গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তারই মাঝে বয়ে চলেছে দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা সেই চির বিচিত্র রূপে। কি হচ্ছে তার সারমর্ম তো প্রতিটি সচেতন ও অচেতন নাগরিকই জানেন। মরছে মানুষ অগ্নি ছোঁয়া পঙ্গপালের মত, পুড়ছে গাড়ি, অর্থনীতি আজ রাজনীতির সূক্ষ্ম হিসাবের জালে বন্দী। এই গণপ্রজাতন্ত্রী দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দেখাচ্ছে ক্ষমতার চূড়ান্ত। এমনকি কিছুদিন আগেও ‘হলমার্ক’ এর মাত্র ‘কয়েক হাজার কোটি’ টাকার কেলেঙ্কারির পরও যখন দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী সাহেব বললেন যে এটা নাকি কিছু না, তখন আসলে সারা দেশ বোবা হয়ে গিয়েছিল।
দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত, চির অবুঝ বোবা এ জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে আমি কিছু কথা লিখলাম। কার বিরুদ্ধে? নাহ… আমারই বিরুদ্ধে উচ্চারিত এই রক্তাক্ত কণ্ঠস্বর। রক্তের বানে ভাসমান এই ক্ষয়ে যাওয়া দেহটি আমারই………
আমি আমার কথা শুরু করি।
কি বলতে যে কি বলে ফেলি, তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ক্ষমা চাওয়ার আরেকটি কারণ আছে, খুবই লজ্জার ব্যাপার, তা হল আমি লেখা লেখিতে খুবই কাঁচা। তবুও দুঃসাহস করলাম।
আমি একজন বাংলাদেশী… হু হু, অনর্গল বাংলা কথা বলি, বাংলাদেশের সংস্কৃতি মেনে চলার চেষ্টা করি। এখানেই শেষ না, আরও আছে। সরকার এবং বিরোধী দলের কাজ, মৌলবাদীদের ধ্বংসযজ্ঞ, সন্ত্রাসীদের আস্ফালন আর পুলিশের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চায়ের দোকানে আলোচনার ঝড় তুলি।
তাহলে তো মেনে নিতেই হয় যে আমি মনে প্রাণে একজন বাংলাদেশী। আমি তাতে রীতিমত গর্ববোধ করি। করারই তো কথা, তাই না?এতক্ষন তো অনেক কথা বললাম, কত কি যে করি দেশের জন্য, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। আমিও বলতে পারি, “আমার মত দেশপ্রেমিক বাংলাদেশে আর একটাও নেই।”
আজ হটাত মনে হল, অনেক কিছুই তো করি দেশের জন্য, গুনে বলতে গেলে ত্রিমাত্রিক রাশিমালা হয়ে যাবে। অনুভব করতে গেলে আরেকটি টাইটানিক সিনেমা হয়ে যাবে আর লিখতে গেলে তো বিল ক্লিনটনের ‘মাই লাইফ’ হয়ে যাবে। কিন্তু এমন কি কি আছে যা আমি করি না দেশের জন্য !!!
অনেকগুলো উত্তর পেয়ে মানসিক ভাবে দুর্বল বোধ করছি, তাই সবার সাথে শেয়ার করতে মন চাইলো, যদি মনের অস্থিরতা কিছুটা কমে।
আমি যা যা করি না দেশের জন্য (সংক্ষেপিত)
১। যোগ্য প্রার্থী না দেখে মার্কা দেখে ভোট দেই। (মার্কা থাকলেই মনে হয় চোর চোট্টা সব দরবেশ হয়ে যায় !) —–এটা আমার মূর্খতা।
২। খুনের মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী মাফ পেয়ে যায়, আর আমি তীব্র নিন্দা প্রকাশ করি চায়ের দোকানে। রাজপথে দাড়িয়ে একবারও চিৎকার করে বলি না, “তোমাদের কোন অধিকার নেই তাকে মাফ করে দেয়ার। সে যদি তোমার পরিবারের কাউকে খুন করত, তাহলে তোমরা কি পারতে তাকে ক্ষমা করতে?”।আমি পারি না এই এক চোখা শাসন ব্যাবস্থার পশ্চাতদেশে লাথি মেরে আর চুলের মুঠি ধরে ক্ষমতা থেকে নামাতে। —–এটা আমার অক্ষমতা।
৩। পুলিশ চাঁদাবাজি করায় ক্ষুব্ধ আমি, কিন্তু একবারও তো জনপথে অন্যায় চলাকালে এগিয়ে গিয়ে কোনও পুলিশকে রাম থাপ্পড় মেরে বলিনি,”তোমার বেতনের টাকা আসে আমাদের রাজস্ব থেকে, আমার সামনে কোন অন্যায় আমি সহ্য করব না।” কেন বলিনি?—–এটা আমার দুর্বলতা।
৪। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সমাজের দুর্বল স্তরে অনেক অত্যাচার করে থাকে। অথচ সেই প্রভাবশালী মহলের সামনে আমি বিনয়ে গলে যাই, মুখে মধুর হাসি ধরে রেখে তোষামোদ করার চেষ্টা করি। একবারও তাদের চোখের দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকাই না, তাকে বলতে পারিনা, “আমি তোমার টাকায় চলিনা, তোমাকে কেয়ার করার মত কোন ইচ্ছা আমার নাই।” —–এটা আমার মনের সংকীর্ণতা।
৫। কোনও সমাবেশে বা সভায় নেতারা যখন হাস্যকর রকমের মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা আশ্বাস দেয় যা কৌতুককেও হার মানায়, তখন আমি মুখে ভদ্রতার মুখোশ পরে বসে থাকি। একবারও তাদের কথার মাঝখানে উচ্চস্বরে হেসে ফেলি না। —–এটা আমার তথাকথিত ভদ্রতা।
আরও অসংখ্য কাজ আছে যা আমি করি না, সব বলতে গেলে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম মহাকাব্যটা আমার লেখা হয়ে যাবে। তাই সেই পথে আর গেলাম না।
এখন আমার নিজের কাছে নিজের প্রশ্ন, আমাদের এই দেশের জন্য আমার মত মূর্খ, অক্ষম, দুর্বল, সংকীর্ণমনা ও তথাকথিত ভদ্র দেশপ্রেমিকের আদৌ প্রয়োজন আছে কি ?
উত্তর আমি জানি না, হয়তো জানি, কিন্তু বলবো না, কারণ সত্য স্বীকার করতে আমি ভয় পাই।
নির্ভীক বাংলাদেশী কেউ কি আছেন? সেই ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধাদের মত…
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৬:৪৯