জন্মের পর থেকে ঢাকায় বড় হলেও গ্রামে গেলে থাকা হতো সেই বাড়ীটিতে। ১৩টি বছর কাটিয়েছি সেখানে। ঈদ-উৎসবে সবাই একসাথে হলে হৈ হুল্লোড়, ঝগড়াঝাটি আর কত আনন্দ যে হতো। ঢেকি র ধুপ ধুপ আওয়াজ। রাত জেগে মা-কাকী-দাদী-ফুপুরা মিলে রান্না করতেন, পিঠা বানাতেন। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক একটি ব্যাপার হলো যত বেশীই রান্না হোকনা কেন আম্মা এবং ছোট কাকী বেশীরভাগ সময়-ই খেতে গেলে পেতেন না বা খাবার টান পড়ে যেতো। আম্মা কিছু না বললেও ছোট কাকী কখনই এসব ব্যাপারে ছেড়ে দেননি।
আমি আমাদের ঘরে খুব কম ঘুমাতাম। সারাদিন যে সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে ঘুরতাম রাতে দাদুর ঘরে ছোট কাকার বিশাল খাটে ঘুমাতাম তাদের নিয়ে। দিনের বেলা ঝগড়াঝাটিতো ছিলই কখনো কখনো রাতের বেলাও মিস হতো না। তাই শুনে দাদু তার বিছানা থেকে বলতেন, "কাইজ্জা করিছ না, কেডা কই যাবি বারো বচ্ছরেও একদিন দেহা পাবি না"। কথাটা সত্যিই। এখন টের পাই।
তখন ঈদ হতো শীত কালে। শেষ রোজায় কোনমতে ইফতার করেই ছুটে যেতাম বাড়ীর সামনের রাস্তায় চাঁদ দেখার জন্যে। সারা রোজা টুকটাক বোমা ফুটানো-তারাবাতি জ্বালানো হতো। ঈদ যত ঘনিয়ে আসতো ততই বেড়ে যেতো এসব। আমাদের উঠোনের পরেই ছিলো ছোট দাদার(আব্বার কাকা) উঠোন। ওদের বাড়ীটাও ছিলো জমজমাট। ঈদের সময় আরো বেশী হতো। দুটো উঠোনের মাঝে ছিলোনা কোন বেড়া। দেখা যেতো সেহরীতে জোছনা ফুপুর(মেয়েটার একটু বুদ্ধি কম) ভাত একটু কম পড়লে ভাতের প্লেট নিয়ে বড় আম্মার(আমার দাদু) কাছে চলে আসতো ভাতের জন্যে।
রাতের বেলা উঠোনে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে দেখা যেতো দাদুর জোড়া তুলোর গাছ। মনে হতো আকাশের সাথে গিয়ে মিশেছে। মিটিমিটি তারা জ্বলা রাতে সে আকাশের দৃশ্য তখন বুঝিনি। এখন মিস করি প্রচন্ড!
প্রায় প্রতিটি পরিবারেই মনে হয় কিছু না কিছু ব্যাপারে কোন্দল থাকে। আমাদের পরিবারটিও তার বিপরীত নয়। দাদা থাকতেই বড় আর মেঝো চাচাকে আলাদা বাড়ি করে দিয়েছিলেন। ছোটকাকা আর আমরা ছিলাম দাদার ভিটায়। কাকা দাদার ঘর পেলেও আমাদের ছিলো আলাদা ঘর। আমরা আস্তে আস্তে বড় হলে বড় ঘরের প্রয়োজন অনুভব করলেন আব্বা। আব্বার স্বপ্ন ছিলো তার বাড়ির সাথে বাগান ও পুকুর হবে। স্বপ্নের বাড়ীর জন্যে আলাদা জমিও কিনেছেন। কিন্তু আত্নীয়দের থেকে সামান্য দূরে বিধায় কেউ সেখানে যাবার মত দেননি। পরে চেয়েছিলেন এই বাড়ীতেই থেকে যেতে। কিন্তু স্বয়ং আমার দাদুও হয়ত চাননি আমরা এখানে থাকি। ছোট ছেলের তখন দুই ছেলে। ভবিষ্যতে তাদেরইত এই বাড়ী লাগবে। জায়গা কোথায়!
০৪ এ চলে আসলাম সেখান থেকে। নতুন বাড়ী শুরু করলেন আব্বা। আগের বাড়ীটির চেয়ে অনেক সুন্দর এ বাড়িটি। সুযোগ সুবিধা বেশী। এবার ছোট কাকীরাও ঈদের সময় তাদের বাড়ীতে যায়না। আমাদের বাড়ীতেই ঈদ করে। আস্তে আস্তে সেই বাড়ীটি পরিনত হচ্ছে পরিত্যাক্ত বাড়ীতে।
০৭ এ ছোট দাদু মারা গেলেন। তার বছর দেড়-দুই পরে দাদাও গেলেন। ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেলো সংসারটি। সেই বাড়ীটি পুরোপুরি পরিত্যাক্তই হয়ে গিয়েছে এখন।
যার বর্তমান চিত্র এরকম.......
আর আমার দাদার আমলের ছোট কাকার ঘরটি, যেটা এখন কোনমতে দাড়িয়ে আছে
নতুন এই বাড়িটিকে একটি বারের জন্যেও স্বপ্নে দেখেছি কিনা আমার মনে পড়ে না। কিন্তু ছোট্টবেলার স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়িটিকে স্বপ্নে দেখি। আমি হয়ত একটু বেশী-ই স্মৃতি কাতর তাই এত মিস করি বাড়িটিকে। আর তাইত এরকম সুন্দর বাড়ীটি
একটি বারের জন্যেও কোন রাতে আমার চোখের সামনে আসেনা।
স্মৃতিগুলো খুব নাড়া দেয়, খুব পীড়া দেয়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




