আজ থেকে ১২ দিন আগে পিকনিক এ গিয়েছিলাম। পিকনিক অবশ্য হয়নি। আসলে পিকনিক হয়নি রোড এক্সিডেন্টের কারণে।
মনির চাপাচাপিতে যেতে রাজি হয়েছিলাম। রোড এক্সিডেন্টের কোন অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। ভাগ্যে ছিল তাই অভিজ্ঞতা পেয়ে গেলাম। এখন অবাক লাগছে,আমি এক্সিডেন্ট করলাম। আবার কেমন কেমন করে জানি বেঁচেও ফিরলাম। হাতের উপর গভীর দাগটা দেখে আজ লিখতে বসলাম। হয়ত কিছুদিন পর দাগ মুছে যাবে; স্মৃতিটাও আবছা হয়ে আসবে। তাই ভাবলাম, মনের দাগটা কাগজের বুকে এঁকে রাখব।
সেদিন শুক্রবার ছিল। আগের দিন সন্ধ্যায় মনি ফোন করে জানাল কাল ওরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে পিকনিকে যাবে। ওর মা মানে আমার ছোট খালা, উনিও যাবেন। সাথে অনেক ছেলেপুলে যাবে। খুব মজা হবে। চাঁদা ২০০ টাকা। পরে দিলেও চলবে। আপাতত আমাকে হ্যাঁ বলতে হবে। আমি সোজা সাপটা না বলে দিলাম।
সকাল ৬ টায় মনিপু আমার বাসায় এসে হাজির। আমাকে ডেকে তুলে চা খাওয়ালো। হাতে পায়ে ধরে ম্যানেজ করল। সাড়ে সাতটায় দুজনে বের হলাম। আমার চোখ তখনও লাল। ঘুম ঘুম ভাব কাটেনি।
বাসে চড়ে মন ভাল হয়ে গেল। পড়ুয়া ছেলেরা যে এত হৈ হল্লা আর মজা করতে পারে আগে ধারনা ছিল না। আমার অবশ্য বই পড়া ভাল লাগে না। তবুও সুযোগ পেলে পড়ি।
যাহোক বসেছি মনির পাশে, বাসের ঠিক মাঝামাঝিতে। মনি জানালার পাশে। কম বয়সীরা মজা করার জন্যে পিছনে বসেছে। কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা সন্দেহ। তবুও খুব ভাল লাগছে।
বাস ছাড়ার প্রায় দু ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আমি ততক্ষনে ছেলেমেয়েদের সাথে মিশে গেছি। সিটের উপর হাটু মুড়ে দাঁড়িয়ে গানে গানে গলা মিলাচ্ছি। গানের অক্ষর মিলান মিলান খেলা। একদল যে অক্ষর দিয়ে গান শেষ করবে অন্য দল সে অক্ষর দিয়ে শুরু করবে। রিপিট করা চলবে না। এই হল খেলা। বাসের ভেতরই ৫০০ টাকার স্পন্সর পাওয়া গেছে। স্পন্সরের চাইতেও বড় কথা হল, বেশ মজা পাচ্ছি। কেউ কেউ দু'নম্বরি করছে। বিশেষ করে ছেলেরা। তুঁই তাকারি চলছে। শয়তানি করলে আমরা মেয়েরা ছেলেদের মাথায় চাটি মারতেও ভুলছি না। তারপর হঠাৎ...
হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেল। সবকিছু দুলে উঠল। আমার মনে হল নাগর দোলায় উঠেছি। উল্টো দিকে উপর থেকে নিচে নামছে। কিছু বোঝার আগেই আমি সিট থেকে ছিটকে দু'লেন সিটের ফাঁকা জায়গা দিয়ে, ইঞ্জিনের দিকে গড়িয়ে যেতে লাগলাম। কে যেন আমার পা টেনে ধরল। কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ। আমার বাঁ হাতে কার যেন পা পড়ল। তল পেটে ভারি কি যেন ধুপ করে পড়ল। সাথে সাথে মাথার পেছনে খুব আঘাত পেলাম। তারপর সব অন্ধকার। নি:শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।
যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি রাস্তার পাশে ঘাসের উপর। সমস্ত শরীরে ব্যথা। অনেক আলো, চ্যাচামেচি। ঘামের গন্ধ। কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম। গা মাথা গুলিয়ে উঠল। চোখ বুজে ফেল্লাম। কানের কাছে ছোট খালার কন্ঠ শুনলাম। ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে। কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না। অনেক ক্লান্তি লাগল। মনে হল কত দিন ঘুমাইনি। তারপর কি হল জানি না।
যখন জাগলাম, তখন দেখি আমি এক অপরিচিত বাড়িতে। গ্রাম্য এক মহিলা বাতাস করছে। পুরো গ্রাম ভেঙ্গে এসেছে। কিছুক্ষণ পর একটা টেম্পু আসল।
উঠে বসলাম, তখন বুঝলাম আমার তলপেটে ব্লিডিং হচ্ছে। খালাকে বল্লাম। ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু হল। আমি কিছুতেই সামাল দিতে পারছিনা। পেটে হাত দিয়ে বসে আছি। খালা আমাকে জড়িয়ে আছেন। তারপরেও গা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
মাথার পেছনে খুব ব্যথা। হাত দিয়ে দেখলাম, আলুর মত ফুলে দুলদুলে হয়ে গেছে। বাঁ হাতে শাড়ি দিয়ে ব্যানেডজ করা।
টেম্পুতে করে আসতে আসতে জানলাম, আধা ঘন্টার বেশি হল আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। ছাদের উপর যে দু'জন ছিল তাদের পা ভেঙ্গেছে। হেল্পারের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আর ড্রাইভারের ডান চোখ গলে গেছে। ড্রাইভার নাকি বলছে, গ্রামের বাচ্চারা পাখি মারার যে বাটুল দিয়ে খেলে, তার গুল্টি এসে চোখে লেগেছে। তারপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে রাস্তার বামের ক্ষেতে বাস নামিয়ে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছে, ড্রাইভারের মৃগী রোগ আছে।
কাছের একটা হাসপাতালে পৌঁছালাম। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে শহরে ক্লিনিকে ভর্তি হলাম। তিনদিন পর বাসায়। কিন্তু সেই তিনদিন আগে আমার যে অহঙ্কার ছিল, আজ নেই। যে মেয়েরা অনাকঙ্খিতভাবে সেই অহঙ্কারটুকু হারায়, তারা জানে ব্যাপারটা কত দু:খজনক, কত গভীর।
আস্তে আস্তে সব শুনলাম। কেউ কেউ রংচঙ লাগিয়ে দুর্ঘটনাকে রসাল বানিয়ে ফেলেছে। মনির কপালে কাঁচ দিয়ে একটু কেটেছে। আর তেমন কিছু হয়নি। ওর উপর আমার কোন রাগ নেই। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে মনিপু আমার সাথে আগের মত করে কথা বলছে না। হতে পারে, মনে মনে অপরাধ বোধ করছে।
পরে খালার কাছেই শুনলাম, গড়িয়ে যাবার সময় খালাই আমার পা টেনে ধরেছিলেন। আর আমার তলপেঠে যে বস্তুটি পড়েছিল সেটি হল খালার কোলে বসা আমার তিন বছরের ছোট খালাত বোন।
আমি এখনও বেঁচে আছি। সুস্থ্য আছি। দুর্ঘটনার বারদিন পর আজ আমি টেবিলে বসে ডাইরী লিখছি, এটাই বা কম কি!!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১০ রাত ১০:১২