অদ্ভুত সময় যাইতো আমাগো। সারাদিন ক্লাস বন্ধ। শিক্ষক সমপ্রদায় নিজেগো মধ্যে নীরবে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতাছে। ছাত্রদল কিছু অস্ত্র শিবির আর কিছু পুলিশের হাতে হারাইছে এইটা নিয়া মহা টেনশনে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গেছে ঢাকা শহরে নেতৃত্বের কাছে কি করনীয় এইটা বুঝতে। সব এক্কেরে টালমাটাল। তারমধ্যে পুরা ছাত্র কমু্যনিটি তাকাইয়া আমাগো দিকে, আমরা মানে ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য। আমাগো তখন সব হলেই মোটামুটি কাজ আছে। ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থাও একইরম বলা যায়, শুধু মীর মশাররফ হলে তাগো কোন কর্মী নাই। এমন অবস্থায় হলে হলে শিবির কর্মীগো চিনা বাইর করা, তাগো থেইকা হল কমিটির কাগজপত্র বাইর করনের সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। ছাত্রদলরে পুরা পাশ কাটাইয়া সিদ্ধান্ত নিতে হইলো প্রথমে, তারা কোন কিছুই কইতে পারতেছিলো না ঐ টাইমে। ছাত্রলীগের সাথে তাগো পার্থক্য খালি মোবাইল ফোন ব্যবহারে, ছাত্রদল তখন চান্দা বাজী কইরা একটা সিটিসেল মোবাইল ফোন আর ওয়াকিটকি কিনছে। এক হল থেইকা আরেক হলে যেইরম চীৎকার কইরা কথা কইতো তা দেইখা আমরা হাসতাম, এতো পয়সা খরচ কইরা ফোন কিননের কি দরকার আছিলো তা বুঝতাম না আমরা।
কিন্তু যেইসব হলে আমরা ছিলাম, বিশেষ কইরা যেই হলে আমি ছিলাম, মানে মওলানা ভাসানী হল, সেইখানের পোলাপাইন থাকতো রীতিমতো হুমকীর মুখে। আর সেই হলেই নিরাপত্তার ভয়ে ছাত্রদলের কেউ ছিলো না, যেই কারনে প্রতিরক্ষার জন্যও কিছু ছিলো না। এই কিছু বলতে আমি সিম্পলি অস্ত্র বুঝাইতেছি। হলের ছাদে যেই পরিমানে ইট উঠানো হইছিলো তা দিয়া আধা ঘন্টা আটকাইয়া রাখন সম্ভব ছিলো প্রতিপক্ষরে। যদিও রাইতে গেরুয়া গ্রাম থেইকা দুই এক রাউন্ড গুলির আওয়াজ আসলে হলের সাধারন ছাত্রদের মুখে আশংকা ফুইটা উঠতো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের, তারা আমাগো মুখ চাইয়া থাকতো। আমি আর আহসান (ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক) বসলাম কি করন যায় এইটা নিয়া ভাবতে! যদিও ব্যাপারটা বোকার মতো হইয়া যাইতেছে তারপরও লিখতেছি, নব্বইয়ের ছাত্র গণ অভু্যত্থানের সময় আমার সুযোগ হইছিলো কাজে লাগানের মতো বিস্ফোরক বানানের, আহসানরে এই কথা কওনের লগে লগেই সে আমারে কইলো বন্ধু এই বিদ্যা এখন কামে লাগাইতে হইবো। আমার একটু ভয় ভয়ও লাগতেছিলো, যেইটা বানাইতাম ঐটারে ককটেল কওয়া হইতো, কিছু ম্যাটেরিয়াল খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করন লাগে, তা'ও আহসানরে কইলাম ঠিক আছে বন্ধু চলো লাইগা যাই! সাভার বাজার থেইকা যা যা লাগে তা কিনা আনা হইলো। জর্দার কৌটায় ভইরা আমি 5টা ককটেল বানাইলাম। আর যোগাড় করছিলাম অসংখ্য ছোট ছোট কৌটা যেই গুলির মধ্যে বালু আর ইটের গুড়া ভইরা টেপ দিয়া প্যাচাইয়া থুইয়া দিছিলাম, পোলাপাইন এইসব দেইখা বহুত খুশি!
যেই রাইতে বানাইলাম ককটেল, সেই রাইতেই কাকতালীয় ভাবে গেরুয়া গ্রাম থেইকা হলের তিন চারশো গজের মধ্যে ঢুইকা পরলো শিবির কর্মীরা। হলের কিছু ছাত্র গেছে শিবির আক্রমণের পর থেইকা পাশের বন্ধ ছাপরা মতোন দোকানটায়...হঠাৎ তাগো চোখে পরলো দূরে কিছু পোলাপাইন হলের পিছনের ধানক্ষেতের ভেতর দিয়া ক্রলিং কইরা আগাইতেছে...তারা চীৎকার দিয়া হলের ভিতরে দৌড়াইয়া আসলো হাপাইতে হাপাইতে। নীচতলার কমান্ডার শাহীন হলের মাঝখানে গিয়া দিলো চীৎকার। সবাই যার যার মতোন দৌড় ছাদে...আমি ছিলাম নিজের রুমেই। মাত্র বানানো দুইটা ককটেল হাতে নিয়া দিলাম দৌড়... ছাদে গিয়া দেখি পোলাপাইন ইট ছুড়তে শুরু করছে। শিবিরের যেই কয়জন ছিলো তারা পাল্টা গুলি ছুড়ছে এক/দুই রাউন্ড! আমি গেছি বামদিকের ব্ল্লকের ছাদে, ঐ ব্লকটাই গ্রামের রাস্তাটার কাছে। অন্ধকারে কিছু না দেইখাই দিলাম ছুইড়া হাতের ককটেলটা। বেশ জোরেই ফাটলো ঐটা! ততোক্ষণে অন্ধকারও সইয়া আইছে চোখে, দেখলাম দুই/তিনজন উল্টা দৌড়াইয়া চইলা গেলো। পোলাপাইন আনন্দে চীৎকার দিলো ঠিকই, কিন্তু আমার আর আহসানের দুইজনের মাথায়ই তখন নিয়মিত পাহারার চিন্তাটা আসলো। বুঝলাম যে কোন সময় শিবির গ্রাম থেইকা আক্রমণ করতে পারে! আহসানের সাথে কথা কওনের সময় হঠাৎ পকেট থেইকা সিগারেট বাইর করতে গিয়া মনে পরলো আমার প্যান্টের পকেটে তখনো একটা ককটেল রাখা আছে। এইটা নিয়াই আমি বসছি! সামান্য নড়াচড়ায় যেইটা ফাইটা যাইতে পারতো। আর যেই দৌড় ঝাপ করছি তার আগের আধাঘন্টা, তাতে সেই রিস্কটা ছিলোই!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



