অনু অনিন্যস্ত পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িরে ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তরপর বাহাতের কনিষ্ঠালি দিয়ে আস্তে করে টিপটা ঠিক জায়গামত বসানোর চেষ্টা করল।আঙ্গুলে রক্তের ফোঁটা। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল জায়গামত বসেছে কিনা। টিপ জায়মামত বসেনি তবে একফোঁটা রক্ত কপালের ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে। ভ্রুযুগল বাঁকা হয়ে ধনুকের মত হয়ে আছে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ?? অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙার পর পানি খেতে গিয়ে গ্লাস ফেলে দিয়ে হাত কেটেছে। অবিন্যস্ততা বাড়ছে জীবন যাপনে। সেদিক থেকে স্বপ্নটা বেশ গুছাল ছিল। কোন কথাবার্তা নেই হঠাতধনুক ভাঙার প্রতিযোগিতা। সে রাজকুমারীর মত বসে আছে সুউচ্চ আসনে। কেউ পারছে না। হঠাত একটা হ্যাংলা পাতলা ছেলে এসে প্রথমে বাঁকা ধনুকাটার একদম মাঝখানে একটা চন্দনের ফোঁটা দিল। তারপর হাঁটুতে একঝটকা মেরে ধনুক মাঝখানে দুইভাগ করে ফেলল! স্বপ্ন ও ভেঙে দুভাগ হয়ে গেল। এই স্বপ্নের মানে কি? ছেলেটা তার চেনা! কিন্তু আসলে কতটা চেনে সে প্রবল সংশয় তার কাটেনি কখনো।
পাশের ছাদে কোরআন শিক্ষার আসর বসেছে। হুজুর পড়াচ্ছেন , এখানে এক আলিফ সমান টান, ওখানে দুই আলিফ সমান টান, কোথাওবা তিন আলিফ সমান টান দিতে হবে। নাহলে অর্থ পরিবরতন হয়ে যাবে। এক আলিফ মানে প্রায় এক সেকেন্ড । অনু ঘন ঘন কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিন্ন ভিন্ন সময় ভ্যবাধানের । যেন এক একটা দীর্ঘশ্বাসের এক একটা আলাদা অর্থ আছে!
**** **** **** ****
রাত তিনটা। বাবুল মামা চায়ের দোকান খোলা রেখে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আশেপাশের সব দোকানে ঝাঁপ নেমে গেছে অনেক আগে। আমি নিজেই একটা সিগারেট টেনে নিতে নিতে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম,
বাবুলমামা চা খাওয়াতে পারবা??
সে হু বলে আবার ঝিমু্তে লাগলো। সিগারেট তিতকুটি লাগছে। আমি আবার ডাকলাম, বাবুল মামা, ঐ বাবুল মামা!
সে ধড়ফড় করে উঠে বসল, কি হইছে?!
আমি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম, কিছু হয় নাই! তবে এইভাবে দোকান খোলা রেখে ঘুমাইলে হতে দেরি লাগবে না। এখন চা বনাও।
সে ঢুলুঢুলু চোখে চা বানিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে ঝিমুতে লাগলো। নতুন কাস্টমার এসেছে। হাসপাতালে তাদের রোগী । রোগী হাসপাতালে থাকলে বাইরে বসে চা পায়েন খেয়ে টেনশন কমানর নিয়ম । বাবুল মামা উঠে বিরক্তমুখে চা বানাতে লাগলো।
-ঘটনা কি মামা?? কি হইছে??
মাথাডা ব্যথা করে।
-মাথা ব্যথা করলে চা খাও। আরাম পাবা। আমারও মাথা ব্যথা দেখেই তো চা খাইতে বেরুইলাম।
আমি চাই খাই না!
-চা খাও না?!! কেন?!
হেইডা জানি না! ভক্তি আহে না। যেই যে জিনিস বানায় তার প্রতি তার ভক্তি থাহে না।
আমার বাবুল মামার সাথে তর্ক জুড়ে দিতে ইচ্ছে হল। । আচ্ছা, জীবনান্দের কবিতার সবচেয়ে বড় ফ্যান কে? অবশ্যই জীবনান্দ। জীবনান্দের কেউ বলতে পারে আমি জীবন বাবুর অমুক কবিতা কম করে হলেও ৫০০ বার পড়ছি। কিন্তু শেষমেশ কবিতার সবচেয়ে বড় ফ্যান উনি নিজেই। প্রতিটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা, প্রতিটি শব্দের সাথে জীবনের একটা করে চ্যাপ্টার জড়িয়ে রাখা, চায়ের কাপ ঢেলে পড়ে পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যাওয়া। স্মৃতি থেকে লেখার সময় আবার অনিচ্ছাকৃত পরিবর্তন এই যে কবিতার নাড়িটিপে দেখা তা সমভব উনি নিজের কবিতার একজন বড়ম্যাপের ফ্যান বলেই।
বাবুল মামা এসবের কি বুঝবে। তাই আমি কথা বাড়ালাম না।
**** **** **** ***
অনু যে ছেলেটার কাছে ময়মনসিংহ এসেছে তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। তাকে আসতে বলে সে হয়ে গেছে হাওয়া। অনু মুমিনুন্নেছা কলেজের সামনে দিয়ে হাঁটছিল। হঠাত ১৫-১৬ বছরের এক কিশোরী প্রায় দৌড়ে এসে তার পথরোধ করে তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট গুঁজে দিল। বলল, আমি এস এস সিতে গোল্ডেন পেয়েছি, মা আপনাকে এটা দিতে বলেছে। বলে মাকে দেখাতে হাতঅঙ্গুলি ইশারা করল। অনু মা মেয়ে কাউকে চেনে না। অবাক হয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কিশোরী বলল, মা অন্ধ। আপনার গায়ের গন্ধ মায়ের যময বোনের মত। খালামনি তো অনেক আগে মারা গেছেন। তাই আপনাকে দিতে বলল। আপনি যদি নেন.........মা খুব খুশি হবেন।
কথার তালে তালে মেয়েটার বেণী দুলছে। অনু তাকে হতচকিত করে এত বড় মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে তার মায়ের দিকে হাঁটা দিল। এইমন খারাপের বেলায় অপ্রত্যাশিত আনন্দে সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না!
**** **** **** ****
আমি এই শেষ রাতে অদ্ভুত একটা ভাবনা ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটছি! মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি কে জানে? ভাবনাটা খুব খাপছাড়া আর এলোমেলো। আচ্ছা আগুণ কি আগুণে পুড়ে?? যদি না পুড়ে তাহলে পাপী জ্বীণ বা ইবলিস শয়তান কি করে দুজখের আগুনে পুড়বে??! নাকি তাদের জন্য পানির দোজখ??!! আর যদি আগুণ আগুনে পুড়ে তবে জল কি জলে ভেজে??
আমি জানি অনু আমাকে ভালোবাসে। বিনিময়ে সে আমার কাছে অতটা ভালবাসাও চায় না! সে চায় স্বীকৃতি। সে যে আমাকে প্রবলভাবে ভালোবাসে এটা যেন আমি অনুভব করি। স্বীকার করি । এক অর্থে আমি ওকে ভালোবাসি আর নাই বাসি আমি যেন ওর ভালোবাসার ফ্যান হয়ে যাই! ওর থেকেও বড় ফ্যান! নিজের বানানো চা যেন ওর মুখে রোচে না!
অদ্ভুত চাওয়া। আমি কি করে ওর ভালোবাসার ওর থেকে বড় ফ্যান হব??আমি কি আর অতটা জানি। না অতটা পারি? আমি জানি অনু নিজেই নিজের প্রেমের সবচেয়ে বড় ফ্যান। আমিও অনুকে ভালোবাসা দিতে যাই না । অনু এ মুহূর্তে এই শহেরই আছে আমি টের পাচ্ছি। বাতাসে অনুর গন্ধ। অনুর দীর্ঘশ্বাসের এক আলিফ দুই আলিফ টানের এক এক রকম অর্থ শুনতে পাচ্ছি। অনু তার থেকেও তার প্রেমের বড় কোন ফ্যানের প্রত্যাশায় আমাকে খুজছে। আমি লাপাত্তা হয়ে গেছি।
বুড়িগঙ্গার ঢেউ গুনছি। নৌকার গলুইয়ে পানির শব্দ। শেষ বিকেলের আলো নদীর জলে । জীবনানন্দ ভোর করার মত পরিবেশ। আমি আনমনে জীবননানন্দ আউড়ালাম অথবা কে জানে জীবন বাবুই হয়তো আমাকে আউড়ালেন ।
তবুও নদী মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল
সূর্য মানে আলো;
এখনো নারী মানে তুমি,
কত রাধিকা ফুরালো!
এস এস সির রেজাল্ট হয়েছে। স্কুল ড্রেস পড়া এক উচ্ছ্বসিত কিশোরী সম্ভত তার মা খালাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গার ধারে ফুচকা খাচ্ছে। যাকে খালা ভাবছি তার চেহারা আশ্চর্যজনক ভাবে অনুর মত! অনুর কি এখানে এখন থাকার কথা?? জীবনান্দিক ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছে ভাবনারা। আমি তল পাচ্ছি না ।মেয়েটার চোখে জল থাকতে পারে। চিকচিক করছে। সে জলে বুড়িগঙ্গার জল ভিজবে নাকি আমি জানি না!