় আর আনন্দ দুইয়ে মিলে অদ্ভুত অবস্হা হল আমার। আল্লাহকে প্রাণপনে ডাকতে থাকলাম।
রাত সাড়ে ৮টায় আমাকে ওটির বেডে তোলা হল। মেশিন, লাইট, ছুঁড়ি-কাঁচি ইত্যাদির শব্দে আমার তখন মনে হল যেন দুনিয়ার বাইরে কোথাও আছি। হঠাৎ কী আশ্চর্য! আমি যেন আমার জীবনের মধুরতম শব্দ শুনতে পেলাম! একটি শিশুর কান্না আমার কানে প্রবেশ করলো! মনের মধ্যে তখন আশ্চর্য এক অনুভূতি!! অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটু পরে নার্স এসে আমাকে বললো এইযে আপনার বাবু। বলে যেন একটা বেহেশতের ফুলপরীকে আমার গালে আলতোভাবে ছুঁইয়ে দিল।
পাঠক, সে কী অনুভূতি!! বলে বা লিখে বুঝাতে পারবোনা কোনদিন। তখনো আমার অপারেশন চলছে। কড়া লাইটের কারণে মেয়েটি চোখ পিট পিট করছিল। আমার দিকে কোনভাবে তাকিয়ে সে যেন জানিয়ে দিল, দেখ আমি চলে এসেছি!!
তার বাবা তখন মদীনায়। রওজা শরীফে। খবর দেয়া হল। কিছুক্ষণ পর যখন আমার সাথে কথা হল, তখন সে স্বাভাবিক থাকলেও আমি আর পারিনি। চোখে আপনা আপনিই পানি চলে আসে। প্রচন্ড পেইনের কথা বলে তার সাথে আলাপ শেষ করি।
বাসায় চলে আসার পর খুব খালি খালি লাগে। আমি অপেক্ষা করি, কবে তার বাবা আসবে, আমরা তিনজন একসাথে হব। এরমধ্যে শুনি তার ফ্লাইট পিছিয়েছে। মন খারাপ হয়। বাবুকে নিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করি।
এভাবে অনেকদিন পার হল। জানেন কত দিন? প্রায় চল্লিশ দিন।
এরপর আসলো সেই শুভদিন। সে আসছে!! আমি রোমাঞ্চিত। বাবা তার মেয়েকে প্রথম দেখবে, এতদিন পর তিনজন একসাথে হবো!!
সেদিন রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছিলো। আমি বাবুকে সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমাদের ঘরে। আমার ভাই এসে খবর দিল দুলাভাই আসছে, তুমি রেডি তো? বলে ও চলে গেল। আমি কন্যাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
তখুনি সে ঘরে প্রবেশ করল! জানতাম সে এখুনি আসবে, তারপরও চমকে গেলাম। সালাম বিনিময় করলাম। আমাকে আর বাবুকে একসাথে ধরে সে আমাদের দুজনকেই দেখতে লাগল। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া জানিয়ে পরে বাবুকে কোলে নিল। ঠিক তখুনি বাবা আর মেয়ের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হল। বাবা তখন আনন্দের আতিশয্যে জোড়ে করে হেসে দিল। আমার চোখেও আনন্দের অশ্রু। আমার জীবনের অন্যতম সুখের মুহুর্ত এটি।
কতদিনপর কত্তদিনপর তাকে দেখলাম। শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। হবেই তো। এবার যে ও প্রায় একলা একলাই এতদিন পার করে দিল।
আল্লাহর কাছে শোকর হাজার শোকর তাকে সফলভাবে হজ্জ্ব পালন করার তৌফিক দেয়ার জন্য। আমাদের কন্যাকে সহিসালামতে কোলে তুলে দেয়ার জন্য এবং তিনজনকে সুন্দরভাবে একসাথে করে দেয়ার জন্য।
আর পাঠক-পাঠিকাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার এই পোষ্টটি সময় করে পড়ার জন্য। দোয়া করবেন যেন আল্লাহ আমাকেও অতিশিঘ্রই হজ্জ্ব পালন করার তৌফিক দান করেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ বিকাল ৩:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




