somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নেড়ি কুকুরের সেকাল একাল -১

২৬ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :







আরও চারটা ভাইবোনের সাথে আমার জন্ম হয় একটা গোয়াল ঘরে। মাঘের তীব্র শীত উপেক্ষা করে মা আমাদের পাঁচজন ভাইবোনকে নিয়ে সারারাত কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকতেন। কাদা, স্যাঁতস্যাঁতে ময়লা পানি আর কোন না কোন গরুর বিরামহীন প্রস্রাব চলতেই থাকত রাত বিরাতে। আমাদের মা আমাদেরকে এমনভাবে আগলে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি হয়ে নিজেকে বেকিয়ে রাখতেন যেন মল মুত্রের কোন ঠাণ্ডা পানি আমাদের গায়ে না লাগে। তার পিঠ ভিজে একাকার হয়ে যেত, যা দেখে ভারী কষ্ট হত আমার। আমি শুনেছি, কুকুরের সব বাচ্চা বাচেনা। আমার খুব ভয় হত, আমাদের পাচজনের মধ্যে কে আগে মারা যাব ? আমি যেহেতু সবার চেয়ে ছোট, ভিতু, এবং দুর্বল তা-ই ভয়ের রেখাটা মনের মধ্যে আমার দিকেই নির্দেশ করত। একটু বড় হয়ে যখন দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ গুনে লটারি করতে শিখলাম তখনো অকাল মৃত্যুর রেখা আমাকেই দেখিয়ে গেছে বারবার। যখন অন্য ভাইবোনকে আমার আশংকার কথা বলতাম তারাও আমার মত গুনে গুনে দেখিয়ে দিত তাদের মৃত্যু নেই। নিজেকে ধরে গুনতে শুরু করলে সেই রেখা যে আমার ঘরেই এসে শেষ হবে সেটা-ই তো ধরতে পারিনি কখনো। কুকুর হয়ে জন্মে আপনি সর্বোচ্চ কৃতজ্ঞ হয়ে বাচতে শিখবেন,এর বেশি কিছু নয়। তবে এর জন্য কখনো না কখনো আপনাকে মুল্য দিতেই হবে। কোন শীতের ভোরে আপনি হয়ত আরাম করে রোদ পোহাচ্ছিলেন, হঠাত-ই বুঝতে পারলেন আপনার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাচ্ছে। পুড়ে গেছে দেহ আর অন্তর। শুধুমাত্র কোন একজন মহিলার পক্ষেই সম্ভব আপনার পেটে ভাতের গরম মাড় ঢেলে দেয়া। ভাগ্য দেবী অতি প্রসন্ন হলে দীর্ঘ জ্বালা যন্ত্রনা সহ্য করে আপনি হয়ত বেঁচে যাবেন, যদি তা না হয় তবে জীবিত থাকতেই দেখবেন, পুড়ে যাওয়া ঘা’য়ে সাদা সাদা পোকা হয়েছে। সেই পোকারা একটু একটু করে আপনাকে খাচ্ছে। সেভাবে চিন্তা করলে, আমি যে এক জীবন সজ্ঞে কাটিয়েছি তা মিথ্যে নয়। আমাকে এমন ভয়ংকর গরম ভাতের মাড়ের জ্বালা সইতে হয়নি কখনো-ই। আমার মালিকই আমার ঈশ্বর। এরচে বড় ঈশ্বর দিয়ে আমি কি ঘোড়ার ঘাস কাটতাম ?








হাঁ, যে গ্রামে জন্মেছিলাম সেই গ্রামটি শহর থেকে অনেক দুরের পথ ছিল না। আমাদের গ্রাম আর শহরের মধ্যে বিভেদের সরল রেখাটি প্রথম একে দিয়েছিল আমার গোমতী নদী। আমার প্রানের গোমতী। আহারে আমার নদীটা হারিয়ে গেছে। আমরা যে বাড়ির মালিকের গোয়াল ঘরে রাত্রি যাপন করে জীবনের প্রথম চারটে মাস কাটিয়েছি সেই পরিবারটা দেখতে দেখতে শহরমুখী হতে শুরু করল। একজন একজন করে বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে তারা। কি সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে নাকি। আমার ছোট্র হ্রদয়ে খুব কষ্ট হতে শুরু করল যেদিন এদের পুরো বাড়িটাই খালি হয়ে গেল। আমাদের মা গত হয়েছেন নাকি হারিয়ে গেছেন আমি সেটা জানতেও পারিনি। আমার ভাই বোনেরা একে একে যখন সংগী বেছে নিচ্ছিলেন, তখন আমার বুকে দুরুদুরু কাপন শুরু হল এই শংকায় যে, তারা তো সবাই দেখি বড় হয়ে গেছে। গায়ে গতরে আমিও যে খুব ছোট তা নয়। কিন্তু আমি ত ছোট-ই। এরা কি তাদের পরিবার নিয়ে আলাদা আলাদা থাকতে শুরু করবে এক সময় ? আমি কার সাথে থাকব ? আমার কপালে একজন নারী কুকুর যদি জুটেও যায় তখন কি হবে ? থাকব কোথায় ? বাবার ঘরে ? বাবার তো ঘর নেই। অন্যদের মত স্বাধীন শক্তিশালী নিজস্ব ব্যাবস্থাপনা গড়ে তুলব ? সেটা কিভাবে সম্ভব? আমি ছোট মানুষ না ? আমার পাশে ভাই বোন’রা না থাকলে আমি মরেই যাব। বউ,সংসার,ছেলেপুলে নিয়ে মানুষের মত স্বাভাবিক একটা জীবনকে বেছে নেয়ার মত মানসিক শক্তি আমার হয়নি। বড় ভাইয়া না থাকলে আমার ভাত খাইয়ে দেবে কে ? আমি ছোট না? এসব হাজারো ভাবনা আমার ছোট্র মাথায় সারাক্ষন কিলবিল করত, চোখে পানি এসে পড়ত বারবার। কিন্তু কোন কুল কিনারা খুঁজে পেতাম না কখনো। তারপরেও একে একে সবাই চলে গেলে, আমি সেই পরিবারটার পিছু পিছু একদিন শহরে চলে এলাম। হয়ে গেলাম শহুরে কুকুর। আগে যেমন আমাকে বেশিরভাগ সময় ছোট মানব শিশুদের গু খেয়ে, ভাতের মাড় খেয়ে কিংবা না খেয়ে কাটাতে হত, শহরে আসার পর এ সমস্যার বিপুল সমাধান পেয়ে গেলাম। এখানে ডাস্টবিনেই শুধুমাত্র যে পরিমান খাবার জমে তা আমার মত ক্ষুদ্র পাকস্থলী নিয়ে জন্মানো কুকুরের পক্ষে একা খেয়ে শেষ করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া দিনে দিনে রুচিরও পরিবর্তন চোখে পড়ছিল। বাসি খাবার খাওয়া প্রায় ছেড়ে-ই দিয়েছিলাম। আমার চেহারা নাদুসনুদুস হয়েছিল, দেখতে দেখতে আমার কত বিপুল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল গত অর্ধ যুগে সেটা আমার চোখে খুব একটা ধরা পড়েনি। তাই বলে আমার পরিচয় তো কুকুর থেকে মানুষ হয়ে যায়নি নিশ্চয়ই। কুকুর হয়েও নিজেকে সাহেবী কুকুর, বুদ্ধিমান কুকুর, মানুষের নানান আচার রপ্ত করা আধুনিক কুকুর হিসেবে আমি সম্ভবত নিজেকে যতটা সম্মান করতে শুরু করেছিলাম ততটা সম্মানের যোগ্য তখনো আমি হয়ে উঠিনি। কে জানে, ওভার এস্টিমেট করে নিজেকে কখনো কারো সামনে মানুষ বলে ফেলেছি কিনা ? বিষয়টা পরিস্কার হল একটা চিঠিতে। অন্যের চিঠির দিকে তাকাতে নেই জেনেও কিভাবে যেন তাকিয়ে ফেললাম। কুকুর তো !! কেমন যেন অসহিস্নুতার গন্ধ পাচ্ছিলাম। মালিককে তার বন্ধু চিঠি লিখেছে। চিঠির একেবারে শেষে, বিঃদ্রঃ দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘তোদের বাসার আগের কুকুর ছানাটা কি এখনো আছে ? সে কি নিজেকে এখনো বড় কুকুর ভাবে ? তোদের কুকুরটাকে দেখলেই আমার খুব হাসি পেত, বুঝলি ? নেড়ী কুকুর কি কখনো সাহেবী কুকুর হতে পারে, নাকি হয়েছে কখনো ? সে হয়ত আগের চেয়ে বড় কুকুর হয়েছে কিন্তু বোকার মত শত চেষ্টা করলেও কিন্তু শালা জাত বদলাতে পারবে না’......... এটুকু পড়েই আমি মাটিতে বসে পড়েছিলাম। আহারে আহা... যে লোকটাকে দেখলেই আমি লেজ নাড়িয়ে সামনে যেতাম এক দৌড়ে, জিব্বা দিয়ে চেটে দিতাম তার পা, যাকে দেখলে আমার আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে যেত, যাকে দেখলে পাগলামি ভর করত আমাত মাথায়- এটা তার চিঠি ? হ্যাঁ, এটা তারই চিঠি। আমি ভাবী কি, আর ঈশ্বর করেন কি ?





কাউকে কোন কিছু বুঝতে না দিয়ে মালিকের বাড়ির পেছনের ফাকা জায়গাটায় কিছুক্ষন শুয়েছিলাম। গড়াগড়ি করে বুকের ব্যাথাটা কমাতে চেয়েছিলাম, গলায় আটকে যাওয়া গুটলিটাকে বারবার ঢোক গিলেও নিচে নামাতে পারছিলাম না। ঠিক এমনই দুঃসময়ে আমার প্রভুর স্ত্রী ( মানে জন্মের পর থেকে যার খাই, পরি ) এসে হিংস্রভাবে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কোন পরিবারের কোন লেভেল থেকে উঠে এসেছ এটা জানো ? তুমি কি আমাদের ব্ল্যাক হাউন্ডের নতুন বাচ্চাটার সাথে দুর্ব্যাবহার করেছ? তুমি কি জানো না, নেড়ি কুকুর আর ব্ল্যাকির পার্থক্য ? দোয়া আর ক্ষমা একজন কুকুর কতবার পেতে পারে ? ঠিক এ সময় ব্ল্যাকি কেঁদে উঠল। তার সামনের দুই হাত আর বুকে আমার আঁচড়ের ক্ষত দেখাচ্ছে আমাদের মালিককে। আমি ভয়ে মাটিতে মিশে যাবার চেষ্টা করলাম। মিনমিন করে বললাম-খালাম্মা, সেদিনও আপনার ছেলে আমার বুকে প্রচন্ড লাথি মেরেছে। ভয়ে নালিশ করিনি। আমি সামান্য একটা নেড়ি কুকুর যার জন্ম হয়েছে একটা গোয়াল ঘরে, যার পিতৃ পরিচয় নেই, মা নেই। অন্য স্বজনেরা কে কোথায় আছে জানিও না। সেই কুকুর কবে এতটা বেড়ে গেল যে, বোম্বে থেকে কিনে আনা ব্ল্যাক হাউন্ড বা ব্ল্যাকির বুকে আমি আচড় কেটে দেব ? সামান্য একটা নেড়ি কুকুর ভদ্র লোকদের সাথে থেকে কথা বলা শিখেছে, একটু আধটু পড়তে পারে, সাহেবী আদব কায়দাও কম বেশ জানে কিন্তু তাই বলে সে তো আর মানুষ হয়ে যায়নি !! সে নিজেকে কি ভাবত ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে আমাকেই। সময় কম, খুব কম সময় হাতে আমার। আমি কি এই গল্পটা শেষ করে যেতে পারব নাকি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হব ? দুটো কাজ করার সময় নেই নিশ্চিত। আমাকেই ঠিক করতে হবে হুইচ ওয়ান শ্যাল আই চুজ ...............


( চলবে............ )

২৬ শে মার্চ,

আজ এই নেড়ি কুকুর তার ব্যাক্তিগত জীবনের স্বাধীনতা নিজ হাতে তুলে নেবার ঘোষণা দিয়েছে।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১২:৫৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×