আয়রন চেষ্টের মাথার ওপরে একটা সুন্দর টেবিল ঘড়ি। ব্যাংকক থেকে আনা। খালা দিয়েছেন। এই একই রকমের ঘড়ি একখানা তাঁর বাড়িতে, একখানা বড় মামার ঘরে আর একখানা সম্ভবত নানার ঘরে দেখেছিলাম। সব জায়গায়ই ঘড়ি গুলো খুব যত্ন করে রাখা। তখন আমি অনেক ছোট। ৯০'য়ের গোড়ার দিকে বা তার আগে। আমরা জয়পুরহাট থাকতাম। পাতি এনালগের যুগ। মনে আছে জয়পুরহাট ইষ্টিশনে জিনিসপত্রের ওজন মাপার জন্য একটা বড় গদিওয়ালা নিকতি ছিলো। এর ময়লা ঘিয়া ডায়ালটা অনেকটা বড় গ্র্যান্ডফাদার ক্লক টাইপের ছিলো। কালো লম্বা একটা কাঁটা। ঐ সোফার মতন গদিটাতে জিনিসপত্র রাখা হলে নিকতির ডায়ালে কাঁটাটা ঘুরে ওজন বলে দিত। রাজশাহীতে যাওয়ার সময় আমরা যখন ইষ্টিশনে আসতাম, তখন আমাদের দুই ভাইবোনের আনন্দদায়ক কাজ ছিলো ঐ গদি ফাঁকা পেলেই ওর ওপর উঠে লাফানো। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে জং ধরা স্প্রিংয়ের শব্দ হতো, তার তালে তালে বুড়ো কাঁটাটা তিরিং বিরিং করে নাচতো। কত গুলো কালো ইঁদুর বিরক্ত হয়ে গদির ফাঁক ফোঁকর গলে বেড়িয়ে আসতো। আমাদের কে রাজশাহী নিয়ে যাওয়ার জন্য নানা লোক পাঠাতেন, "করিম বাবাজী"।মালামাল সেকেন্ড ক্লাসে তুলে দিয়ে এসে করিম বাবাজী আমাদের ধমক দিয়ে নামাতেন। তারপর আমরা ট্রেনে উঠে গিয়ে বসতাম মার সাথে। উঠতাম বললে ভুল হবে, আমাদের জানালা দিয়ে ট্রেনের কামরার ভিতরে চালান দেয়া হত। আমরা মার কাছে গিয়ে বসতাম আর লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকতাম লোহার নোংরা বালতিতে পানি আর বরফের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা কাঁচের ফান্টার বোতলের দিকে। মা বলতো ওগুলো ড্রেনের পানি দিয়ে তৈরি হয়। বড় হয়ে শেষ বার যখন জয়পুরহাট ইষ্টিশনে যাই তখন ওই বুড়ো গদিওয়ালা নিকতিটির আর দেখা পাইনি।
আয়রন চেষ্টের মাথার ওপরে একটা সুন্দর টেবিল ঘড়ি। ব্যাংকক থেকে আনা।সম্পূর্ণ বডিটা ষ্টীলের, ফ্রেম রুপালী পালিশ করা,দুইটা কালো রং করা কাষ্ট আয়রনের পায়া, কাঁচের আবরণে পিছে রুপালী চারটি কাঁটা, টিকটিক, টিকটিক, টিকটিক। কাঁটার পেছনেই যাদুময় সেই আয়াতকার ডায়াল, গাঢ় নীল রংয়ের ঝকঝকে আকাশ, তাতে কিছু তুলোর মতন মেঘ।লাল সাদা ভুবন ভিলা গাছের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে। ডায়ালটা এতটাই জীবন্ত ছিলো যে এর দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা ঘোরের মত তৈরি হত, তাকিয়েই থাকতাম। দিবাস্বপ্নের মাঝে উড়ে যেতাম ওই গাঢ় নীল রংয়ের ঝকঝকে আকাশে, তাতে কিছু তুলোর মতন মেঘ। একটা সুন্দর বিকেলের আকাশ মনে হতো ওটা। আমি পাখি হয়ে উড়ছি, উড়ছি। উড়ে গিয়ে বসছি একটা তুষার পড়া পাথরের ঝুলন্ত বারান্দায়। সেটা অন্য আরেকটা জগৎ যেন। ভয়, চাপা আনন্দ, মুক্তির স্বাদ সব কিছুর মিশেল একটা অনূভুতি জাগিয়ে তুলতো সেই আকাশ। আয়রন চেষ্টের মাথার উপরে টেবিল ঘড়ি রাখার কারণ ছিলো আমি ঐখানটা হাতে পাতাম না। অনেক জেদ করলে মা ঐ ঘড়িটা নামিয়ে দিতো আমার হাতে, আমি বিছানায় বসে অতি সাবধানে নিয়ে দেখতাম। খুব সম্ভবত পেছনে ছিলো তিনটা চাবি। বড় চাবিটা ছিলো দম দেয়ার, মেজোটা ছিলো ঘড়ির কাটা ঘুড়ানোর, ছোটা ছিলো এলার্মের চাবি। একটা প্লাস্টিকের ছোট্ট সাদা নব ছিলো, সেটা দিয়ে এলার্ম লক করা হত আর বন্ধ করা হতো। আমি কত বিকেল যে, ঐ ঘড়িটার ডায়ালে আকাশ দেখেছি, হারিয়ে গেছি সেই দিবাস্বপ্নে..।
ঘড়িটার শেষে যে কি হয়েছিলো তা আর মনে নেই। শুধু সেই যাদুময় ডায়ালটার কথা মনে আছে। গাঢ় নীল রংয়ের ঝকঝকে আকাশ, তাতে কিছু তুলোর মতন মেঘ। লাল সাদা ভুবন ভিলা গাছের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে। এখনো মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি। উড়ে যাচ্ছি ওই গাঢ় নীল রংয়ের ঝকঝকে আকাশে, তাতে কিছু তুলোর মতন মেঘ। একটা সুন্দর বিকেলের আকাশ। আমি পাখি হয়ে উড়ছি, উড়ছি। উড়ে গিয়ে বসছি একটা তুষার পড়া পাথরের ঝুলন্ত বারান্দায়। আরেকটা জগৎ। ভয়, চাপা আনন্দ, মুক্তির স্বাদ সব কিছুর মিশেল সেই অনূভুতি ঘুমের মধ্যেও টের পাই।পিছনে অর্কেস্ট্রার মত বাজে টিকটিক, টিকটিক, টিকটিক।
আমাদের দেশের আকাশ একটু ফ্যাকাসে। শুধু কাল বৈশাখী ঝড়ের পর গোধূলি বেলায়, কন্যা সুন্দরী আলোয় আকাশটাকে অনেক মায়াবী লাগে। আসলে ঐ সময় সবকিছুই মায়াবী লাগে। মসজিদের আযান, হিন্দু বাড়ির শঙ্খ ধ্বনি এক অন্যরকম দৈবিক পরিবেশ তৈরি করে। নিজের দেশের বিভিন্ন জায়গার আকাশের সাথে, সচক্ষে অন্য আরেকটি দেশের বেশ কিছু জায়গার আকাশ দেখা হয়েছে। অন্য আকাশ গুলো একটু বেশী নীল।
নিচে আমার দেখা সুন্দর নীল আকাশের কিছু ছবি দিচ্ছি। তবে ঐ ঘড়ির গাঢ় নীল আকাশের মত কোনটাই না।হয়তো একদিন দেখবো সেই আকাশ, সেই আশায় আছি
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৫৪