এই রচনার শিরোনাম সেলিম আল দীনের লেখা একটি টিভি নাটক থেকে ধার করা। আশির দশকের গোড়ার দিকে বিটিভিতে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাওয়া একটি মিনি সিরিয়াল। যতোদূর মনে পড়ে, এই টিভি পর্দায় হুমায়ূন ফরীদির সর্বপ্রথম খল চরিত্রে অভিনয়, অতি তরুণ বয়সে সে করেছিলো মধ্যবয়সী গ্রাম্য মাতবর সেরাজ তালুকদারের চরিত্রটি। ‘আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’ সংলাপটি তখন মানুষের মুখে মুখে। নাটকের প্রযোজক ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু।
সেলিম আল দীন চলে গেলেন, কোনো ঘোষণা না দিয়ে। ৫৮ বছর কি চলে যাওয়ার বয়স? আমাদের মতো কতো হেঁজিপেঁজি মানুষ পৃথিবীতে দীর্ঘকাল বেঁচে আছি, থাকবো। সময় না হতেই চলে যাবেন সেলিম আল দীনের মতো প্রতিভাবানরা। ঠিক সুবিচার মনে হয় না।
আজ আমার মন ভালো নেই। সকালে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও গেলাম না, ইচ্ছে করলো না। সাতসকালে ঢাকা থেকে ফোন এলো পীযূষ ও ফরীদির। তার আগেই বিডিনিউজ আমাকে খবর দিয়ে দিয়েছে। পেনসিলভানিয়ায় আসাদকে ফোন করি, কানাডায় দিনু বিল্লাহকে, ন্যাশভিলে রেজাকে। কারো সঙ্গেই বেশিক্ষণ কথা বলা সম্ভব হয় না। নিকটজনের প্রয়াণে যেরকম হয়।
না, সেলিম ভাই আমার রক্তসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন না, ছিলেন আত্মার আত্মীয়। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ও খুব গভীরে যায়নি। অথচ আশ্চর্য এক বাঁধনে তিনি বেঁধে ফেলেছিলেন আমাকে এবং আমার মতো আরো অনেককে তাঁর রচনা, প্রতিভা এবং অসামান্য কর্মদক্ষতায়। আমাদের মুগ্ধ ও মোহিত করে রাখলেন অনেকদিন ধরে। এবং অতঃপর প্রস্থান করলেন।
১৯৭৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম কেনা কয়েকটি বইয়ের মধ্যে ছিলো টিএসসি-র বুকস্টোর থেকে কেনা একটি পেপারব্যাক ‘সর্প বিষয়ক গল্প ও অন্যান্য’। রচয়িতা সেলিম আল দীন। তখন তিনি উঠতি নাট্যকার, স্বাধীনতার পরে ঢাকার নতুন ধারার নাটকের প্রধান পুরুষদের একজন। ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ ততোদিনে অভিনীত হয়ে গেছে, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটছে। ঢাকা থিয়েটার গঠিত হলো, সূচনাপর্ব থেকে অন্তিম দিন পর্যন্ত সেখানে জড়িত ছিলেন তিনি।
সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনার যে যুগলবন্দী তৈরি হলো ৭৩-এ, তা বাংলাদেশের নাটককে দিয়েছে অপরিমেয়। সেলিম আল দীনের রচনায় মঞ্চে এলো বাংলাদেশের প্রথম মিউজিক্যাল স্যাটায়ার ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘হাতহদাই’, ‘বনপ্রাংশুল’, ‘চাকা’, ‘সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘নিমজ্জন’। ৭৭-এ বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’। টিভিতে ‘রক্তের আঙুরলতা’, ‘গ্রন্থিকগণ কহে’। এই তালিকা নিতান্তই অসম্পূর্ণ, যা তাঁর রচনার ব্যাপ্তি ধারণ করে না।
সেলিম আল দীনের নাট্যরচনার শুরু ছিলো পাশ্চাত্য ধাঁচে, কিছুটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধরনের। অবিলম্বে তিনি নিজের পথ খুঁজে পেলেন দেশীয় ঐতিহ্য ও লোকজ ধারা এবং প্রাচ্য দর্শনে। তাঁর সব উল্লেখযোগ্য কাজ এই ধারার।
সাহিত্যরচনা তিনি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, বেশিদিন থাকেননি সেখানে। রসিকতা করে বলতেন, আমি তো ব্যর্থ কবি, তাই গদ্যরচনা করি।
তবে তাঁর কিছু নাটকে আশ্চর্য কাব্যময় কিছু পংক্তি আমরা পেয়েছি। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি ‘শকুন্তলা’ নাটকের একটি সংলাপ : আমার প্রার্থনা চৈত্রের শিমুল তুলো – লক্ষ্যহীন কেবলই উড়ে যায়, স্পর্শ করে না!
ঠিক তার বিপরীতে মানুষের প্রতিদিনের মুখের ভাষার একটি নমুনা ‘কিত্তনখোলা’ থেকে : ডালিমনের গায়ের ঘাম, চুকা চুকা গন্ধ।
অনেক বড়ো ক্ষমতাবান লেখক ছাড়া এই বৈপরীত্য ধারণ করা সম্ভব নয়। পড়াশোনায় ছিলেন অক্লান্ত, আগ্রহ ছিলো তাঁর বিচিত্র বিষয়ে। সেলিম আল দীন কীরকম বিশুদ্ধতাপিয়াসী পরিশ্রমী লেখক ছিলেন তার পরিচয় দিতে এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে শকুন্তলা নাটকটি তিনি সতেরো-আঠারোবার লিখেছিলেন। লিখতে বসলে আহার-নিদ্রা ভুলে যেতেন, লিখতেন ঘোরগ্রস্তের মতো। এমন ঘটনাও আছে, একটা লেখা রাত তিনটায় শেষ করে ফরীদিকে ডেকে আনছেন পড়ে শোনাবেন বলে।
কবি রফিক আজাদ আজ পুত্রহারা হলেন। সেলিম আল দীনকে তিনি বলতেন বেটা, সেলিম ভাই তাঁকে বাপ ডাকতেন। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের বন্ধুত্বে আজ ছেদ পড়লো।
সেলিম ভাইকে আমি প্রথম দেখি ৭৪ বা ৭৫-এ টিএসসির দোতলায় ঢাকা থিয়েটারের রিহার্সালে। একদিকে নাটকের মহড়া চলছে, আর তিনি মেঝেতে বসে গভীর মনোযোগে কাগজপত্র ওল্টাচ্ছেন, পাণ্ডুলিপি সংশোধন করছেন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। এরপর মগবাজারে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ঢাকা থিয়েটারের মহড়া হতো, সেখানেও প্রায় একই ভঙ্গিতে তাঁকে দেখতাম। বাচ্চু ভাইয়ের পুরানা পল্টনের বাসায়ও হুবহু এক ভঙ্গিতে তাঁকে দেখেছি। সেলিম ভাইকে ভাবলে মেঝেতে বসা তাঁর এই ছবিটিই আমার মনে আসে।
একটু আগে ঢাকা থেকে আমার আরেক বন্ধু আলমগীর ফোন করে বলে, আজ আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে দোস্ত। সেলিম ভাই আমাদের কী ভালোবাসতেন, সেই মানুষ আজ নেই।
ঢাকায় তখন রাত একটা, বান্ধবহীন আলমগীর একা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে সেলিম ভাইয়ের জন্যে মন খারাপ করে। সেলিম ভাই আমাদের চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের বড়ো ছিলেন। হয়তো তাঁর এই প্রস্থান (নাটকীয় বলতে লোভ হয়, প্রস্থান শব্দটি নাটকে অপরিহার্য শব্দ) আমাদের ক্রমাসন্ন পরিণতির কথা ভাবায়। মনে হয় ভাঙনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর আমাদের কালের নায়করা কেউ কেউ প্রস্থান করেছেন, অনেকে প্রস্থানোদ্যত। মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে আসা রাইসুল ইসলাম আসাদ প্রায় পঙ্গু অবস্থা কাটিয়ে নতুন করে হাঁটা শিখছে, ফরীদি হাঁপানি-নিউমোনিয়ার প্রকোপ সামলে হাসপাতাল থেকে সদ্য ফিরেছে, ফুটবলার নান্নুকে ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে। আমরা সবাই আসছি কিছু আগে বা পরে।
বিদায়, সেলিম ভাই। একজন অনুরাগীর অভিবাদন নিন।
জানুয়ারি ১৪, ২০০৮