আব্বা বই লেখবে - এ জাতীয় ফিসফাস বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বাসার বাতাসে ঘুরে বেড়াতে লাগল। চাপ দাড়ি ওয়ালা এক লোক বাসায় আসা যাওয়া শুরু করেছে। সে কে ? কি তার আগমনী হেতু এই বিষয়ে কেউ মুখ খুলছে না। টেনশনে আমার মরে যাবার যোগাড় । এই লোক যে বই সংশ্লিষ্ট তা আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি কয়েকদিন আগেই। প্রথমে আব্বা তার সাথে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে কথা বলার ফাঁকেফাঁকে জোরে ডেকে আম্মাকে বলতো, এই কই বুঝছনি। এইদিগে একটু চা পাঠাও। আম্মাও কাপ পিরিচ ধুয়ে হুকুম তামিলের জন্য অপেক্ষায় থাকতো। আব্বা হাক ছাড়ার সাথে সাথেই কাপ পিরিচের টুংটাং আওয়াজ করে বুঝিয়ে দিত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একটা বিস্কিট হাতে নিয়ে হয়ত আব্বার সামনে এসে দাঁড়াতাম। আব্বা নিশ্চিত হত কিছুক্ষন আগে আনা পাইনএপেল বিস্কিট খোলা হয়েছে। চা আসতে দেরি নেই তাহলে। আমাদের এই ঘূর্ণন আমাদের দোদুল্যমান সংসারের মুল অভিনয়। ক্যামেরার সামনে যে আব্বা আর প্রকাশক বসে আছেন তারা অভিনেতা আর অভিনেত্রী সময়ে অসময়ে। আর আমাদের অভিনয়টা চিরন্তন, চির খাটি। একই নাটকে প্রচারিত অনেক গুলো সংসারের খন্ড খন্ড চিত্র। ইদানিং লোকটা এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। আমাকে শিখিয়ে দেয়া হয়, গিয়ে বল আব্বা এখনো বাসায় আসে নাই। আমি বিরস মুখে গিয়ে বলি , আংকেল আব্বা এখনো আসে নাই। ওই টুকু বলেই যোগ করি , মনে হয় পাচ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে। আবার ফিরে এসে আব্বাকে বলি -'তারাতারি যান। উনি মনে হয় পাচ মিনিটের মধ্যেই চইলা যাইব। দুজনকে এক টেবিলে পাশাপাশি বসানোর শিশুতোষ প্রচেষ্টা। চার মাস ধরে আব্বার বেতন বন্ধ। টিনের চালের শিম খেয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। আব্বার এই দুঃসময়ের ভং আমাকে আতঙ্কিত করে তুলল। আম্মার পিছু নিলাম ।
আম্মার সাথে ব্যাপক জোড়াজুড়ির পর যা জানলাম তা আমাকে আরও ডিসএপয়েন্টেড করল । তার কথার সারমর্ম হল , এডভান্স না নিয়া লেখালেখি শুরু করা উচিত না। এতে লেখকদের সম্মানের হানি হয়। তোর আব্বা কোন যেনতেন সাধারন ব্যাক্তি না যে প্রকাশকদের হাতের পুতুল হইয়া লাফালাফি করব। বুঝলাম এই মহিলাও আমার মতই আরেকটি অভিনয় চরিত্র। আমার এই আম্মাটি আব্বার সব কথা বিশাস করতো। আব্বাকে ভক্তি করতো, শ্রদ্ধা করত। আম্মার এইসব বোকামির কষ্টটা আমার কাছে কোন অংশেই কম ছিলনা কোন সময়। মায়ের এই চির ভুল বিশ্বাস তাকে কোন নরকে নিয়ে গিয়েছিল সে গল্প না হয় অন্য কোন সংসারের সাথে জুড়ে দিব। এই সংসারের সব কথা কি আর প্রকাশ করা যায়? অন্য চরিত্রে অন্যের মায়ের গল্পের ছলে আমার মায়ের চোখের পানি গুলো কোন একদিন হয়তো ইতিহাসে লেপ্টে দিব।
অবশেষে এই অচলাবস্থা কাটাতে এগিয়ে এলো চিমটা প্রকাশক নিজেই। দশ টাকা আর বিশ টাকার নোটে এডভান্স হিসেবে নিয়ে এলো পাচ হাজার টাকা। পুরো ঘরে টাকার বন্যা বয়ে গেল। আব্বা সাথে সাথেই বাদশা মিয়ার বাজার থেকে চল্লিশ টাকায় বিরাট এক ম্রিগেল মাছ কিনে ফেললেন। আমাদের ঘরে চার মাস পরে ভাজা মাছের গন্ধে মৌ মৌ করতে লাগলো। আমি এ ঘর ও ঘর করতে লাগলাম। আড় চোখে খেয়াল রাখছি আম্মা আমার জন্য ভাজা মাছ তুলে রাখবে কিনা। টিনের চাল থেকে সীম পাড়লাম। পাতে মাছ জুটে গেল ঠিকই কিন্তু সীম কে হটানো গেল না। আম্মা বার বার করে প্রমান দেখাতে লাগলেন আব্বা যেনতেন কোন লোক না। সমাজে এতদিন তাঁর মুল্যায়ন হয়নাই। এখন সমাজ বুঝবে কত ধানে কত চাল । আমি খুব খেয়াল করে দেখলাম আম্মার চোখ চিকচিক করছে। কোন কারনে খুশি হলে এই মহিলা চোখে সুরমা দেয়। কে জানে আজও হয়ত কোন ফাকে সুরমা দিয়েছে।
আব্বা সন্ধার আগে আগেই কাগজ কলম নিয়ে বসে পরলেন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে টেবিলের নিচে জলতে লাগল মিটমিটে আলোর হারিকেন। মেহমান চলে গেলে এই সংসারে দুধ, চিনি আর বিস্কিট থাকত না। আম্মা কয়েক দানা লবন দিয়েই মগ ভর্তি চা নিয়ে এলেন। আমাকে ইশারায় বুঝালেন এখানে হইচই করা যাবে না। কোন রকমের ডিস্টার্বে লেখকদের মনঃ সংযোগে ব্যাঘাত হয়। আমি পায়ে পায়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলাম।
দুর থেকে দেখতে পাচ্ছি আম্মা মুগ্ধ চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে। দা রেনেসাঁস ইংলিশ গাইড লেখার কাজ তরতর করে এগিয়ে চলছে ।
৪/৬/১৪ ইং