সংবিধান সংশোধনীর বৈধতা-অবৈধতা
-----সুনীল শুভরায়
বাংলাদেশের যা বয়স তাতে ধারাবাহিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসন বজায় থাকলে এই সময়ের মধ্যে সাতটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে চলমান থাকত সপ্তম জাতীয় সংসদ। কিন্তু এখন চলছে নবম সংসদ। এর মধ্যে আবার দুই দফায় প্রায় ৮ বছর চলে গেছে সামরিক শাসনের অধীনে। তারপর ২ বছর গেছে আর একটি ‘সিভিল সামরিক’ শাসনের মধ্যে। ২৯ বছর যে নির্বাচিত সরকারের শাসনাধীনে থাকা গেছে এর মধ্যে নয়টি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই নয় সংসদের মধ্যে পাঁচটি সংসদ মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। তিন সংসদের মেয়াদ পূরণ হয়েছে এবং বর্তমান নবম সংসদ চলছে। পাঁচটি সংসদ যে মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি, তার জন্য দায়ী কিন্তু রাজনীতিকরাই। কেনো একটি সংসদের মেয়াদ মাত্র ১১ দিন হয়, তার কারণ উল্লেখ নিস্প্রয়োজন। অথচ এই ১১ দিনের সংসদও বাংলাদেশের সংসদের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে এবং এই সংসদের ক্রমিক ষষ্ঠ। ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচন নামে খ্যাত- এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্প সময়ের সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই রকম একটি সংসদও তালিকায় স্থান পেয়েছে, কারণ এই সংসদ সংবিধানে একটি সংশোধনী সংযোজন করেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী নামে পরিচিত এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে এক বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। সামরিক শাসনেরও একটা দিক থাকে- অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের সমর্থনও লাভ করে। কিন্তু ষষ্ঠ সংসদের কোনো দিকই ছিল না। যে কারণে সেই সংসদ স্বল্প স্থায়ী হয়েছে। অথচ এই সংসদও গণতান্ত্রিক ইতিহাসে জায়গা পেয়েছে সংবিধানে একটি সংশোধনী যোগ করার জন্য। সংবিধানের সংশোধনী প্রসঙ্গটা এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
আমাদের সংবিধান আবার সংশোধনের পথে রয়েছে। তবে এই সংশোধনী ৩৮ বছর পেছনের ১৯৭২-এর সংবিধানে নিয়ে যাবে, নাকি ‘ভিশন টুয়েন্টি টুয়েন্টি’-এর সাথে যুগোপযোগী করা হবে, সেটাই দেখার বিষয়। তবে একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, বর্তমান ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এখন অন্তত আগামী দিনের ২০ কোটি মানুষের উপযোগী সংবিধান প্রণয়নের আর কোনো বিকল্প নেই। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে উচ্চ আদালত অবৈধতার দায়ে। এই অবৈধ সংশোধনী বাতিলের মধ্যে আবার একটি বৈধ সংশোধনী বাতিল করার সিদ্ধান্ত বৈধ রাখা হয়েছে। কারণ পঞ্চম সংশোধনীর মধ্যে চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছিল। উচ্চ আদালত সেই বাতিলকে বৈধ রেখেছে। ১৯৭২-এর সংবিধান আর পঞ্চম সংশোধনীর মধ্যকার সময়ের মধ্যে আরো চারটি সংশোধনী হয়েছে। চতুর্থ সংশোধনী বাদ গেলেও বাকি থাকে আরো তিনটি। এই তিন সংশোধনীর মধ্যে দ্বিতীয় সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা বলবৎ আইন সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে। এই জরুরি আইনের বিরুদ্ধে সব সময় সকল বিরোধী দল সোচ্চার থেকেছে। কিন্তু ক্ষমতায় যাবার পর কেউই আইনটি সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করেননি। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগের আগে এই জরুরি আইন প্রত্যাহার সংক্রান্ত অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু পদত্যাগের পর তাকেই সেই বাতিল করা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। কথিত আছে, যিনি গিলোটিন তৈরি করেছিলেন, তাকেই প্রথম ওই গিলোটিনের নিচে গলা বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস- বাতিল করা জরুরি আইন যারা ব্যবহার করেছিলেন, এক সময় ওই আইনেই তাদের আটক হতে হয়েছে। অর্থাৎ ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ওই আইনের বলেই দমন-পীড়নের কাজটি সম্পাদন করেছেন। যা হোক এই আলোচনায় সংবিধানের সংশোধনীর বৈধতা-অবৈধতা প্রসঙ্গের মধ্যে থাকতে চাই।
যুগ এবং পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অতীত অবস্থার পরিবর্তন আনতেই হয়। সংবিধানও সেই নিয়মের বাইরে থাকতে পারে না। ’৭২-এর সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর অনিবার্য প্রয়োজনেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনীয়তার জন্য সংবিধানে প্রথম সংশোধনী আনতে হয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা বলবৎ আইন এবং তৃতীয় সংশোধনীতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভূমি সীমানা চিহ্নিতকরণ আইন সংবিধানে সংযোজন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীতে একদলীয় ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম এবং মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে এসে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত বিষয় হচ্ছে: উচ্চ আদালতে এই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়া। মূলত অষ্টম সংশোধনী বাতিলের জন্য যেভাবে হাইকোর্টে রীট হয়েছিল, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের জন্য সেভাবে মামলা হয়নি। অষ্টম সংশোধনীটি ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংসদে পাস হয়। এই সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয় এবং সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর ও বরিশালে হাইকোর্টের ৬টি বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে তিনটি রিট পিটিশন পেশ করা হয়। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশনগুলো খারিজ করে দেয়। অতপর এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। আপিল বিভাগ ৩১ দিন শুনানি শেষে চারজন বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত ফুল কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে (সর্বসম্মত নয়) অষ্টম সংশোধনীর শুধু ১০০ অনুচ্ছেদের সংশোধন সংক্রান্ত অংশটি অর্থাৎ হাইকোর্টের ৬টি বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। ফলে অষ্টম সংশোধনীর বাকি অংশ বহাল থেকে যায়। এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, সংবিধানে এ পর্যন্ত যতগুলো সংশোধনী হয়েছিল- তার মধ্যে সবচেয়ে জনকল্যাণমুখী সংশোধনীর অংশ ছিল দেশের ৬টি শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা। এতে সাধারণ মানুষের বিচারপ্রাপ্তি সহজ হয়েছিল। আর ব্যবসায়িক অসুবিধা হয়েছিল ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রথিতযশা আইনজীবীদের। শেষ পর্যন্ত আইনের মারপ্যাচের সুবাদে ব্যবসায়িক স্বার্থই জয়ী হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত যে মামলাটি হয়েছে, সেটি মূলত মুন সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে একটি মামলা। মাননীয় বিচারক এই মামলার সঙ্গে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী টেনে এনেছেন। যেহেতু সামরিক শাসনামলে মুন সিনেমার মালিকানা সংক্রান্ত মামলার রায় হয়েছিল, সে কারণে আদালত ওই শাসনামলকেই অবৈধ বলেছেন। কিন্তু এখানে আবার স্ববিরোধিতাও আছে। রায়ে এক দিকে যেমন বলা হয়েছে, সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা যায় না। আবার ওই রায়ের মধ্যে সামরিক ফরমানের কিছু বিষয় বৈধও রাখা হয়েছে। তবে আলোচিত বিষয় হচ্ছে আদালত পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে। এই ফর্মুলার মধ্যে ফেলে সপ্তম সংশোধনীও বাতিল করার সুর উঠেছে। বলা হচ্ছে, জিয়াউর রহমানের মতা গ্রহণকে বৈধ করা পঞ্চম সংশোধনী যদি বাতিল হতে পারে তাহলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতাগ্রহণ বৈধ করা সপ্তম সংশোধনী কেনো অবৈধ হবে না। এর জন্য চট্টগ্রামের জনৈক খুনীর শাস্তি বিধানের বিরুদ্ধে আদালতের একটি মামলার সূত্র ধরে সপ্তম সংশোধনী ধরে টানাটানি চলছে। এ ব্যাপারে গত ১০ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত “অনিবার্য পরিস্থিতির সাংবিধানিক বৈধতা সপ্তম সংশোধনী বাতিল হতে পারে না” শিরোনামের এক নিবন্ধে কিছু আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে আরো কিছু আলোচনা আছে। আলোচনায় কোনো ফল আসে না সত্য কিন্তু পাঠক মহলে তো একটা ধারণা আসে- কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কোনটা ন্যায় বা কোনটা অন্যায়। পঞ্চম আর সপ্তম সংশোধনীর মধ্যে মৌলিক তফাৎ অনেক। পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের মূলনীতির ওপর আঘাত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান পরিপন্থি কোনো আইন অবৈধ ঘোষণা করতে পারে- সেটা সংবিধানেই আছে। এই সংশোধনীতে নির্দিষ্ট একটি সময়ের কর্মকাণ্ডকে শুধু আইনি বৈধতা দেয়া হয়নি, সেখানে সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন করা হয়েছে। আর সপ্তম সংশোধনীতে শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয়া হয়েছে।
পঞ্চম সংশোধনীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সম্পাদিত সকল কর্মকাণ্ড বৈধ করা হয়। এখানে লণীয় বিষয় হচ্ছে, জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের দায়-দায়িত্ব নিতে গেলেন কেনো? এর ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জেনারেল জিয়া প্রত্যক্ষভাবেই ১৫ আগস্টের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার দায়িত্ব গ্রহণকে তো তথাকথিত সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাগ্রহণ বলে প্রচার করা হয়। যা বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত হয়, সেটা তো গণরায়ে বৈধ বলে বিবেচিত হয়ে যায়, নতুন করে বৈধতার কি প্রয়োজন থাকতে পারে। আর প্রয়োজন হলেও তিনি ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের বৈধতা নিতে পারতেন। ১৫ আগস্ট থেকে দায়-দায়িত্ব নিতে গেলেন কেনো।
এবার আসা যাক সপ্তম সংশোধনীর কথায়। ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আনা হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী বিচারপতি নুরুল ইসলাম বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। এই সংশোধনীতে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে এই সংশোধনী গৃহীত হওয়া পর্যন্ত (১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর) সময়ের মধ্যে সামরিক সরকার কর্তৃক ঘোষিত সকল ফরমান, আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, নির্দেশ, অধ্যাদেশসহ যাবতীয় সরকারি কার্যক্রম অনুমোদন করে এবং এতে আরো বলা হয় যে, এগুলোর বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না এবং এগুলো বৈধভাবে প্রণীত হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়।
এই সংশোধনীতে আরো বলা হয় যে, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বরের মধ্যে যে সকল পদে নিয়োগ করা হয়েছে সে সকল নিয়োগ বৈধভাবে প্রদান করা হয়েছে বলে গণ্য হবে। এবং এ সম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না এবং কোনো ব্যক্তি উক্ত মেয়াদের মধ্যে উক্ত ফরমানের অধীনে এমন পদে নিযুক্ত হয়ে থাকলে তিনি ওই পদে বহাল থাকবেন। এতে আরো বলা হয় যে, উক্ত মেয়াদের মধ্যে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যে সকল পদে নিয়োগ প্রদান করেছেন, সে সকল পদ যদি উক্ত আইন প্রবর্তনের তারিখের পরও বহাল থাকে, তাহলে উক্ত তারিখ হতে সে সকল পদে নিয়োগ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর আর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে এই যে, এতে বলা হয়েছে- উক্ত ফরমান বাতিল এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে ১৯৭২ সালের সংবিধান সম্পূর্ণরূপে পুনরুজ্জীবিত ও বহাল হবে এবং তা এমন কার্যকর ও সক্রিয় থাকবে যেনো এটি কখনো স্থগিত ছিল না।
সপ্তম সংশোধনীর এই সংক্ষিপ্তসার থেকেও এটা স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, এটা কোনোভাবেই বাতিল সম্ভব নয়। তাহলে ওই সময়ে যেসব নিয়োগ হয়েছিলো, তাও অবৈধ হয়ে যাবে। সেই সময়ে যে দুটি বিসিএস পরীক্ষা হয়েছে এবং তার মাধ্যমে যারা নিয়োগ লাভ করেছেন, তাদের নিয়োগও বাতিল হবে। অন্যসব কথা বাদই দিলাম। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের পদে অধিষ্ঠিত থাকার বয়সের মেয়াদ ৬২ বছর থেকে ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এখন যদি সপ্তম সংশোধনী অবৈধ বা বাতিল করা হয়, তাহলে তো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের পদে থাকার বয়সের মেয়াদটাও অবৈধ হয়ে যাবে। তাহলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ যাদের বয়স ৬২ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে তারা যে সফল বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন বা যে সকল রায় দিয়েছেন, তাও কি অবৈধ হয়ে যাবে না? এক্ষেত্রে রায়টা কেমন হতে পারে-? পঞ্চম সংশোধনীর মতো? স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বৈধ থাকবে আর বাকিগুলো অবৈধ হয়ে যাবে?
সপ্তম সংশোধনী হচ্ছে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিঁড়ি। সংসদে এই সংশোধনী বিলটি পাসের সময় সরকারি-বিরোধী মিলিয়ে ২২৩ জন সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাদের সকলের সর্বসম্মত ভোটে সংশোধনীটি পাস হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের সদস্যরা তখন সংসদে উপস্থিত ছিলেন না। ৫ ঘণ্টা স্থায়ী এই অধিবেশনে বিরোধী দলীয় সদস্যদের মধ্যে জাসদ (রব)-এর ৪ জন, মুসলিম লীগের ৪ জন, শাজাহান সিরাজের জাসদের ৩ জন, বাকশালের ২ জন এবং স্বতন্ত্র সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী সংসদে উপস্থিত থেকে সপ্তম সংশোধনী বিল পাসের পক্ষে ভোট প্রদান করেন। এই অধিবেশনে বিরোধী দলের সদস্যরা বলেন, দেশ থেকে সামরিক আইন অবসানের লক্ষ্যে তারা সপ্তম সংশোধনী বিলে সমর্থন দিয়েছেন। তারা বলেন, গত সাড়ে চার বছর আন্দোলন করে সামরিক শাসন অবসান হয়নি এবং গণতন্ত্র ফিরে আসেনি। এখন এই বিল পাসের মাধ্যমে সামরিক শাসন অবসান হবে এবং ভবিষ্যতে দেশে আর সামরিক শাসন আসবে না (দৈনিক বাংলা-১১ নভেম্বর ৮৬)। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সপ্তম সংশোধনী পাসের মাধ্যমে নতুনভাবে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। এখন যদি এই সংশোধনী বাতিল করা হয় বা এটাকে অবৈধ বলা হয়, তাহলে বহাল হবে কিংবা বৈধ হবে কোনটা? সপ্তম সংশোধনী পাসের আগে তো দেশে সামরিক আইন ছিল। ওই সময়টার কী হবে? যে কোনো সংশোধনী পাস করেন আইনসভার সদস্যরা। তাদের পাস করা আইন যদি অবৈধ হয়, তাহলে আইনসভার বৈধতা থাকে কীভাবে? তবে সংবিধানের পরিপন্থি যদি কোনে আইন প্রণয়ন করা হয়, সেটা হয়তো সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। যেমন করেছিলেন অষ্টম সংশোধনীর ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর করেও প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আইন পাস করে নিতে পারতেন। সে এখতিয়ার সংসদের আছে।
সপ্তম সংশোধনী বিলের ওপর আলোচনয় তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, যারা গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা চায় না, তারাই সপ্তম সংশোধনীর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭২-এর স্বাধীনতার ঘোষণাসহ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত গৃহীত সকল সিদ্ধান্ত ঘোষণা, আদেশ ও অন্যান্য সকল কার্যক্রমকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা দেয়া হয়েছিল ৭২-এর সংবিধানে। এই বিল পাসের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে; সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। যে সকল দল বিশৃঙ্খলা চেয়েছিল তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাংবিধানিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রেসিডেন্ট এরশাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন (দৈনিক বাংলা ১১/১১/৮৬)।
১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর সপ্তম সংশোধনী পাস হওয়ার দিনেই রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে দেশ থেকে সামরিক আইন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এই ভাষণে তিনি বলেন, “স্থগিত সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করা হলো। গণতন্ত্র উত্তরণের যে পবিত্র প্রতিশ্রুতি আমি সাড়ে চার বছর আগে দিয়েছিলাম, আজ তার শেষ ধাপটি আমরা অতিক্রম করলাম। তাই আর কোনো বিদ্বেষ নয়, সংঘাত নয়, দলীয় সংকীর্ণতা নয়, আসুন দেশ ও জাতিকে আমরা সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেই। গণতন্ত্রের যে বীজ আজ অঙ্কুরিত হলো- আমাদের সযত্নে লালনে তা মহীরুহ হবে। গণতন্ত্রের যে কাঠামো আমরা নির্মাণ করলাম- আসুন তাকে দেই আমরা দৃঢ় ভিত্তি ও স্থায়িত্ব। বাংলাদেশের জনগণ বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমি এবং আমার সরকার গণতান্ত্রিক সমাজে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের অব্যাহত বিকাশের পূর্বশর্ত হলো মতাদর্শগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও পরমত সহিষ্ণুতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। যে সমাজে সহিষ্ণুতা নেই সে সমাজে গণতন্ত্র ধারণ ক্ষমতাও থাকতে পারে না।” সপ্তম সংশোধনী পাসের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের সময়ে গণতন্ত্র সম্পর্কে এটাই ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উক্তি। এখন এসব কথার কি মূল্যায়ন হতে পারে এবং এর কতটুকু বিচার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে- সেটা হয়তো আগামী সময়ই বলে দেবে।
একটা করলে অনুরূপ আর একটাও করতে হবে- এই ফর্মুলা অনুসারে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ হতে হবে- এমন কথা উঠে এসেছে। সামরিক আদালতে এক ব্যক্তির খুনি সাব্যস্ত হওয়ার মামলার রায় নিয়ে যদি গোটা শাসন ব্যবস্থা বদলানোর প্রশ্ন আছে- তাহলে দেশের আইন, শাসন, বিচার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, সরকারি চাকরি, নিয়োগ, বদলি থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। নিশ্চয় সেই বিপর্যয় নেমে আসবে না। এই ধরনের মামলা প্রসঙ্গে- উচ্চ আদালত সামরিক আইন অবৈধ ঘোষণা এবং আগামীতে কোনোভাবেই সামরিক আইন জারি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বলা বাহুল্য যে, সামরিক আইন জারি কোনো কালেই বৈধ ছিল না। এই আইনের অধীনে সংঘটিত কার্যক্রমকে সাংবিধানিকভাবে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এটা সুনির্দিষ্টভাবে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হলে- ওই আইনটাই বাতিল হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থা সাংবিধানিক আইন করে বন্ধ করা যায় না। এ পর্যন্ত আমাদের দেশে যে দুইবার সামরিক শাসন জারি হয়েছে তার কোনো বারেই সংবিধান বাতিল করা হয়নি। সংবিধান স্থগিত রাখা হয়েছে এবং একটা সময়ের ব্যবধানে তা আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে যদি সুনির্দিষ্ট করে সামরিক আইন নিষিদ্ধ করার ধারা যুক্ত থাকে, তাহলে খোদানাখাস্তা যদি কখনো ওই ধরনের কিছু ঘটে যায়, তাহলে প্রথমেই তো যে অস্ত্র তাদের গলায় বসবে- সেটাই নির্মূল করে নতুন করে সংবিধান সাজানো হবে। সামরিক শাসনের মতো কোনো ধরনের অপশাসন ঠেকানোর জন্য তো কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হয় না। যথার্থভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করলেই তো শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো আপদ-বালাই আসার আশঙ্কা থাকে না। এখন কীভাবে সকলেরই প্রত্যাসিত এই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারে তার উত্তর পেতে গণতন্ত্র সম্পর্কে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উল্লেখিত উক্তি বিশ্লেষণ করাই তো যথেষ্ট।
অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রসঙ্গ এনে সংবিধানের সংশোধনী আবার পরিশুদ্ধ করার কথা আসছে। সাংবিধানিক বা অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা গ্রহণের জন্য শুধু সামরিক কর্মকর্তাদের দায়ী করা হবে আর যারা একইভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন- তারাইবা বাদ যাবেন কেনো? সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন ২ জন। তারা হলেন জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ। একইভাবে অসাংবিধানিক পন্থায় ২ জন বিচারপতিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তারা হলেন বিচারপতি সায়েম এবং বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী। বিচারপতিদের মধ্যে আর একজন বিচারপতি সাত্তার একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেই সামরিক আইন জারি করে দিয়েছেন। মহামান্য আর এক বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করলেও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেননি। আর সে কারণেই তার কার্যক্রম বৈধ করতে সংবিধানে আর একটি সংশোধনী আনতে হয়েছে। তৎকালীন সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি ছিলেন রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান। তখন তিনি সংসদ ভেঙে দেয়ারও ক্ষমতা রাখতেন। যেমন রাষ্ট্রপতি হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন নির্বাহী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে দেশে চতুর্থ জাতীয় সংসদ বিদ্যমান ছিল। তিনি সেই সংসদ ভেঙ দেয়ার ঘোষণা না দিয়ে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন। এই ভুলের কোনো সংশোধনী হতে পারে না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের কার্যক্রম সাংবিধানিক ছিল না বলেই পঞ্চম জাতীয় সংসদকে একাদশ সংশোধনী বিল পাস করিয়ে নিতে হয়েছে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট পঞ্চম জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে পাস হওয়া এই সংশোধনীতে বলা হয়েছে “১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এরশাদ কর্তৃক প্রধান বিচারপতিকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ, শপথ প্রদান এবং তার নিকট পদত্যাগ বৈধ বলে গণ্য হবে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হতে অত্র সংশোধনী প্রবর্তনের তারিখ পর্যন্ত সময়ে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রয়োগকৃত যাবতীয় ক্ষমতা, প্রণীত সকল আইন ও অধ্যাদেশ এবং প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত অথবা প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত বলে বিবেচিত, সকল আদেশ, সকল কার্যক্রম এবং সকল ব্যবস্থা এবং এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হলো এবং আইনানুযায়ী যথাযথভাবে প্রণীত, প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত বলে গণ্য করা হবে।” এখানে লক্ষণীয় যে, সপ্তম আর একাদশ সংশোধনীর মধ্যে ভাষাগত দিকে শুধু পার্থক্য হচ্ছে- সপ্তম সংশোধনীর “সামরিক সরকারের” স্থলে একাদশ সংশোধনীতে “উপরাষ্ট্রপতি” রয়েছে। সুতরাং এটাও হিসাবের কথা যে, যা বৈধ করতে হয়, তা এক সময় অবৈধ ছিল। অতএব একই গোত্রের ২টা ‘বৈধের’ মধ্যে যদি একটা অবৈধ ঘোষণা করা হয়, তাহলে বাকিটা বাদ যাবে কেনো? কিন্তু এভাবে যদি বৈধ-অবৈধ বাছাই চলতেই থাকে- তাহলে বৈধ বলতে কিছুই যেমন খুঁজে পাওয়া যাবে না, আবার বর্তমানের পরিশুদ্ধটাও আগামীতে অশুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
সংবিধানের একটি ঐতিহাসিক সংশোধনী হচ্ছে- দ্বাদশ সংশোধনী। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট পঞ্চম জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে এই সংশোধনীটি পাস হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৬ বছর পর দেশে আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের স্থলে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭২-এর মূল সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় সংসদ চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তবে দ্বাদশ সংশোধনীর সরকার ব্যবস্থা এবং ৭২-এর সরকার ব্যবস্থার মধ্যে একটু পার্থক্য রয়েছে। ৭২-এর সংসদীয় পদ্ধতিতে ছিল মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা। আর দ্বাদশ সংশোধনীতে যে সংসদীয় পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হয়- তাতে রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। এর ফলে রাষ্ট্রে এক ব্যক্তির ক্ষমতা প্রশ্নে মূলত “রাষ্ট্রপতি” শব্দের স্থলে “প্রধানমন্ত্রী” শব্দটি স্থাপিত হয়েছে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা বিএনপি দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনে। লক্ষণীয় যে, বিএনপির গঠনতন্ত্র কিংবা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের কোথাও সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা নেই। দলগতভাবে বিএনপি প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থাতেই বিশ্বাসী। কিন্তু তারা সংসদীয় পদ্ধতি বরণ করল কেনো- সে ব্যাপারে একটা কথা আছে। মূলত ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ফলাফলই রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের সব পথ পরিবর্তন করে দিয়েছে। ওই নির্বাচনে আন্দোলনের মুখে পতন হওয়া জাতীয় পার্টি সকল ধরনের প্রতিকূলতার মুখে ৩৫টি আসনে জয়ী হবে- সে ধারণা কারোরই ছিল না। তদুপরি জাতীয় পার্টির প্রধান- যাকে ক্ষমতা ছাড়ার পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে কারাবন্দী করা হয়েছে- সেই সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে বসে ৫টি আসনে বিজয়ী হওয়ার পর চিন্তাভাবনার দৃশ্যপটই পাল্টে যায়। কারণ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অনেকেরই মোহমুক্তি ঘটতে শুরু করে। সাধারণ মানুষ পূর্বাপরের মধ্যে যোগ-বিয়োগ করতে থাকে। এই অবস্থার মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে থেকেও সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে কী ফল হতে পারে সেই আতঙ্কে পেয়ে বসে ক্ষমতাসীন বিএনপিকে। সে কারণেই তারা সংসদীয় পদ্ধতি বেছে নেয়। ওই দ্বাদশ সংশোধনী বিএনপির আদর্শেও ফল নয়- আতঙ্কের আত্মরা মাত্র। তবে সংশোধনীতে যা করা হয়েছে- তাতে রাষ্ট্রপতির সরকার ব্যবস্থা থাকলেও কার্যত যা হয়ে থাকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে তাই হচ্ছে।
সর্বশেষ, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর কথায় আসা যাক। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি উদ্ভব হওয়ার পেছনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে এই সংশোধনী। কারণ এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো হয়েছে- যাতে করে বিএনপির এক সময়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসান পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পরেন। এই ইস্যুতেই বিরোধী দল আন্দোলন করার সুযোগ পেয়েছে। তবে শুধু এই সংশোধনীর জন্যই যে বিরোধী দল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে- তাও নয়। জামাত-বিএনপির সরকার পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ভেঙে দিয়েছিল প্রায়। সংবিধানের সব বিকল্প পথ অনুসরণ না করে দলীয় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ, হাইকোর্টে দায়ের করা মামলা প্রধান বিচারপতিকে পরিচালনা করতে না দেয়া, নির্বাচন কমিশনে দলীয় লোক নিয়োগ করা, ভোটার তালিকায় কোটি খানেক ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা, মাঠ পর্যায়ে দলীয় ক্যাডারদের নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ করা এবং সর্বশেষ প্রতিহিংসাবশত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচন করতে না দেয়ার প্রক্রিয়া- ইত্যাদি কারণে ওয়ান ইলেভেনের মতো একট বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। এ ছাড়াও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অবাধ লুটপাট, সীমাহীন দুর্নীতি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিতশ্রদ্ধভাব সৃষ্টি করে দেয়। ফলে বিভিন্ন কারণে ওই সময়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ওয়ান-ইলেভেন না আসলে এবং ওয়ান-টুয়েন্টিটু-এর নির্বাচনের প্রচেষ্টা চালানো হলে- দেশে হয়তো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতো। সুতরাং ওয়ান-ইলেভেন আসা যদি কোনোভাবে অপরাধ হয়ে থাকে- তার সম্পূর্ণ দায়ভার তৎকালীন রাজনৈতিক সরকারের। অতএব আইন করে এসব শাসনের পথ রুদ্ধ করা যায় না। শুধু সংবিধান সংশোধন বা সংশোধনী সংশোধন করলেই অবৈধ ক্ষমতা দখল বন্ধ হবে না। যারা সংশোধন করবেন- সেই রাজনীতিবিদদেরও সংশোধীত হতে হবে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসার জন্য সামরিক বাহিনীকে দায়ী করা হয়। কিন্তু তাদের সহযোগিতায় যারা এগিয়ে আসেন, তাদের অধিকাংশই তো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সংবিধানের যা কিছু সংশোধন করা হয়েছে, তাতো রাজনীতিবিদরাই করেছেন। সুতরাং এখন আবার তা নিয়ে বৈধতা-অবৈধতার প্রশ্ন আসবে কেনো। যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে। এখন আগামীকে নিয়ে ভাবাই কী শ্রেয় নয়!
সুনীল শুভরায় : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




