সারাদেশ যখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের আনন্দে উন্মাতাল, তখন বাংলাদেশ ফিফার পক্ষ থেকে হয়তো আরেকবার লাল কার্ড পেতে যাচ্ছে। কারন, ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে আবার সেই “বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম”। বিসিবির কুটকৌশলী শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিদের জিহবা আবার সীমাহীন লোভে লকলক করে উঠেছে “বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম” কে আবারো ক্রিকেট স্টেডিয়াম বানাবার জন্য ( ৩৫ কোটি টাকা লোপাট করেও পেট ভরেনি)। তারা চাইছে এই স্টেডিয়ামে আবার ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসর বসাতে, ২০১৪ সালের টি-২০ ক্রিকেটের স্বাগতিক হিসাবে তারা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম কে অন্যতম ভেন্যু হিসাবে নির্ধারন করেছে। তারা নাকি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সবাইকে ম্যনেজ করে ফেলেছে। সাংবাদিকরা যখন লোটা. কামাল কে জিজ্ঞেস করল, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম যদি ক্রিকেট নিয়ে যায় তাহলে ফুটবলের কি হবে? তখন ঐ লোটা.কামাল দম্ভের সাথে উত্তর দেয়,আমি ফুটবল নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আর এতে বেজায় চটেছেন BFF কর্তা ব্যক্তিরা। তারা ঠিক করেছেন যদি সরকার ও এই সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তারা গণপদত্যাগ করবেন।
আর এরা যদি গণপদত্যাগ করেই বসেন ফিফা তা মোটেই ভালভাবে নেবেনা। কারন আইসিসির মত ফিফা ছাগলের লাদি খাওয়া সংগঠন নয়। এদেশে ক্রিকেটের কর্তা ব্যক্তিরা সরকার বদলের সাথে সাথে বদলে যায়, এবং আইসিসি এই নিয়ে কোন মাথা ঘামায় না, এই কারনে লোটা. কামালরা সুযোগ মত বিসিবি প্রেসিডেন্ট হয়ে যায় আবার গদি যখন সরে যায় তখন লাথি খেয়ে বিসিবি থেকে চলে যায়। যেমন্টা হয়েছিল বিএনপির সাবেক এমপি এবং বিসিবি প্রেসিডেন্ট আলী আসগর লবির ক্ষেত্রে তার ও আগে সাবের হোসেন চৌধুরীর বেলায়। অন্যদিকে ফিফা সম্পূর্ন ডেমক্রেটিক প্রসেস ফলো করে।যে কেউ চাইলেই একটা দেশের ফুটবল ফেডারেশনের পদ দখল করে বলতে পারবেনা “আজ থেকে আমি-ই প্রেসিডেন্ট”। এই কথা ঘোষনার সাথে সাথে ফিফা ঐ ফেডারেশন তথা দেশকে লালকার্ড দিয়ে বহিস্কার করতে বিন্দুমাত্র ও দ্বিধা করবেনা। এজন্য কোন দেশের ই স্বৈরশাসকরা আর যা-ই করুক ফুটবলের দিকে চোখ দেয় না। আর জেনে রাখা উচিৎ, ফিফার প্রেসিডেন্ট এর মর্যাদা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সমান। বিগত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই অন্যসব ফেডারেশন গুলোর মত BFF ও দখল করে এডহক কমিটি গঠন করেছিল। আর এজন্য ফিফা নগদে বাংলাদেশ কে লাল কার্ড দিয়ে ফিফার সদস্যপদ থেকে বহিস্কার করে দিয়েছিল এবং এস.এ. সুলতান টিটুর(সাবেক BFF সভাপতি ) মত কুলাঙ্গারদের জন্য পৃথিবীর সামনে আমাদের দেশকে অপমানিত হতে হয়েছিল। শুধু পদ দখল –ই নয়, ফুটবল সংক্রান্ত যেকোন অনিয়ম, বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে ফিফা কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম, কয়েক মাস আগে ইরান ও লাল কার্ড খেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম প্রসঙ্গে যা বলছিলাম তা হচ্ছে, এই স্টেডিয়াম কয়েকবছর আগেই ফুটবলের জন্য দলিল করে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করে অ্যাথলেটিক্স এর আন্তর্জাতিকমানের ট্র্যাক বসানো হয়েছে যাতে অ্যাথলেটিক্স ও ফুটবল পাশাপাশি চলতে পারে। সেই স্টেডিয়াম ৬মাস আগে বিসিবি দখল করে তার উন্নয়ন কাজ চালিয়েছে ২ ঘন্টার একটা উদ্বোধনী প্রোগ্রাম চালানোর জন্য। সচেতন মহল জানে, শুধুমাত্র “বঙ্গবন্ধু” নামটাই এর প্রধান কারন যেটা দিয়ে শেখ হাসিনা কে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে লোটা. কামাল গং তার নেকনজরে থাকতে পারে এবং সম্প্রতি শেয়ার কেলেংকারীর অন্যতম হোতা হয়েও পার পেয়ে যেতে পারে(লোটা. কামালের কোম্পানি সিএমসি কামাল)। এখন যদি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম আবার ক্রিকেট কে দেয়া হয় তবে আমাদের ফুটবল আরো তলিয়ে যাবে এবং এই অ্যাথলেটিক্স এর আন্তর্জাতিকমানের ট্র্যাক উঠিয়ে ফেলতে হবে তথা ঐ ১০ কোটি টাকা ফেলে দিতে হবে।
এদিকে “বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম” ক্রিকেটের স্বার্থে উদার মনেই ছেড়েছিলেন BFF প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দিন। পরে তিনি বিসিবি কে অনুরোধ করেছিলেন বেকার পড়ে থাকা ফতুল্লা স্টেডিয়াম টা যেন কিছুদিনের জন্য ফুটবল চালানোর জন্য দেয়া হয়, তিনি ভেবেছিলেন তার মত বিসিবিও উদার মনে তা মেনে নেবে। অন্ততঃ চক্ষুলজ্জা বলেও তো কিছু আছে। কিন্তু হায় বিধি বাম! ঐ স্টেডিয়াম চাওয়ার অপরাধে অর্থ গর্বে গর্বিত তথাকথিত ক্রিকেট অফিসিয়ালরা সালাউদ্দিনের মুন্ডুপাত করেছে। এই নির্লজ্জের দল পেশাদার ফুটবল লীগের চট্টগ্রাম আবাহনী ও চট্টগ্রাম মোহামেডান কে চিটাগং এম এ আজিজ স্টেডিয়ামকে হোম ভেন্যু করতে দেয়নি ক্রিকেটের জন্য! পরে এই দুই টিম বান্দরবান কে ভেন্যু বানিয়েছে।
ওদিকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধণী অনুষ্ঠান এর জন্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ছেড়ে দেয়ায়, BFF ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তারা ২০১০ সালে সারা জাগানো কোটি টাকা প্রাইজমানির সুপারকাপ আয়োজন করতে পারেনি। কারন স্পন্সররা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বাইরে অন্য স্টেডিয়ামে সুপারকাপ স্পন্সর করতে রাজী নয়। অথচ এই সুপারকাপ শুধু বাংলাদেশেরি সবচেয়ে বড় প্রাইজমানির টুর্নামেন্ট নয় সারা এশিয়াতে এত বড় প্রাইজমানির টুর্নামেন্ট খুব কম আছে। তাছাড়াও, ২০১০ ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের বছর, এইসময় ফুটবলের যে জোয়ার ছিল সেই জোয়ারে সুপারকাপের মত একটা টুর্নামেন্ট করতে পারলে তা হত সোনায় সোহাগা। এতে ফুটবলের যে ক্রান্তিকাল চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্য যে বিপুল পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন, তা বেশ ভালোই পাওয়া যেত।
সচেতন ক্রীড়ামোদিরা একটা জিনিস ভেবে দেখেন, ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশে ম্যাচ হবে মাত্র ৮টা, মূল ভেন্যু মাত্র ২ টা। এই ৮ ম্যাচ আয়োজনের জন্য বিসিবি ঢাকা ও চিটাগং এর প্রায় সব প্রধান স্টেডিয়াম দখল করে বসে আছে যেগুলির বেশির ভাগেই ফুটবল ম্যাচ হয়। তো এই ৮ ম্যাচের জন্য এতগুলি স্টেডিয়াম লাগলে ফুটবলের পেশাদার লীগ থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক, পায়োনিয়ার, স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে তো কয়েকশো ম্যাচ, সেখানে কতগুলি স্টেডিয়াম দরকার? আর আমাদের আছে কতগুলি স্টেডিয়াম? আচ্ছা তর্কের খাতিরে মানলাম বিশ্বকাপ আর পেশাদার ফুটবল লীগ এক নয়, তাই বলে কি ফুটবলের জন্য নির্ধারিত স্টেডিয়াম কয়েক মাসের বরাদ্দ পাবার সুযোগে দখল করে ফেলতে হবে? ক্রিকেটে ভালো করছি বলে আর ফুটবলে ভালো করার দরকার নেই, আর খেলার ই বা দরকার কি এই যুক্তি কি সমর্থন যোগ্য? আচ্ছা! আমাদের ফুটবল কি একসময় সম্মানজনক পর্যায়ে ছিল না? ফুটবলে কি বাংলাদেশ দক্ষিন এশিয়ায় সেরা দল নয়? প্রথম সুপারকাপের ফাইনালে কি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাধভাঙ্গা দর্শকের ঢল নামেনি? এতে কি ফুটবলের জনপ্রিয়তা যে এখনো আছে তা প্রমান হয়না?
যেসব কুচক্রীরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম দখল করার দিবা স্বপ্ন দেখছে, তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশের ফুটবলের শেকড় অনেক গভীরে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যদি কোন খেলার অবদান থাকে তবে সেটা ফুটবল, আমাদের স্বাধীনবাংলা ফুটবল দল যুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ফুটবল ম্যাচের মাধ্যমে যেমন ব্যাপক প্রসংসা কুড়িয়েছে তেমনি আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, যে কারনে আজও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বাধীনবাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা জীবিত-মৃত নির্বিশেষে সংবর্ধনা পান। কারন তারা ফুটবল নিয়ে পাক-হায়েনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। আমি জানি না বিশ্ব-ইতিহাসে মুক্তির সংগ্রামে এমন উদাহরন আর কয়টা আছে।
সবশেষে বলতে চাই, কোন মানুষ-ই চাইবেনা তার এক হাত রেখে অন্য হাত কেটে ফেলতে। কারন দুটোই দরকার। ক্রিকেট যেমন আমাদের, তেমনি ফুটবল ও আমাদের। আমরা দুটোতেই জয় চাই। আশা করব, শেখ হাসিনা, আপনি অন্তত বংলাদেশের ফুটবলের এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ভাগা-ভাগি করতে দেবেন না। আমাদের সালাউদ্দিন ও আপনার বাপের নাম সারা দুনিয়াকে মুখস্থ করাতে International Bangabondhu Cup আয়োজন করতে পারে। যেখানে বিদেশী ধারাভাষ্যকাররা বারবার বলবে এবং ফেনা তুলে ফেলবে, “This is the final match of International Bangabondhu Cup where Brazil will face Argentina, and the venue is Bangabondhu International Stadium and the Prime Minister of Bangladesh, Sheikh Hasina,daughter of Bangabondhu Sheikh Mujibar Rahman, is the honorable chief guest of the Final with FIFA president Sepp Blatter………”
হাসিনা খালা! আপনি আর কি চান? দয়া করে বাপের নামের স্টেডিয়ামটা ফুটবলকেই দেন নইলে লাল কার্ড টাও আপনি-ই খাবেন! চাবি আপনার হাতেই.......

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




