প্রায় ৭/৮ বছর আগের কথা।প্রতিদিনের মত সকাল বেলা কর্মক্ষেত্রে যাওয়র জন্য বাসা থেকে বের হতে দেখি গেইটের সাথে একটা হুইল চেয়ার শিকল দিয়ে আটকানো। ব্যপারটা কিছুটা কৌতুহল সৃষ্টি করলেও মনে তেমন দাগ কাটে নি । বেশ কয়েকদিন একই ব্যপার।সেই শেকল দিয়ে আটকানো হুইল চেয়ার। কৌতুহলটা চরমে পৌছালো।রাতে বাসায় ফিরে স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞাসা করে বৃত্তান্ত কিছুটা জানলাম।
আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নূতন ভাড়াটিয়া এসেছে তাদের একমাত্র ছেলে পঙ্গু, স্থনীয় একটি কিন্ডার গার্টেনে পড়ে, এই হুইল চেয়ার দিয়ে তাকে আনা নেওয়া করতে হয়্। একতলা বা দুতলায় সুবিধামত বাসা না পাওয়াতে তিনতলায় বাসা নিতে বাধ্য হয়েছে।
আশ্চার্য নগর জীবন !৪/৫ হাত দুরে পাশের ফ্ল্যাটে নুতন মানুষ এসেছে পনের দিন হয়ে গেছে অথচ এখনও একবারও দেখা হয় নি।
পরের দিনই অন্য রকম এক বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম।
দরজা খুলে বের হতেই দেখি এক মহিলা একটা হুইল চেয়ার নিয়ে নীচে নামছে।বুঝলাম এটাই সেই শেকল বাঁধা হুইল চেয়ার। সাথে আমিও নামলাম।মহিলা চেয়ারটিকে সেই একই জায়গায় প্রতিদিনের মত শেকল দিয়ে তালা মারলেন তারপর আবার উঠে গেলেন। কেন জানি আজ অপেক্ষা করতে লাগলাম । প্রায় ১৫ মিনিট পর দেখলাম সেই মহিলা, স্কুলের ড্রেস পরা ৫/৬ বছরের একটি ছেলেকে কোলে করে এনে হুইল চেয়ারে বসালেন তারপর শেকলের তালা খুলে হুইল চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে চললেন স্কুলের দিকে।
দুদিন পর নিজে থেকে ওনার ফ্ল্যাটে গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হলাম।ছেলেটিকেও দেখলাম ,হামাগুড়ি দিয়ে চলে।কিন্তু মুখখানা হাসিমাখা। পা দুটি সম্পূর্ন অকেজো তা ছাড়া তার অন্য আর একটি সমস্যার কারনে পস্রাব-পায়খানা আটকে রাখতে পরে না।
ছেলেটি কিছুটা অস্বাভাবিকতা নিয়েই জন্মগ্রহন করেছিল। তবে তা নিরাময়যোগ্য ছিল। জন্মের কিছুদিন পর ডাক্তার তার মেরুদন্ডের ভিতর একটি টিউমার শনাক্ত করেন এবং অপারেশানের মাধ্যমে তা অপসারন করতে পারলেও কোন একটি শিরা বা উপশিরা কেটে যাওয়ায় ছেলেটি সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।হারিয়ে ফেলে তার পায়খানা-প্রস্রাব নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা ।
তিন তলা বাসা তারা ছেড়ে দিয়েছে।প্রায় দুই বছর আমরা পাশাপাশি ছিলাম।এই দু বছর প্রায় প্রতিদিন এই মা তার ছেলেকে তিনতলায় উঠাতো-নামাতো।কোনদিন তার মধ্যে এতটুকু ক্লান্তি দেখিনি।এমন কি তার মুখটাও মলিন দেখিনি। ছেলেটির বাবা ক্যান্সারের রোগী। ইচ্ছা থাকলেও সাহায্য করতে পারতেন না।
ছেলেটি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতো। তবে বেশীক্ষন থাকতোনা। ঐ বয়সেই ও বুঝে গিয়েছিল তার শরীরের সবচেয়ে দু্র্গন্ধময় জিনিসগুলো নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতা তার নেই।
ছেলেটা এখনও এই এলাকায় থাকে। এখনও সে স্কুলে পড়ে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয়।মুখখানা সেই হাসি মাখা।
ছেলেটি অনেক বড় হয়েছে। মা জানে তার ছেলে কোনদিন কর্মক্ষম হবে না।আক্ষরিক অর্থেই নিজের পায়ে কোনদিন দাঁড়াতে পারবে না। তবুও প্রতিদিন ঠেলে চলেছেন নিজের সন্তানের ভাগ্যের হুইল।
যতদিন মা বেঁচে আছেন ততদিন তার ছেলের বোঝা ঠিকই বয়ে যাবেন।
সন্তানের বয়স বাড়ে কিন্তু মায়ের বোঝা বাড়ে না।
সন্তানের বোঝা কখনও মায়ের কাছে ভারী মনে হয় না একমাত্র মৃত্যু ছাড়া।