রাতুল ঘড়িটা দেখে নিল। হাতে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে রওনা দেয়ায় ওরা যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছে গেল। ওরা তিনজন- রাত্রি ওর সহধর্মিনী – রাশু ওদের দুবছরের ছেলে আর ও অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষে বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে আছে।
চট্টগ্রাম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো আন্তঃনগর ট্রেন। যাত্রীরা কেউ কেউ উঠে বসেছে। কেউবা দাঁড়িয়ে বা বসে প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো ছিটানো। ওরা টিকেট দেখে উঠে বসলো।
প্রথম শ্রেনী – শীততাপ নিয়ন্ত্রিত– চারজনের কামরা।
স্পীকারে হাল্কা মিউজিক বাজছে।
রাতুল মালপত্রগুলি গুছিয়ে রেখে জানালার ধারে বসলো। বাইরে ব্যস্ততা বাড়ছে।
সময় ঘনিয়ে আসছে ট্রেন ছাড়বার। আরো ২৫ মিনিটের মত সময় আছে হাতে।
রাত্রি মুখোমুখি বসতেই রাশু রাতুলের কোলে বসে উঠলো। পেশায় অর্থনীতিবিদ হলেও শখের বসে নাটক নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছে ও। আচ্ছা, খুলেই বলি – নাটকেও মাস্টার্স করেছে সে। রাত্রিরও যেন আগ্রহ – ওর সব পাগলামিতেই সায় দেয়া।
আজ তাই ট্রেনে উঠে- তার মনে পথের পাঁচালীর অপু ভর করলো অনায়াসেই। সেই কথার খেই ধরেই রাতুল রাশুর সাথে দুষ্টুমি করছিলো। রাত্রি একটা বই খুলে আছে চোখের সামনে – কিন্তু চোখ পড়ে আছে বাবা – ছেলের আহলাদিত গপ্পে।
এমন সময় বেশ ঘটা করেই একজন পরিপাটি পোষাকে এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন ওদের কামরায়। হাতে ছোট একটা ট্র্যাভেলিং ব্যাগ। বিনা বাক্যে তা মাথার উপরে রেখে বসে পড়লেন নিজ আসনে।
ভদ্রলোককে দেখেই রাতুল মনে মনে পরিমাপ করতে থাকে। ‘পারসেপশন’ – আর কি ! তার বয়স - তিনি কি করেন – এখানে কেন এসেছিলেন? তার মেজাজ – মর্জি। এই সব আর কি। মানুষ দেখা তার প্রিয়। আর তাদের চরিত্র নিয়ে খেলা করা যেন ওর নেশা।
যা হোক – ভদ্রলোক দেখে রাতুলের মাথায় যে ভাবের উদয় হলো – তা আপনাদের কে একটু জানিয়ে নিই।
ও একটা নাম দিল ভদ্রলোকের। তার পোষাক এবং চেহারায় ভারিক্কির সাথে মানানসই ‘চৌধুরী সাহেব’। তিনি পেশায় সরকারী চাকুরে। উঁচু পদেই আছেন বলে মনে হচ্ছে। এখানে অফিসের কাজে এসেছিলেন। এখন ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন। কাজটুকু ভাল ভাবেই হয়েছে বলে আশা করা যাচ্ছে- কেননা মুখে একটা প্রশান্তির ভাব আছে।
চৌধুরী সাহেব একবার আড়চোখে রাশু দেখলেন।
খানিকটা হাসার চেষ্ঠা করলেন। তারপর হঠাৎ আনমনে হয়ে গেলেন। নিজের বাসার কথামনে পরে গেল হয়তো। ঘড়ি দেখলেন। রাতুলের ভাষায় – তার এখনকার অভিব্যক্তিটি; ‘এই ট্রেনটি ঢাকা পৌঁছাবে কখন?’
ট্রেন ছাড়তে তখনো কয়েক মিনিট বাকি।
কামরায় সবাইকে চমকে দিয়ে চতুর্থ ব্যক্তি প্রবেশ করলেন।
চমকানোর কথা বললাম – কেননা ব্যাপক শব্দ করে কামরার দরজা খুলে এই চরিত্রের
‘গৃহ-প্রবেশ’।
ফ্রেমে তখন ওসমান সাহেব ; নামটা রাতুলের মনেই এলো।
সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবী পড়া। গলায় একটা সোনার চেইন। সাথে একটা ছোট ট্রলি ব্যাগ।
পান চিবাচ্ছেন– চেহারায় কিছুটা বিরক্তি।
আপনারাও নিশ্চয়ই রাতুলের মত মেপে নিলেন -ওসমান সাহেব বোধকরি চট্টগ্রামের একজন জাত ব্যবসায়ী।
রাশু তাকিয়ে দেখছিলো ওদের নতুন সহযাত্রীকে।
হঠাৎ করেই ওসমান সাহবে ওকে চমকে দিয়ে পানের পিক ফেললেন মেঝেতে।
বাকি সবাই যেন একটু ধাক্কা খেলো এহেন অসামাজিকতায়।
এরই সাথে সাথে ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ট্রেনটি চলতে শুরু করলো।
কামরায় সবাই চুপ। ট্রেন ছুটে চলেছে।
রাতুল মনে মনে আওড়াচ্ছে – ওর বন্ধুর ট্রেন নিয়ে লেখা একটা কবিতা।
জংশন এ দাঁড়িয়ে
ঝুম বৃষ্টি শেষে ফুরফুরে আকাশ
চনমনে রোদ মনেও দেয় উঁকি।
আমি এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়ি ।
সামনের রিক্সাতে উঠি এক লাফে
অমনি সেটাও চলতে শুরু করে।
আমি কোন গন্তব্য না বলাতেও
সেই কিশোর ছেলাটা এক টানে
আমায় রেলস্টেশনে নিয়ে এলো।
আমায় দেখে কি পর্যটক মনে হচ্ছে ?
আজ বুঝি আমার পথ হারানোর দিন!
দিনের এই সময়টায় জংশনটা একদম ফাঁকা।
আমি ফুটওভার ব্রীজে উঠে- দাঁড়াই মাঝখানটায়।
খানিক বাদেই হুইসেল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্মে
এসে দাঁড়াবে- আপ কিংবা ডাউন এর কোন ট্রেন।
স্টেশনের দোকান তাই এখন জনহীনতায় ঝিমুচ্ছে !
চাপা উত্তেজনায় কোন টিকেট কেনা হয়না আমার;
যে ট্রেন আসুক দৌড়ে আমি ওতেই উঠে পড়বো।
ড্রাইভার বাবু যেখানে নিয়ে যাবেন সে পথই ধরবো।
আমি তাই প্রতীক্ষায় আছি - জংশনে দাঁড়িয়ে !
তারপর শুরু হবে ঝিকঝিক পথঘাট,ঝিকঝিক সবুজ ক্ষেত,
খাল-বিল ঝিকঝিক আকাশ-নদী ঝিকঝিক ...
ঝিকঝিক ঝিকঝিক !
দেখতে দেখতে মাঝপথ পেরিয়ে এসেছে আন্তঃনগর ট্রেনটি।
রাতুলের ‘পারসেপশন’ খেলা শেষ হয়ে গেছে – সেই পানের পিক ফেলার ঘটনার সাথে সাথেই।
ওর মাথায় তখন নতুন ভূত চেপেছে।
চৌধুরী সাহেব আর ওসমান সাহেব দু-মেরুর বাসিন্দা।
এই দুজনকে এক সুতোয় গাঁথার একটা চেষ্ঠা করাটা নিঃসন্দেহে একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
যেমনি ভাবা – অমনি ঝাপিয়ে পড়া। এ রাতুলের পক্ষেই সম্ভব।
ও ইশারা করতেই রাত্রি হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফ্লাক্স বের করলো। সাথে ওয়ান টাইম গ্লাস ছিল তিনটি।
রাত্রি বিনয়ের সাথে চৌধুরী সাহেব কে শুধালো – একটু চা দিব?
চৌধুরী সাহবে মুখ তুলে দেখলেন রাত্রিকে।
রাত্রি বললো – রঙ চা। আর গ্লাসগুলি পরিষ্কার।
চৌধুরী একটু ভাবলেন। তারপর একটু সরু হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার চেহারায়।
‘মনে মনে চা’র কথাটাই ভাবছিলাম’ – জানেন। বলেই হাত বাড়িয়ে চা’টুকু নিয়ে চুমুক দিলেন তিনি। মুখে স্পষ্ট হলো তার তৃপ্তিটুকু।
তারপর –ওসমান সাহবকে সাধা মাত্রই বিগলিত হাসি উপহার দিয়ে তিনিও হাতে নিলেন গ্লাসটি।
পরে শেষ গ্লাস্টিতে রাতুল আর রাত্রিও চা নিল ।
রাত্রি বই পড়ছে। রাশু ঘুমাচ্ছে। জানালা দিয়ে ছুটে চলা পথা ঘাট দেখছে রাতুল। ও বিড়বিড় করলো আবার -
ঝিকঝিক পথঘাট,ঝিকঝিক সবুজ ক্ষেত,
খাল-বিল ঝিকঝিক আকাশ-নদী ঝিকঝিক ...
ঝিকঝিক ঝিকঝিক !
ঐদিকে চা খাওয়ার সময় থেকেই চৌধুরী সাহেব আর ওসমান সাহেব টুকটাক করে কথা বলছিলেন। এখন দুজনে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের আলোচনায় উঠে আসছে দেশ – ব্যবসা- রাজনীতি ...ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার হলো – ওসমান সাহেব কিন্তু আর পিক ফেলেননি এতটুকু পথে। চৌধুরী’র অহমিকা কিংবা ওসমানের সহজাত অভ্যেসটুকু বুঝি উবে গেছে তাদের আন্তরিক আলাপচারিতায়।
রাতুল মনে মনে ধন্যবাদ দিলো রাত্রিকে।
একটুখানি উষ্ণতা - অপরিচিত দু’জন ভদ্রলোককে কেমন এক ফ্রেমে এনে দিলো।
মানুষ আদতেই সামাজিক জীব। সে চকিতেই খুঁজে নেয় আপন গন্ডি – নিমিষেই গড়ে তোলে আপন ভূবন।
প্রথম পরিচয়ের সীমানা পেড়িয়ে শেষে এসে এই দুজন যেমন আজ একে অপরের মুঠোফোনে জায়গা করে নিলো অধিকার নিয়েই।
রাতুল আওড়ালো – মানুষ। (হুমম) মানুষ যে !
ট্রেন এয়ারপোর্ট স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে।
রাতুল জানালা থেকে মুখ ঘুরাতেই ও দেখে – রাত্রি তাকিয়ে আছে।
রাতুল মুচকি হাসলো। রাত্রিও যোগ দিলো ওর সাথে। ওরা আড়চোখে দেখে নিলো রাস্তায় পরিচিত হওয়া নতুন দুই বন্ধুকে।
রাত্রির মুখে প্রশ্রয়। ও ডানে-বামে ওর মাথাটা নাড়লো দু’বার।
তারপর মুখ কাছে এনে ফিসফিস করে বললো- ‘রাতুল। তুমি না...।’
রাতুল শুধালে – কি ?
রাত্রি বললে – আমি ঠিক জানি না। শুধু জানি – বড় অদ্ভুত তুমি। আর তাইতো এ জীবনের পথ পাড়ি দিচ্ছি কত অনায়াসে।
দুজনেই তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ চোখে চোখ রেখে।
...এরপর ব্রেক তুলে আন্তঃনগর ট্রেনটি থেমে যাবে এয়ারপোর্ট স্টেশনে।।
-সমাপ্ত-
(উৎসর্গ : সুপ্রিয় রাজু ভাই কে )
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫২