বাংলাদেশে এখন উন্মাদের শাসন চলছে
বদরুদ্দীন উমর
খুব ছোট মাপের লোক ঘটনাচক্রে ক্ষমতার গদিতে বসলে যা হওয়ার কথা সেটাই এখন বাংলাদেশে ঘটছে। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নির্বাচনে পরাজিত বিরোধী দলকে ‘পরাজিত শত্রু’ আখ্যা দিয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে সমাসীন হয়েছেন। যে লোক যে কাজের উপযুক্ত নয়, তার ঘাড়ে সে কাজ পড়লে ছোট মাপের লোকের মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ ধরনের লোকেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে নিজের চারদিকে চাকর-বাকর ধরনের লোককে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা ইত্যাদি পদ দিয়ে খোশমেজাজে দেশের শাসন কাজ পরিচালনা করতে নিযুক্ত হয়। ঠিক এ কারণে বর্তমান সরকারে যারা মন্ত্রিত্বের পদ লাভ করেছেন, তাদের অধিকাংশকেই আমাদের মতো লোক তো দূরের কথা, তাদের দল ও বিভিন্ন সংগঠনের লোকেরাও চেনে না। এদের অধিকাংশ হলো ইংরেজিতে যাকে বলা চলে ্তুভধপবষবংং্থ লোক। এই ভুয়া জনপ্রতিনিধিদের প্রধান কাজ, এমনকি অনেকের একমাত্র কাজ হলো চুরি, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের অর্থসম্পদ লুটপাট করা এবং এই লুটের ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পকেটে গোপনে চালান করা। যেহেতু জনগণের সঙ্গে এদের কোনো প্রকৃত যোগাযোগ নেই, সে কারণে জনগণের ভোট পেলেও জনগণের স্বার্থ এরা দেখে না। শুধু তাই নয়, এরা জনস্বার্থবিরোধী। কাজেই নিজেদের সবটুকু ক্ষুদ্র বুদ্ধি ব্যবহার করে এরা জনগণের পকেট মেরে নিজেদের পকেট ভর্তি করে। ফসলের জমিতে টিড্ডি পোকা পড়লে যেমন জমি ফসলশূন্য হয়, তেমনি এরা মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ইত্যাদির গদিতে বসে দেশের শ্রমজীবী কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তদের কষ্টার্জিত অর্থসম্পদ এমনভাবে আত্মসাত্ করে যাতে দেশের নব্বই শতাংশেরও বেশি লোক চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত হন। কাজেই নির্বাচনে পরাজিত পক্ষকে এরা যতই দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরাজিত শত্রু বলুক, এরা নিজেরা যে জনশত্রু এটা ক্ষমতায় থাকার অল্পদিনের মধ্যেই তারা অভ্রান্তভাবে প্রমাণ করে।
অল্প বুদ্ধি এবং অল্প শিক্ষা নিয়ে একটি স্কুল পরিচালনার যোগ্যতাও শেখ হাসিনার আছে কি-না সন্দেহ। কিন্তু পশ্চাত্পদ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে এই ধরনের লোকেরা নির্বাচিত হয়ে দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব লাভ করেন। যেহেতু এরা জনস্বার্থে কাজ করার পরিবর্তে জনগণের পকেট মারতেই ব্যস্ত থাকেন, এজন্য দেশের হাজারো সমস্যার সঙ্গেও এদের পরিচয় নেই। দেশের উন্নতি এবং অগ্রগতির জন্য পরিকল্পিত কর্মসূচিও এদের নেই। নির্বাচনের আগে লম্বা-চওড়া কথা বলে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, গদিতে বসে সেগুলো এরা ময়লার বাক্সে ফেলে। বর্তমান আওয়ামী জোট সরকার এ কাজটিই করছে। নামে জোট বা মহাজোট সরকার হলেও আওয়ামী লীগ ছাড়া কার্যক্ষেত্রে এই জোটের অন্য শরিকদের কোনো পাত্তা নেই। এদের শরিক দলের নেতারা চাতকের মতো মন্ত্রিত্ব লাভের আশায় হা করে থাকে।
বাংলাদেশের এই অযোগ্য প্রধানমন্ত্রী ও তার অযোগ্য সরকার দেশের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে যে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়েছে, এটা তিস্তার পানির হিস্যা লাভ, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে এদের ভূমিকা ও ব্যর্থতা থেকেই প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির লাথি খেয়ে এরা ধরাশায়ী হয়েছে। কিন্তু এরা এতই নির্লজ্জ যে, এদের এই ধরাশায়ী অবস্থায় জমিনের ওপর পড়ে থেকেও এরা নিজেদের ‘সাফল্যের’ গান গাইছে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় সভা করে নিজেদের যেসব সাফল্যের কথা মানুষকে শোনাচ্ছেন, তার ওপর কানাকড়ি বিশ্বাসও কারও নেই।
এবার আসা যেতে পারে এমন এক বিষয়ে যার অর্থ কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন লোকের পক্ষে বোঝা অসম্ভব। ঢাকা শহরকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় পাস করিয়ে ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদেও তারা পাস করিয়েছে। এই দ্বিখণ্ডীকরণের মাধ্যমে ঢাকার লোককে অতিরিক্ত সুবিধাদানই নাকি এর উদ্দেশ্য! শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের বাইরে প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী মহল এবং ব্যাপকতম জনগণ কেউই সমর্থন করে না। কেউই এ নিয়ে কোনো দাবি করেনি। উপরন্তু আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও শেষ পর্যন্ত এই মর্মে জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পাসের পর দিকে দিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। এই আইন নাকচ করার দাবি ব্যাপকভাবে উঠছে। দুনিয়ায় এমন কোনো দেশ নেই যারা ঢাকার মতো একটা বিশাল রাজধানী শহরকে দ্বিখণ্ডিতকরণের চিন্তা পর্যন্ত করে। কিন্তু অন্য কোথাও যার কোনো দৃষ্টান্ত নেই সেই কাজই আওয়ামী লীগ করেছে। প্রস্তাব পেশ করে তিন-চার মিনিটের মধ্যে জাতীয় সংসদে এই বিল পাস হয়েছে! তাদের দলের এবং তাদের তথাকথিত মহাজোটের কোনো সদস্যই এ নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগ পাননি। স্পিকারও এ নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগ কাউকে দেননি!! শুধু আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্যই নয়—তাদের মহাজোটের কোনো শরিকও এ নিয়ে সংসদে আলোচনার দাবি সংসদের অভ্যন্তরে করেননি। তাদের ভূমিকা এক্ষেত্রে হাসিনার আজ্ঞাবাহী চাকর-বাকরের মতোই লেগেছে।
আওয়ামী লীগ অনেক দুর্নীতি ও অপকীর্তি গত তিন বছরে করেছে। তার মধ্যে ক্ষুদ্র বুদ্ধির পরিচয় থাকলেও ঢাকা শহর দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত ও সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা শুধু ক্ষুদ্র বুদ্ধিরই কাজ নয়। এ কাজ হলো ঘোরতর উন্মাদের। ঢাকা শহর দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত যে ঢাকায় এক মহাবিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, এতে সন্দেহ নেই। ঢাকার একজন অধিবাসীও যে এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন, এমন শোনা যায়নি। এই সিদ্ধান্ত যে ঢাকাকে লণ্ডভণ্ড করার সিদ্ধান্ত, এতে সন্দেহ নেই। ঢাকা দেশের রাজধানী এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই শহর দ্বিখণ্ডিত করলে চারদিকে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, কতভাবে ঢাকার নাগরিক জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হবে এ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। জনগণ নিজেরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন।
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের ষোলআনা সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই রাজনীতির অঙ্কে ফেল করা শেখ হাসিনা ঢাকা দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশে এমনিতেই সমস্যার অভাব নেই, তার ওপর হঠাত্ করে ঢাকা দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত জনগণের জন্য মহা দুর্ভোগের কারণ হবে। এর ফলে ঢাকাবাসীর মধ্যে আওয়ামী লীগের যা কিছু সমর্থন আগে ছিল সেটা শূন্যের কোটায় পৌঁছবে। এর ফলে ঢাকাকে দশ ভাগ করলেও আওয়ামী লীগের নির্বাচন জয়ের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। শেখ হাসিনা নিজে ঢাকা থেকে প্রার্থী হলে তার নিজের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হবে।
এসব দেখে মনে হয়, দেশ এখন এক বদ্ধ উন্মাদের দ্বারাই শাসিত হচ্ছে। কাজেই এখনই শেখ হাসিনার মানসিক চিকিত্সার প্রয়োজন। এই বদ্ধ উন্মাদের হাতে দেশের শাসনভার থাকলে জনগণ যে আরও কত শত দুর্ভোগের কবলে পতিত হবেন, সেটা ভাবলেও যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন লোকের লোম খাড়া হতে বাধ্য। চাকর-বাকর পরিবৃত বাংলাদেশের উন্মাদ প্রধানমন্ত্রীর মানসিক চিকিত্সার দাবি এ কারণে বেশ জোরেশোরেই এখন করা দরকার। তাছাড়া এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতেরও সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কারণ সংবিধানে বলা আছে সুস্থ লোকের দ্বারা দেশ শাসনের কথা। উন্মাদের দ্বারা দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা সর্বাংশে এক সংবিধানবিরোধী অবস্থা। কাজেই যারা সংবিধানের পবিত্রতা নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর করেন, এ ব্যাপারে তাদের করণীয় কর্তব্য আছে। এমনিতেই দেশের অবস্থা খুব খারাপ। তার ওপর উন্মাদের হাতে দেশের শাসনভার চলতে দিলে পরিস্থিতির আরও ভয়ঙ্কর অবনতি ঘটবে।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ০১/১২/১১]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:২৯