বেশ কয়েকজন ব্লগার আটকের পর থেকেই দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অধিকার নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ব্লগারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। অনেকে এখন অনেক রকম প্রতিবাদ করছে। অনেক যুক্তি তুলে ধরছে। কেউ বলছে ধর্মীয় অনুভূতির মানদন্ড কী ? কেউ বলছে দেশের এত অরাজকতার বিচার হয়না এইটা নিয়ে কেন এত বাড়াবাড়ি। কেউ বলছে সবার মত প্রকাশের অধিকার আছে, এই অধিকার খর্ব করা যাবে না। আরও অনেক যুক্তি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এইসব যুক্তি দেখিয়ে এইসব ব্লগারদের বাচানো যাবে বলে মনে হয় না। দেশে একটি প্রচলিত আইন আছে। সেই আইনের ধারা অনুযায়ী যদি ব্লগাররা অভিযুক্ত প্রমানিত হয় তাদের সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজা এবং ১ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
সারা বিশ্বে কয়েক দশক ধরে Hate Speech নিয়ে অনেক আইন করা হয়েছে। একেক আইনে একেক ধরনের শাস্তি দেখানো হয়েছে। UK Public Order Act 1986 এর Part 3 তে শাস্তির মেয়াদ দেয়া হয়েছে ৭ বছর। এই নিয়ে তখন ইংল্যান্ডে অনেক বিতর্ক হয়। একদল দাবি করেন Human Rights Act 1998 এর অধীনে freedom of religion and expression খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু সে দাবী টেকে নাই। যে কোন জাত ও ধর্ম নিয়ে কটুক্তি-উপহাস-উষ্কানি-অসম্মান করাকে Human Rights Act 1998 বাচাতে পারে নাই। বরং পরবর্তীতে তৈরী করা হয়েছে Racial and Religious Hatred Act 2006। আইনের ব্যাখ্যার এক পর্যায়ে বলা হয়েছে একটি উষ্কানীমূলক কথা থেকে দুটি গোত্রের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে সুতরাং একে ছোট করে দেখার কিছু নেই।
আমাদের দেশের সম্প্রতি আটক ব্লগাররা নিশ্চয় জানতেন "তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন,২০০৬" বলে কিছু একটা আছে। এবং এই আইনে কিছু শাস্তির কথাও বলা আছে। এই আইনের কথা জেনেও যদি এমন কিছু তারা লিখে থাকেন যা এই আইন পরিপন্থি,তাহলে তাদের বাচানো কঠিন হয়ে যাবে। আবার আইন জানতাম না এই কথাও বলেও লাভ নেই। আবার ও খুন করেছে বিচার হচ্ছে না আর আমি চুরি করলাম তাই শাস্তি কেন হবে টাইপ কথা বলে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না।
তবে অন্যায় করলে শাস্তি যেমন পেতে হবে তেমনি শাস্তির মাত্রা বলেও একটা কথা আছে। কে কতটুকু অপরাধের জন্য কতটুকু শাস্তি পেতে পারে তা একটি বিবেচনার বিষয়।
ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে লেখার জন্য একজন ব্লগারকে কিংবা লেখককে সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তি (কারাদন্ড) ভোগ করতে হতে পারে। ১ কোটি টাকা জরিমানাও হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন তাই বলে। (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন,২০০৬)
অথচ,
পেনাল কোডের (The Penal Code,1860) ১৪৭ ধারা বলে একজন দাঙ্গাবাজের যে কিনা স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করবে তার শাস্তি হবে মাত্র ২ বছর। ১৪৮ ধারা বলে একজন দাঙ্গাবাজের যে কিনা স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে মরণাস্ত্র সাথে নিয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করবে তার শাস্তি হবে মাত্র ৩ বছর। আর ১৫২ ধারা বলে দাঙ্গাবাজ যদি কারও ক্ষতি (Assault) করে তবে তাকে আরও ৩ বছর সাজা দেয়া হবে।
কাওকে শারীরিক ভাবে আঘাতের শাস্তি ৩ বছর হলে মানসিক অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি কিভাবে ১০ বছর হয়?
হয়তো কোনো উওর আছে কিন্তু আমার জানা নেই। বিজ্ঞ কেউ জানালে বাধিত হবো।
আবার, পেনাল কোডের ২৯৫ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে কেউ যদি কোন ধর্মকে অপমানের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় স্থাপনা ভাংচুর করে তবে তার শাস্তি সর্বোচ্চ ২ বছর।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মীয় স্থাপনা ভাংচুর করার শাস্তি ২ বছর হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শাস্তি কিভাবে ১০ বছর হয়?
হয়তো কোনো উওর আছে কিন্তু আমার জানা নেই। বিজ্ঞ কেউ জানালে বাধিত হবো।
একইরূপে, পেনাল কোডের ৩২৪ ধারাবলে একজন মানুষকে উপর্যুপরি জঘমের (রক্তাক্ত) শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ বছর। সেই একই প্রশ্ন এসে যায়, জঘম করার জন্য ৭ বছর আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জন্য ১০ বছর।
সবশেষে এটুকু বলি একজন ধর্ষক কিংবা এসিড নিক্ষেপ কারীর জরিমানা যেখানে ১ লাখ টাকা সেখানে একজন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কারীর জরিমানা ১ কোটি টাকা ?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:৫৮