"He was the perfect weapon until he became the target."
এক সময়ের ‘বৈধ আততায়ী’ এখন স্মৃতি ভ্রষ্টতার শিকার। কি হয়েছিল তার? নিজের পরিচয় উদ্ধারে সে বিহ্বল। কারা যেন তাকে হত্যার চেষ্টা করছে। কেন? উত্তর সন্ধানে জ্যাসন বর্ন মরিয়া। বহুমুখী জটিলতায় আক্রান্ত এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন লেখক রবার্ট লুডলাম (Robert Ludlum)। ১৯৮০ সালে বর্নকে নিয়ে তিনি প্রথম থ্রিলারটি লিখেন, The Bourn Identity। স্পাই উপন্যাসে এটি অন্যমত সেরা কাজ বলে বিবেচিত। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় সিক্যুয়াল The Bourn Supremacy। তিনি বর্ন কেন্দ্রিক শেষ উপন্যাসটি লিখেন ১৯৯০ সালে, The Bourn Ultimatum। এই বই তিনটি একত্রে দি বর্ন ট্রিলজি নামে বিখ্যাত।
বর্ন চরিত্রটির প্রথম চলচ্চিত্রায়ন হয় ২০০২ সালে। দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পূরণের তাগিদে ডিরেক্টর Doug Liman বর্ন মুভির উদ্যোগ নেন। প্রথম বর্ণ মুভি The Bourn Identity (রেটিং:৪/৫) তিনিই পরিচালনা করেন। বর্ন চরিত্র ও মুভির শিরোনাম লুডলামের বই থেকে নেয়া হলেও গল্প হুবহু এক না। চলচ্চিত্র ও সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তিত। একই ধারায় ২০০৪ সালের মুভি The Bourn Supremacy (রেটিং:৪/৫) এবং ২০০৭ সালের The Bourn Ultimatum (রেটিং: ৫/৫) মুভির গল্প মূল বই থেকে ভিন্ন। শেষোক্ত মুভি দুটি পরিচালনা করেন ব্রিটিশ ডিরেক্টর Paul Greengrass। প্রডিউসারদের সঙ্গে সমঝোতার ঘাটতির কারণে লিম্যানকে আর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
বর্ন নিয়ে প্রথম তিনটি মুভি- মানে দি বর্ন ট্রিলজি আবর্তিত হয়েছে প্রাক্তন CIA (The Central Intelligence Agency- আমেরিকার সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থা) এজেন্ট জ্যাসন বর্নকে (Jason Bourne) ঘিরে। এই মুভি সিরিজটি মেজাজে বাস্তবধর্মী অ্যাকশন/থ্রিলার। স্পাই মুভি প্রতি-ঘরানার (Sub-Genre) অন্তর্ভুক্ত। চলচ্চিত্র দুনিয়ার অতি দুর্লভ ট্রিলজিগুলোর একটি, যা একাধারে বাণিজ্যিক ও সমালোচনার দিক থেকে সফল। বাণিজ্যিক সাফল্য আমলে না নিয়েই বলছি, এই ট্রিলজিটি আমাকে আন্তরিকভাবেই মুগ্ধ করেছে।
Matt Damon (ম্যাট ডেমন) - বর্ন মানেই ম্যাট ডেমন
ফলে বর্ন সিরিজের চতুর্থ মুভি নিয়ে আমি একই সাথে আনন্দিত ও শঙ্কিত হয়েছিলাম। আনন্দিত এই জন্য যে, পর্দায় বর্ন কাহিনী আবার দেখতে পাব। শঙ্কার কারণ, বর্ন নিয়ে আর কোন অরিজিনাল উপন্যাস তো নেই, কিসের ওপর ভিত্তি করে নতুন মুভি হবে? ট্রিলজিতে বর্ন চরিত্রের যন্ত্রণা, ক্ষোভ, প্রতিশোধ মনোভাব অভিনেতা Matt Damon যে চুলচেরা স্পষ্ট করেছিলেন তা কি আর দেখা যাবে? বর্ন বলতে চোখে যার চেহারা ভেসে ওঠে সেই ম্যাট ডেমন তো দূরের কথা, নতুন বর্ন মুভিতে খোদ বর্ন চরিত্রটিই তো নেই! যে মুভিতে বর্ন নেই সেটি ‘বর্ন মুভি’ হয় কি করে? বর্ন সম্পর্কিত কোন ইন্টারেস্টিং গল্প কি এখনও অব্যক্ত থেকে গেছে, যা এবার বলা হবে? নাকি স্রেফ টাকা কামানোর জন্য এই নতুন 'বর্ন মুভি'?
সার্থক বর্ন ট্রিলজির পর ৪র্থ পর্ব The Bourne Legacy (২০১২) কি সফল হতে পারবে? পারবে আগের মতো করে তৃপ্ত করতে? মনে হচ্ছে আনন্দের চেয়ে শঙ্কাটাই বেশি হয়ে গেল! আশা ব্যঞ্জক কি কিছুই নেই?
"They stole his identity. Now he wants it back."
দি বর্ন লিগ্যাসির পরিচালক হলেন মি. টনি গিলরয় (Tony Gilroy)। টনি হচ্ছেন আগের প্রতিটি বর্ন মুভির সহ-চিত্রনাট্য লেখক, তবে বর্ন সুপ্রেমেসির একক চিত্রনাট্যকার। প্রথম বর্ন মুভিটির পর এর কোন সিক্যুয়াল বা এটি ট্রিলজি করার কোন পরিকল্পনা ছিল না। কারণ নির্মাণ-দলের কারও ইচ্ছে নেই এমন সিক্যুয়াল বানাতে যেটি হয়তো বর্ন আইডেন্টিটির মতো সফল বা এর চেয়ে ভালো হবে না। এই সময় স্ক্রিপ্ট রাইটার টনি বর্নের নতুন অভিযাত্রার আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে আসেন। টনির পরামর্শেই প্রযোজকরা গ্রিনগ্রাসকে পরিচালক হিসেবে বেছে নেন। ফলাফল, বর্ন সুপ্রেমেসি সফল হয়। বর্ন আল্টিমেটাম তো প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ বর্ন ট্রিলজির অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে টনির গল্প ও চিত্রনাট্যের অবদান আছে। এবার বলুন দেখি, বর্ণের গল্প টনি গিলরয়ের চেয়ে আর বেশি কে জানেন?
এখন কথা হলো টনি পরিচালনা কেমন করেন? টনি পরিচালিত প্রথম মুভি Michael Clayton (২০০৭, রেটিং:৪/৫) বেশ ভালো লেগেছিল। জর্জ ক্লুনি অভিনীত এই মুভিটি ৭টি অস্কার মনোনয়ন পেয়েছে। টনির চিত্রনাট্য/পরিচালনায় জীবন-ঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছি। চিত্রনাট্যে টনি কখনও বর্ন চরিত্রটিকে জাঁকজমক করে দেখাননি, মাটির কাছাকাছি রেখেছেন। তাই অস্কার নমিনি টনি পরিচালনা করছেন দেখে স্বস্তিই পেয়েছি।
"Remember everything. Forgive nothing."
রবার্ট লুডলাম কোন চতুর্থ বর্ন নভেল লিখেননি। ২০০১ সালে তিনি মারা যাবার পর লেখক Eric Van Lustbader বর্ন ট্রিলজির অফিসিয়াল সিক্যুয়াল/সিরিজ লিখতে শুরু করেন। এ যাবৎ (২০০৪-২০১২) তিনি ৭টি বর্ন থ্রিলার লিখেছেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত দি বর্ন লিগ্যাসি নতুন সিরিজের প্রথম বই। চতুর্থ বর্ন মুভিটির নাম এখান থেকেই ধার করা। যেহেতু মুভিতে বর্ন নেই কিন্তু বইয়ে বর্ন আছে তাই মুভির গল্পটি বইয়ের থেকে ভিন্ন। মুভির গল্প টনি গিলরয়ের। চিত্রনাট্যে টনির সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন তার ভাই ড্যান গিলরয়। আরেক ভাই জন গিলরয় এই মুভির এডিটিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
এবার আসা যাক সিরিজের নতুন অভিনেতার কথা। পল গ্রিনগ্রাস যখন বললেন, তিনি আর বর্ন মুভি পরিচালনায় আগ্রহী না, তখন ম্যাট ডেমন জানিয়ে দিলেন, গ্রিন না থাকলে তিনিও বর্ন চরিত্রে ফিরবেন না। এমন অবস্থায় স্টুডিওতে সিদ্ধান্ত হলো, অন্য কাউকে বর্ন চরিত্রে নেয়া হবে না। বর্ন চরিত্রটিই থাকবে না। নতুন মুভির প্লটটি বলতে পারেন বর্ন ট্রিলজির সাইড স্টোরি। বর্ন/ম্যাট ডেমন এখন ফ্ল্যাশ ব্যাকে।
Jeremy Renner (জেরেমি রেনার) - বর্ন মুভির নতুন স্টার
জ্যাসন বর্ন ছাঁচের নতুন কেন্দ্রীয় চরিত্রে নেয়া হয়েছে জেরেমি রেনারকে (Jeremy Renner)। সত্যি বলতে কি, বর্ন চরিত্রে অন্য কাউকে না নেয়ার সিদ্ধান্তটি আমার মতে সঠিক ছিল। বর্ন চরিত্রটি 'বন্ড চরিত্র' না যে ইচ্ছা মতো অভিনেতা পাল্টে ফেললাম। ডেমনের বদলে অন্য কাউকে গ্রহণযোগ্য করাটা সত্যিই কষ্টকর। এই মুহূর্তে আমার সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে পড়ছে। সত্যজিৎ দুটি ফেলুদা মুভি বানিয়েছিলেন। সোনার কেল্লা (১৯৭৪) ও জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯)। দুটোতেই জটায়ুর ভূমিকায় 'আউট অফ দি ওয়ার্ল্ড' পারফরম্যান্স করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। সত্যজিৎ এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, পরবর্তীতে ফেলুদা গল্পগুলো লিখতে গিয়ে তিনি জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্তকেই কল্পনা করতেন। বইয়ে জটায়ু হিসেবে সন্তোষের স্কেচ আঁকতেন। সন্তোষ মারা যাবার পর সত্যজিৎ বলেছিলেন, সন্তোষকে ছাড়া জটায়ুকে ভাবাই যায় না। তাই আর কখনও ফেলুদা মুভি বানানো সম্ভব না। সত্যজিৎ তৃতীয় কোন ফেলুদা মুভি বানাননি। যা হোক, জেরেমিকে আমার ভালোই লাগে। দি হার্ট লকার (২০০৮, রেটিং: ৫/৫) ও দি টাউন (২০১০, রেটিং: ৪/৫) মুভিতে অস্কার মনোনয়ন প্রাপ্ত জেরেমির পারফরম্যান্স দারুণ লেগেছিল। প্রসঙ্গক্রমে যদি জিজ্ঞেস করেন, বর্ন চরিত্রে নতুন কাউকে আনতে হলে আপনি কার নাম প্রস্তাব করবেন? লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও আমার পছন্দের নাম।
থ্রিলার মুভির অন্যতম প্রাণ থ্রিলিং মিউজিক। Bourne Legacy-র প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে মুভিটির মিউজিক করেছেন অ্যাকশন/থ্রিলার মুভির মিউজিকে সিদ্ধহস্ত গ্র্যামি বিজয়ী James Newton Howard (কিং কং, দি ডার্ক নাইট, ডিফায়েন্স ইত্যাদি)। যার ক্রেডিটে আছে ৮টি অস্কার নমিনেশন। শতাধিক মুভিতে মিউজিক করার অভিজ্ঞতা।
ভালো-মন্দ সম্ভাবনার একটা বিশ্লেষণ তো হলো। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুভির কাস্ট থেকে ক্রু সবার ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো হলেও অনেক সময় তা কাজ করে না। আবার এটাও দেখা যায়, টিমের কারও ঝুলিতে তেমন কোন কীর্তি না থাকলেও কোন প্রজেক্ট সফল হতে পারে। তাই একটি মুভির সাফল্য সম্পূর্ণ নির্ভর করে সেই মুভির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সেই মুভিতেই পারফরমেন্সের ওপর। আগের বাত, পরের বাত- সম্পূর্ণ বাদ!
(আগামী পর্বে সমাপ্য:- দি বর্ন সিরিজ: The Bourne Legacy)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:২৯