somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হাজার বছরের সভ্যতা ঘুমিয়ে আছে এখানে

০৩ রা অক্টোবর, ২০০৬ সকাল ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাজশাহী মহানগরীর পুরানো বাড়িগুলি দেখলেই মনে হয় যেন কোনও রাজরাজরার যুগে বসবাস এখনও। হলদে কিংবা লাল রঙা দেয়ালে শ্যাঁওলার ছাপগুলো যেন নিয়ে যেতে যায় অতীতের গৌরবময় যুগগুলিতে। সেই রকমই একখানা পুরানো নোনাধরা দেয়ালওয়ালা হলদে বাড়ি রয়েছে হেতমখাঁ এলাকায়। বাইরে থেকে ভবনটি দেখে যে ঐতিহ্যের কথা মনে পড়ে যায়, এই ভবনের ভেতর ঢুকলে সেই ঐতিহ্যগুলিকে যেন নাগালেও পাওয়া যায়। ভবনটি বরেন্দ্র যাদুঘর বলে পরিচিত। আসল নাম বরেন্দ্র গবেষণা যাদুঘর। শতবর্ষ ছুঁতে যাওয়া এই যাদুঘরে বড় যত্নে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন বাংলার হাজার বছরের গেীরবময় ইতিহাস। বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর স্থাপত্যশিল্পের সবচে বড় সম্ভার এই বরেন্দ্র যাদুঘর। শুধু তাই নয় এই যাদুঘর দণি-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর প্রত্নতত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। প্রতিদিন প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন দেখতে কয়েকশ' দর্শনার্থী আসেন এখানে।

বরেন্দ্র যাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয় 1910 সালে। তখন এই সংগ্রহশালাটি পরিচালনা করতো বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য শরৎকুমার রায়, আইনজীবী এ কে মিত্র এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামপ্রসাদ চন্দ্র। যাদুঘর স্থাপনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু হয় এর অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি। 1911 সালে কলকাতা যাদুঘর বরেন্দ্র যাদুঘরের যাবতীয় সংগ্রহ দাবি করে বসে। আর তাতেই অস্তিত্বে টান পড়ে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ যাদুঘরটির। তবে বেশিদিন স্থায়ী হয় নি এই টানাটানি । তখনকার রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার এফজে মনোমোহনের প্রচেষ্টায় বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল যাদুঘর পরিদর্শন করেন এবং সংগ্রহের বৈচিত্র্যের কারণে সন্তোষ প্রকাশ করেন। 1913 সালের 14 ফেবৃুয়ারি সরকারি এক সাকর্ুলারের মাধ্যমে স্থানীয় যাদুঘরগুলিকে নিজেদের সংগ্রহের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হলে সে যাত্রা অস্তিত্ব ফিরে পায় বরেন্দ্র যাদুঘর ।
যাদুঘরটি বর্তমানে যে ভবনটিতে রয়েছে তার জমিটি দিয়েছেন শরৎকুমারের বড় ভাই দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদা নাথ রায়। 1916 সালের 13 নবেম্বর লর্ড কারমাইকেল যাদুঘরের ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সরকারি পর্যয় থেকৈ কোনও সহযোগিতা না পাবার কারণে পুরো ভবন নির্মাণের ব্যয় ভার শরৎকুমার নিজে তার কাঁধে তুলে নেন।
1919 সালের 27 নভেম্বর বর্তমান ভবনটিতে বরেন্দ্র যাদুঘরের পথচলা শুরু হয়। বরেন্দ্র গবেষণা কেন্দ্রই তখনও এই যাদুঘরটি পরিচালনা করতো। 1937 সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতিই পরিচালনা করতো যাদুঘরটি। এরপর সরকারিভাবে স্বীকৃত একটি পরিচালনা কমিটির হাতে তুলে দেয়া হয় যাদুঘরটির দায়িত্ব। 1880 সালের চ্যারিটেবল এনডোমেন্ট এ্যাক্টের মাধ্যমে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। 1947 সালে দেশ ভাগের পর আবারও হুমকির মুখে পড়ে শতাব্দী প্রাচীন এই যাদুঘরটি। তখন দেশভাগের ফলে তদারককারী আর আর্থিক উৎসহীনতার কারণে নাজুক হয়ে পড়ে এর পরিস্থিতি। 1964 সাল পর্যন্ত চলে এই অবস্থা। সেই সময় স্থানীয় কিছু কিছু উদ্যোগ দাঁড় করিয়ে রাখে বরেন্দ্র যাদুঘরকে। 1964 সালের 10 অক্টোবর বরেন্দ্র যাদুঘরটির দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। এর পর থেকে এখনও এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে রয়েছে।

বরেন্দ্র গবেষণা যাদুঘরের সবচে আকর্ষণীয় দিক হলো এতে বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম শাসনামলের স্থাপত্য শিল্প ও চিত্রকর্মের একটি বড় সম্ভার রয়েছে। এ অঞ্চলের ইতিহাসে বীর যোদ্ধা বলে পরিচিত শাসকদের অস্ত্র, যুদ্ধের পোশাক, সংস্কৃত ভাষায় রচিত বেশ কিছু দলিল-দস্তাবেজ ও গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, আরব ও পারস্যের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকর্ম এবং বাংলা ভাষায় রচিত প্রাচীন যুগের অনেক বইয়ের পাণ্ডুলিপি রয়েছে বরেন্দ্র যাদুঘরের সংগ্রহে। 8 টি গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে মহেঞ্জোদারো থেকে শুরু করে খ্রিষ্টপূর্ব ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রত্নতাত্মিক সব নিদর্শন।
প্রথম গ্যালারিতে রয়েছে খ্রিস্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, পারস্য ও বাংলার পাণ্ডুলিপি, হাতে লিখা কোরান শরীফ, সংস্কৃতি ও প্রাকৃত পাণ্ডুলিপি, মুঘল চিত্রকর্ম এবং পাথর ও ব্রোঞ্জের নির্মিত অস্ত্র। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে বৌদ্ধ এবং হিন্দু সভ্যতার প্রস্তর মূর্তি এবং আধুনিক কাঠের স্থাপত্য। তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে শিব, গণেশ এবং বিষ্ঞুর নানা দলনৈল মূর্তি। চতুর্থ গ্যালারিতে আছে দূর্গা, গৌরি, ঊমা এবং পার্বতীর মূর্তি। পঞ্চম গ্যালারিটি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা এবং তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতির উপকরণ দিয়ে সাজানো। এই সংগ্রহশালার সবচেয়ে দামি সংগ্রহ হলো 12'শ শতকের কালোপাথরের একটি গঙ্গামূর্তি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া থেকে এটি পাওয়া গেছে।
ষষ্ঠ গ্যালারিতে রয়েছে আরবী, ফাসর্ী ও বাংলা শিলা লিপি সোমপুর ও মহাস্থানগড় থেকে সংগ্রহীত নান প্রাচীন মূর্তিও রয়েছে এই গ্যালারিতে। সপ্তম গ্যালারিতে রয়েছে মুসলিম শাসনামলের সব নিদর্শন। অষ্টম গ্যালারিটি একটি আধুনিক শিল্পকর্ম। রূপসী বাংলা শিরোনামে এটি মাটি দিয়ে তৈরি একটি মঞ্চ বিশেষ যেখানে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের চিত্ররূপ ফুটে উঠেছে।
এছাড়াও রাজশাহী নগর ক নামে একটি গ্যালারি সমপ্রতি সিটি করপোরেশেনের প্রায় তিন লাখ টাকায় নির্মিত হয়েছে। অচিরেই এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হবে। আরেকটি গ্যালারিতে নতুন করে ঠাঁই পাবে সাঁওতাল, মুরারি, ওরাং, মুণ্ডা, মালপাহাড়ী ও রাজবংশীসহ নানা আদিবাসীদের ঐতিহ্যের নিদর্শন।
বরেন্দ্র যাদুঘরের লাইব্রেরিতে রয়েছে 12 হাজার বইয়ের এক দূর্লভ সম্ভার। একটি ফটোগ্রাফী শাখাও রয়েছে যাদুঘরে। এ শাখায় স্থান পেয়েছে দূর্লভ সব ফটোগ্রাফী। শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত এই যাদুঘরে প্রবেশ করতে কোনও টিকিটের প্রয়োজন হয় না। বৃহস্পতিবার ছাড়া সপ্তাহরে অন্য দিনগুলিতে যাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত। শনিবার থেকে বুধবার 10 টা থেকে সাড়ে 5 টা এবং শুধু মাত্র শুক্রবার যাদুঘর দুপুর 2 টা থেকে 5টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে শীত কালে সকাল 10 থেকে বিকেল সাড়ে 4টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকে বরেন্দ্র যাদুঘর।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৩:৫৫
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বস্তিবাসী সেই অগ্নিকন্যাকে নিয়ে লেখা একটি কাব্যগাথা

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৫৫


ঢাকার আকাশ তখন ধুলোমাখা সন্ধ্যার রঙে ছিল ডেকে
বস্তির সরু গলিতে শিশুদের কান্না
নর্দমার স্রোতের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে
সেই অন্ধকার জন্মঘরে প্রথম আলো দেখেছিল
এক বস্তিবাসী কন্যা শিরিন
এখনো এক অচেনা নাম
যার ভেতর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাবুল আলীই আমাদের বাংলাদেশের প্রতীক

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৩৭



আপনাদের কি এই ছবিটার কথা মনে আছে? এই বছরের শুরুতে চলতি বছরের জানুয়ারীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বেআইনিভাবে বাংলাদেশের জমিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ কি শিখিয়েছে?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৬






অপমান, অপদস্থ থেকে বাঁচার উপায় শিখাইনি? ওস্তাদ মগা শ্যামী পাহাড়ে বসেও এসবের সমাধান করতে পারে, আপনি সামান্য অসুস্থতার জন্যও ব্লগে মিলাদ দেননি, দোয়া করেছেন কার জন্য? খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×