আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৩২
গঙ্গা-পদ্মা (গঙ্গা ২৫৮, পদ্মা ১২০)
হিমালয় পর্বতের গঙ্গোত্রী হিমবাহ হতে নির্গত ভাগীরথী এবং মধ্য হিমালয়ের নন্দাদেবী শৃঙ্গের উত্তরে অবস্থিত গুরওয়াল হতে উৎপন্ন আলোকনন্দা নদীর মিলিত ধারাই গঙ্গা নামে অভিহিত। এ ধারা ভারতের হরিদ্বারের নিকট সমভূমিতে পৌঁছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রাজমহল পাহাড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। তারপর রাজশাহী অঞ্চলে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় ১১২ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা-পদ্মা নামে কুষ্টিয়া জেলার প্রান্তে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর আরিচার নিকট যমুনায় মিলিত হয়ে পদ্মা নামে দক্ষিণ পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের নিকট মেঘনায় পতিত হয়েছে। পদ্মা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৫৮ কি.মি., গঙ্গা নদী বাংলাদেশের জলসীমায় রাজশাহী জেলার ভিতর দিয়ে ১৪৫ কিমি, পাবনা ৯৮ কিমি এবং ঢাকা-ফরিদপুরের ভিতর দিয়ে ১৩৫ কিমি প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের নিকট মেঘনায় পতিত হচ্ছে। গঙ্গানদীর অপর অন্যতম প্রবাহ হচ্ছে পদ্মা। খুব সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দী হতে পদ্মানদী গঙ্গার প্রধান প্রবাহ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক আবুল ফজল গঙ্গানদীকে তাণ্ডার নিকট দ্বিধাবিভক্ত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হওয়ার কথা উলেখ করেছেন।৬০ এই প্রবাহই পদ্মা নদী বলে অনুমিত হয়। পঞ্চদশ শতকের কবি কৃত্তিবাস পদ্মা প্রবাহকে বড়গঙ্গা নামকরণের মধ্য দিয়ে পদ্মা নদীকে গঙ্গার মূল প্রবাহ বলে উল্লেখ করেছেন।৬১ রেনেল ও ফান ডেন ব্রোকের নকশায় পদ্মা বেগবতী নদী। হিশাবুদ্দিন তালিস (১৬৬৬) ও মির্জা নাথানের (১৬৬৪) বিবরণীতে পাওয়া যায়, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সংগমে, ইছামতীর তীরে যাত্রাপুর এবং তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে ডাকচর, এবং ঢাকার দক্ষিণে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলিত প্রবাহের সমুদ্রযাত্রা ভলুয়া এবং সন্দ্বীপের পাশ দিয়ে। যাত্রাপুর হতে ইছামতী বেয়ে পথই ছিল তখন ঢাকায় যাওয়ার সহজতম পথ এবং সে পথেই টেভারনিয়ার (১৬৬৬) এবং হেজেস (১৬৮২) যাত্রাপুর হয়ে ঢাকা গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন সর্বত্র গঙ্গার এই প্রবাহের পদ্মা নামকরণ দেখা যায় নি। এই নামকরণ দেখা যায় আবুল ফজলের আইন-ই আকবরী গ্রন্থে (১৬৯৬-৯৭), মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই গায়েবি গ্রন্থে, (১৬০৮/০৯) ত্রিপুরা রাজমালায় এবং চৈতন্যদেবের পূর্ববঙ্গ ভ্রমণপ্রসঙ্গে। আবুল ফজলের মতে কাজিহাটার কাছে গঙ্গা দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে; একটি প্রবাহ পূর্ববাহিনী হয়ে পদ্মাবতী নাম নিয়ে চট্টগ্রামের কাছে গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। মির্জা নাথান বলছেন, করতোয়া বালিয়ার কাছে একটি বড় নদীতে এসে পড়েছে; এই বড় নদীটির নাম অন্যত্র বলা হয়েছে পদ্মাবতী। ত্রিপুরারাজ বিজয়মাণিক্য ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরা হতে ঢাকায় ইছামতী বয়ে যাত্রাপুরে এসে পদ্মানদীতে তীর্থসড়বান করেছিলেন। ষোড়শ শতকেই পদ্মা এবং ইছামতী প্রসিদ্ধ নদী, ঢাকা পার হয়ে ডি ব্যারোস এবং সপ্তদশ শতকের ফান ডেন ব্রোকের নকশায়ও এই তথ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতা (১৩৪৫-৪৬) চীন দেশে যাওয়ার পথে সমুদ্রতীরবর্তী চট্টগ্রামে ((Chhadkawan চাটগাঁ) নেমেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামকে হিন্দুতীর্থ গঙ্গানদী এবং যমুনা (Jaun) নদীর সংগমস্থল বলে বর্ণনা করেছেন। যমুনা বা Jaun বলতে বতুতা ব্রহ্মপুত্রই বুঝাচ্ছেন, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। তিনি বলছেনঃ
“The first town of Bengal, which we entered, was Chhadkawan (Chittagong), situated on the shore of the vast ocean. The river Ganga, to which the Hindus go in pilgrimage and the river Jaun (Jamuna) have united near it before falling into the sea.”
তাহলে দেখা যায়, অন্তত চতুর্দশ শতকেও গঙ্গা-পদ্মার প্রবাহ চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং তার অদূরে সেই প্রবাহ ব্রহ্মপুত্র-প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হতো। তটভূমি প্রসারের সঙ্গে চট্টগ্রাম এখন অনেক পূর্ব-দক্ষিণে সরে গিয়েছে, ঢাকাও এখন আর গঙ্গা-পদ্মার উপর অবস্থিত নয়। পদ্মা এখন অনেক দক্ষিণে নেমে গিয়েছে; ঢাকা এখন পুরাতন গঙ্গা-পদ্মার খাত অর্থাৎ বুড়িগঙ্গার উপর অবস্থিত; আরও পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) সংগম এখন গোয়ালন্দের অদূরে। এই মিলিত প্রবাহ আরও পূর্ব দক্ষিণে গিয়ে চাঁদপুরের অদূরে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্দ্বীপের (স্বর্ণদ্বীপ-সেনাদ্বীপ-সন্দ্বীপ) নিকট গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে। বস্তুত, সমতটীয় বাংলায়, বিশেষত, তার পূর্বাঞ্চলে বরিশাল হতে আরম্ভ করে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা যে কী পরিমাণে ভাঙ্গাগড়া চালিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তা জাও ডি ব্যারোস হতে আরম্ভ করে রেনেল পর্যন্ত অঙ্কিত নকশাগুলো বিশ্লেষণ করলে খানিকটা ধারণা করা যায়। পঞ্চদশ শতক হতে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত পদ্মার প্রবাহপথের অদলবদল বহু হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
১০২১-২৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্রচোল দক্ষিণ-রাঢ়ের পরেই বঙ্গালদেশ জয় করেছিলেন, অর্থাৎ ভাগীরথীর পূর্বতীরে বর্তমান দক্ষিণবঙ্গই বঙ্গালদেশ এবং এই বঙ্গালদেশ অন্তত বিক্রমপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি যখন বঙ্গালী এবং বঙ্গালদেশের সঙ্গে পদ্মাখালের কথা বলছেন, তখন পঁউআ খাঁল এবং পদ্মাবতী নদী বোধহয় এক এবং অভিন্ন ছিল। ৬২ দশম-একাদশ শতকে পদ্মার উলেখ দেখা গেল। কিন্তু পদ্মা যে গঙ্গা-ভাগীরথীর অন্যতম শাখা তা খুব প্রাচীন লোকস্মৃতির মধ্যেও বিধৃত হয়ে আছে। দক্ষিণবাহী গঙ্গা-ভাগীরথী হতে পদ্মার উৎপত্তি কাহিনী বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, দেবী ভাগবত, মহাভাগবত-পুরাণ এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের আদিকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে যুতটুকু জানা যায়, তাতে মনে হয় পদ্মা পূর্বে অর্থাৎ দশম-একাদশ শতকের পূর্বে এত প্রশস্ত ও খরস্রোতা ছিল না। তা না হলে কামরূপ হতে সমতট যাওয়ার পথে য়ুয়ান-চোয়াঙকে এই নদীটি পার হতে হতো এবং তাঁর বিবরণীতে আমরা নদীটির উলেখও পেতাম। এই অনুল্লেখ হতে মনে হয় পদ্মা তখন উলেখযোগ্য নদী ছিল না। অর্থাৎ বার/তের শতকে এই নদী ছিল না বা উলেখ করার মতো নদী ছিল না বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেছেন; ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এই মতের বিরোধিতা করেছেন।৬৩ কারণ, দশ/এগার শতকেও পদ্মা নদীর অস্তিত্ব ছিল। তখন এটি অপেক্ষাকৃত ছোট নদী ছিল। বৌদ্ধ চর্যাপদে পদ্মাখাল বেয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।৬৪ এতে তিনি অনুমান করেন-‘প্রথমে খাল কেটে ভাগীরথীর সাথে পূর্বাঞ্চলের নদীগুলি যোগ করা হয়, পরবর্তীকালে এই খালই নদীতে পরিণত হয়।’৬৫ জ্যোতির্বিদ ও ভূগোলবেত্তা টলেমি (Ptolemy, 150 A.D) তাঁর আন্তঃগাঙ্গেয় ভারতবর্ষের নকশা ও বিবরণীতে তদানীন্তন গঙ্গা প্রবাহের সাগরসঙ্গমে পাঁচটি মুখের কথা উলেখ করেছেন। পশ্চিম দিক হতে পূর্ব দিকে এই মোহনাগুলির নাম 1) Kambyson, 2) Mega 3) Kamberi-khon 4) Pseudoston (false mouth) 5) Antibole| নলিনীকান্ত ভট্টশালী এই মোহনাগুলোকে যথাক্রমে-১. তাম্রলিপ্তির নিকটবর্তী গঙ্গাসাগর মুখ, ২. আদিগঙ্গা বা রায়মঙ্গল-হরিয়া ভাঙ্গা মুখ, ৩. কুমার হরিণঘাটা মুখ, ৪. দক্ষিণ শাহবাজপুর মুখ, এবং ৫. সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম মধ্যবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদীর নিন্মতম প্রবাহ বলে মনে করেন।
গড়াই; মধুমতী: শিলাইদহ (৩৪১ কিমি) [কুষ্টিয়া (৩৭), ফরিদপুর (৭১), যশোহর (৯২), খুলনা (১০৪) এবং বরিশাল(৩৭)] এই স্রোতধারা কুষ্টিয়া (৩৭), ফরিদপুর (৭১), যশোহর (৯২), খুলনা (১০৪) এবং বরিশাল (৩৭), জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতার বিবরণের আগে বহুদিন এই প্রবাহের কোনও সংবাদ পাওয়া যায় না। দশম শতকের শেষে একাদশ শতকের গোড়ায় চন্দ্রবংশীয় রাজারা বিক্রমপুর-চন্দ্রদ্বীপ-হরিকেল অর্থাৎ পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের অনেকাংশ জুড়ে রাজত্ব করতেন। এই বংশের মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র তাঁর ইদিলপুর পট্টোলী দ্বারা ‘সতট-পদ্মাবতী বিষয়ের’ অন্তর্গত ‘কুমারতালক মণ্ডলেক একখণ্ড ভূমিদান করেছিলেন। সতট-পদ্মাবতী বিষয় পদ্মানদীর দুই তীরবর্তী প্রদেশকে বুঝাচ্ছে, সন্দেহ নেই; পদ্মাবতীও নিঃসন্দেহে আবুল ফজল-ত্রিপুরা রাজমালা-চৈতন্যজীবনী উল্লিখিত পদ্মাবতী, তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই। বর্তমান কুমার বা কুমার নদী পদ্মা-উৎসারিত মাথাভাঙ্গা নদী হতে বের হয়ে বর্তমান গড়াইর সঙ্গে মিলিত হয়ে বিভিন্ন অংশে গড়াই, মধুমতী, শিলা(ই)দহ, বালেশ্বর নামে নিয়ে হরিণঘাটায় গিয়ে সমুদ্রে পড়েছে; কুমার (১৬২ কিমি) যশোহর ও ফরিদপুরের মধ্য দিয়ে ১৬২ কিমি প্রবাহিত কুমার নদী। এই সম্পূর্ণ প্রবাহটিরই যথার্থ নাম ছিল কুমার এবং কুমারই পরে বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে। তবে শিলা(ই)দহ নামটি পুরাতন বলেই পণ্ডিতেরা মনে করেন;
৬০ আবুল ফজল: আকবর নামা (তৃতীয় খণ্ড)।
৬১ কৃত্তিবাস: রামায়ণ।
৬২ নীহাররঞ্জন রায় – বাঙালির ইতিহাস।
৬৩ রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলার ইতিহাস (প্রাচীন যুগ)।
৬৪ নীলরতন সেন: চর্যাগীতিকোষ।
৬৫ রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলার ইতিহাস (প্রাচীন যুগ)।
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৩১