আজকে যখন এই লেখাটা লিখছি তখন আমার চারপাশের মানুষের আচার-আচরনে আমি বড় হতাশ, বড় ক্ষুদ্ধ। মাঝে মধ্যে ভাবি আমাদের এই মনুষ্য জীবনের সাথে পশুর জীবনের পার্থক্য কোথায়? পশুর সবকিছুই তার নিজের জন্য, অন্যের জন্য নয় কিন্তু মানুষের মধ্যেও যখন দেখি পশুর মত একই রকম নির্লিপ্ততা তখন আমার নিজের মানব জীবন প্রশ্ন-বিদ্ধ হয়।
আমার স্কুল লাইফের বন্ধু, একই এলাকায় কাছাকাছি থাকি। ওর বাবার লিভার যখন পুরোমাত্রায় এফেক্টেড, তখন তার হেপাটাইটিস ধরা পড়ে। অনেকদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বেশ কিছুদিন আগে ডাক্তার কোনমতে ওনার লিভার জোড়াতালি দিয়ে বাসায় পাঠায়। গত শুক্রবার রাত ১১ টার দিকে একটা কাজে বন্ধুর বাসায় গিয়ে জানতে পারি ওর বাবা কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কারণ তার প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে, বাসার সামনের রাস্তায় দেখলাম রক্তের বন্যার ছাপ। তখনি বন্ধু ফোনে জানাল তার বাবার রক্ত লাগবে ৮ব্যাগ ইমারজেন্সি, রক্তের গ্রুপ B+, ওকে আমি বললাম, B+ সহজেই পাওয়া যাবে, ৮ ব্যাগ না ৮০ ব্যাগ ম্যানেজ করে ফেলব তোর বাবা কোথায়? জানাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি তে ১১২ নাম্বার ওয়ার্ডে কোনমতে স্থান হয়েছে। আমি ওকে বললাম, আমার পরিচিত লোকের অভাব নাই, যেকোনো উপায়েই হোক ব্লাড ম্যানেজ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের ২০০১ ব্যাচের স্কুল ফ্রেন্ডদের ফেসবুক গ্রুপে ব্যাপারটা শেয়ার করলে অবশ্যই সাড়া পাওয়া যাবে।
বন্ধুকে আশ্বস্ত করে শুরু করলাম রক্তের জন্য “মাইন ক্যাম্ফ”। আমি এর আগে বেশ কয়েকবার ব্লাড ক্যাম্পে ভলান্টিয়ার হিসেবে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করেছি, তাই আমার জানা আছে এটা কি রকম কঠিন কাজ। পাবলিক পয়সা ছাড়তে রাজি, রক্ত নয়। তবে আশা করেছিলাম পরিচিত লোকের জন্য ব্লাড চাইলে অত কঠিন হবেনা। কাজে নেমে প্রথম প্রচেষ্টাতেই সফল হলাম, এলাকার ই এক ফ্রেন্ড অনেক গাইঁগুই করে দিতে রাজি হল। কিন্তু এরপর তো আর ব্লাড পাইনা। তারপর কাজটা আরো কঠিন হয়ে গেল যখন ডাক্তার সরাসরি ডোনারের ব্লাড দিতে বলল। একজনের পরামর্শে এরপর ফেসবুকে বিষয়টা শেয়ার করলাম, সাথে বন্ধুর মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। ফেসবুকে যাদের পেলাম তাদের সাথে সরাসরি চ্যাটে ভয়াবহ অবস্থা জানিয়ে এগিয়ে আসতে বললাম। ধুমায়া মোবাইলে ফোন দিতে লাগলাম এলাকার ফ্রেন্ডদের। শুনে সবাই খুব দুঃখ প্রকাশ করল। কিন্তু অবাক হলাম-যাদের ব্লাড ম্যাচ করে তারা নানা অজুহাত দেখাতে লাগল। কারো শরীর খারাপ, কারো প্রেশার লো, কেউ ৭দিন আগে ব্লাড দিয়েছে, কোন কোন বুড়া-দামড়া ছেলের বাপ-মা ব্লাড দিতে দেবেনা, কেউ এক বাচ্চার বাপ হয়েও ৪৫কেজি ওজন, কেউ ব্লাড দেবার কমিটমেন্ট করে মোবাইল রিসিভ করতে ভুলে গেল, কেউ নিজের জানা ব্লাড গ্রুপ ভুলে গেল। Even, আশ্চর্জনকভাবে কারো কারো B+ বদলে গিয়ে O+ হয়ে গেল। আমাদের এলাকার পরিচিত লোকজন যারা আমার বন্ধুরও পরিচিত তারাও কেউ কেউ এইরকমের আচরন করল। অনেকেই বলতে লাগল, B+ গরুর রক্ত, সহজেই পেয়ে যাবা, খুব ব্যাস্ত আছি, ব্লাড দেবার সময় নাই। আরে, B+ এর জন্য কেউ মরে নাকি? B+ available পাওয়া যায়। ইত্যাকার মন্তব্য। আমি স্তম্ভিত, হতবাক হয়ে গেলাম। কারণ এরা আমাদের কাছের লোক, তারা তো ব্লাড দিলইনা উল্টো রংবেরং এর কথা শুনিয়ে দিল।
তবে অনেকের কাছে আমি আর আমার বন্ধু ঋণী যারা ফেসবুকে যার যার পেজে মাগনা শেয়ার/লাইক দিয়ে দায় সেরেছে তাদের কাছে। আমি যেই স্ট্যাটাস টা দিয়েছিলাম সেটাই ২/১ জন কপি পেস্ট করে চালিয়ে দিয়েছে এবং পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায়ও সেগুলিতে কোন রেসপন্স নাই। এমনকি বন্ধুকে ফোন দিয়ে সান্ত্বনা দেবার প্রয়োজনও তারা কেউ মনে করেনি। স্কুলের গ্রুপে সতীর্থদের অনেকেই অনেক ভাল পজিশনে চলে গেছে। তাদের অনেকেই মোহাম্মদপুর তথা রিং রোডের আশেপাশেই থাকে, আমরাও থাকি। এই বিপদের সময় তারা at least বন্ধুর বাবা বাঁচল না মরল, এই খবর টুকুও নেয়নি। তারা হয়ত শেষ খবরটা পাবে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস টা দিলে। হয়ত এরা সেই গল্পের মত ভাবছে বাকি সবাই তো দুধ-ই ঢালবে, আমি না হয় পানি ঢালি। এভাবে সবাই পানি ঢালছে আর আশা করছে বাকিরা দুধ ঢেলে পুকুর ভরে ফেলবে। এই আমাদের বর্তমান মানসিকতা।
অনেকের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় “ভাতের বদলে মুড়ি খাচ্ছি” এই টাইপের স্ট্যাটাসে ব্যাপক লাইক, কমেন্টের বন্যা বয়। অথচ এইরকম সেনসিটিভ বিষয়ে আমরা উদাসীন থেকে ব্যাপক সামাজিক দায়িত্ব পালন করলাম। আমাদের কি কারো এই জীবনে কখনো ব্লাড দরকার হবেনা? ঐ বন্ধু গরীব, পুরি-সিঙ্গারার হোটেল চালায় তো তাই ওর বাবার লিভারে সমস্যা থাকবে, ব্লাডের দরকার হবে। ওর বাবা ব্লাড না পেয়ে মরলে কার কি এসে যায়? কতই তো মরে!!! দেশে মানুষ বেশি হয়ে গেছে, এভাবে না মরলে কমবে কিভাবে? এই আমাদের মানষিকতা!!!
মাঝেমধ্যে ভাবি, এইযে এত খাল-বিল পাস দিলাম, অনেকে বাপের লাখ-লাখ টাকা খরচা করে এত ডিগ্রি নিল, আরো কত কিছু করল, মানুষরে বুক ফুলায়া একেকজন বলল আমি অমুক জায়গার চ্যাটের বাল-তমুক জায়গার হরিদাস পাল.........এত কিছু করার পর ও আমাদের মধ্যে কি মনুষত্ব্য এসেছে? আমরা কি কারো প্রয়োজনে এগিয়ে যাই? আমরা কি কোন অসহায় মানুষের পাশে দাড়াই? এই শিক্ষাই কি আমরা এতদিন পেয়েছি? এই আমাদের লাখ টাকার কাগুজে ডিগ্রির ভেল্কিবাজি? আরেকজন কষ্টে থাকলে আমার কি? কি দরকার বেহুদা ঝামেলায় যাওয়ার?
বিপদ কখনও বলে কয়ে না আসলেও মানুষ কে চিনতে ভাল সাহায্য করে। নতুন করে অনেক কিছু শেখা যায়, এবার সেটাই শিখলাম, জানলাম। যেসব মানুষ এই ঘোর বিপদে সুযোগ থাকা স্বত্বেও হাত গুটিয়ে রাখল তাদের প্রতি কোন রকম ঘৃণা বোধ করছিনা তবে এই স্বার্থপর সমাজের আমিও অংশ, তাই নিজের প্রতি করুণা হচ্ছে, ঘৃণা বোধ করছি। আমার চোখে জল কিন্তু বুকে আছে অদম্য বল, এখনো আমাদের সব আশা মরে যায়নি। ৮ ব্যাগের B+ ব্লাডের মধ্যে এখন পযর্ন্ত ৪ ব্যাগ ব্লাড যোগাড় করতে পেরেছি। বন্ধু কে বলি, দোস্ত, তোর বাবার বাচা-মরা আমার হাতে নাই, কিন্তু তোর বাবাকে আরো ৪ ব্যাগ রক্ত যোগাড় করে না দিয়ে তাকে মরতে দেবনা......এটা আমার প্রতিজ্ঞা

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




