কেউ তাকে কিং বলেন, কেউ বলেন বাদশাহ। তিনি শাহরুখ খান। বাংলাদেশে এলেন গত ১০ ডিসেম্বর। নাচলেন। গাইলেন। চলেও গেলেন। কিন্তু তার এই স্বল্প উপস্থিতি কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের এতটুকু উন্নতি করতে পারবে? বাংলাদেশ-ভারত সাংস্কৃতিক চুক্তির বিনিময়ে তিনি ঢাকায় আসেননি। এসেছেন মূলত একটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কতটুকু উপকৃত হলো? কিংবা আমাদের শিল্পীরাই বা এই সঙ্গীতানুষ্ঠান দিয়ে আদৌ লাভবান হয়েছেন কি? কিং খানের অনুষ্ঠানের আগে এ দেশের একজন শিল্পী আসিফ বিবৃতি দিয়ে অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়ার জন্য বাংলাদেশী শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেন তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন, তার কারণও বিবৃত করেছেন একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাত্কার দিয়ে। অনুষ্ঠানে কুমার বিশ্বজিতেরও গান গাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু উদ্যোক্তাদের অসহযোগিতার যুক্তি তুলে তিনিও গান গাওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফলে অনুষ্ঠানটি পরিণত হয় একটি সর্বভারতীয় অনুষ্ঠানে। কিং খানের সঙ্গে নাচলেন, গাইলেন রানী মুখার্জি, অর্জুন রামপাল, শেফালী জরিওয়ালা, ইশা কোপিকার প্রমুখ। কিং খান যখন আর্মি স্টেডিয়ামে নাচছেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ জেনে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএসএফ কর্তৃক আরও একজন বাংলাদেশীর মৃত্যুর খবর। চলতি বছর এ যাবত্ বিএসএফের গুলিতে মারা গেছেন ৯২০ বাংলাদেশী। অথচ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (সাবেক বিডিআর) গুলিতে একজন ভারতীয় মারা গেছেন, এরকম একটি দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই শাহরুখ খান যখন ঢাকায় কনসার্ট করেন, তখন সঙ্গতকারণেই আমি বুঝতে চেষ্টা করি, এ ধরনের কনসার্ট কি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে? আমার তা মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, শাহরুখ খানের কনসার্টের নামে আমরা কী দেখলাম? অর্ধনগ্ন নারীরা স্টেজে নাচলেন। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল সরাসরি তা প্রচার করল। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে কি এই অর্ধনগ্ন নারীদের নৃত্য অনুমোদন করে? প্রকাশ্যে এই অর্ধনগ্ন নারীদের নৃত্য দেখার জন্য নাকি বেশ ক’জন সচিব ভিড় জমিয়েছিলেন। এমনকি আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শাহরুখ খানকে দেখার তার আগ্রহ এত বেশি ছিল যে ‘সিট’ না পেয়ে একপর্যায়ে মাটিতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে কথা! পুলিশের অফিসাররা চেয়ারে বসবেন। আর প্রতিমন্ত্রী বসবেন মাটিতে, তাই কী হয়! শেষ পর্যন্ত চেয়ারের ব্যবস্থা হলো। মন্ত্রী অর্ধনগ্ন নারীদের কোমর দোলানো নৃত্য দেখে তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি গেলেন; কিন্তু আমরা কী পেলাম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য এসে কত টাকা নিয়ে গেলেন শাহরুখ খান?
একটি পত্রিকা আমাদের জানিয়েছে, শাহরুখ খানের কনসার্টের নামে একশত কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। আমি এনবিআরের লোক নই। এনবিআর কিছুটা হলেও তত্পর হয়েছিল। তাতে কিছু ফলও পাওয়া গেছে। অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, শাহরুখ খানকে দেয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ২০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। আয়োজন করতে তার ব্যয় হয়েছে ২ কোটি টাকা (?), ২৫ লাখ টাকা অগ্রিম আয়করও নাকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বপন চৌধুরী আমাদের জানাননি, রানী মুখার্জিসহ বাকি যারা নাচলেন, তাদের কত টাকা দেয়া হয়েছে। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা এটা নিয়ে ‘গবেষণা’ করতে পারতেন। করেননি। বোধ করি তারাও ‘সৌজন্য টিকিট’ পেয়ে থাকবেন। কিন্তু একটি তথ্য আমি পেয়েছি শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনটি ঢাকা থেকে পাঠিয়েছেন মেহনাজ খান। পাঠক, গত ১১ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত Delhi's Cultural Expansionism শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে দেখতে পারেন। ইন্টারনেটে ক্লিক করলেই প্রতিবেদনটি পাবেন। সেখানে বলা হয়েছে, শাহরুখ খানকে দেয়া হয়েছে ২ লাখ ডলার, অর্থাত্ ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। রানী মুখার্জি নিয়েছেন ৫০ হাজার ডলার আর ইশা কোপিকার ২৫ হাজার, অর্জুন রামপাল ১৫ হাজার। আর নাচনেওয়ালি শেফালী জরিওয়ালা? ন্যূনতম ১০ হাজার ডলার। বাকি যারা নেচেছেন তাদেরও দিতে হয়েছে। অন্তর শোবিজ এই অনুষ্ঠান করে আয় করেছে ১৭ লাখ ডলার (টিকিট বিক্রি ও স্পন্সর)। আরও একটি মজার তথ্য আমাদের দিয়েছেন মেহনাজ খান।
অন্তর শোবিজের স্বপন চৌধুরী রানী মুখার্জি ও যৌন আবেদনময়ী ইশা কোপিকারের ‘প্রাইভেট টাইম’ও বিক্রি করেছেন। বাংলা ভাষায় বললে যা বোঝায় তা হচ্ছে রানী ও ইশা কোপিকারের সঙ্গে ‘সময় কাটানো’। প্রতি ৩০ মিনিটের জন্য দিতে হয়েছে ২০ হাজার ডলার। ইশা কোপিকার নিয়েছেন ১০ হাজার ডলার। ঢাকার উঠতি ধনী ২৭ ব্যক্তি টাকা দিয়ে রানী ও ইশার সঙ্গে ‘সময় কাটিয়েছেন।’ কোনো মহিলা নিশ্চয়ই ওই ২৭ জনের মধ্যে ছিল না। তাহলে হিসাব করে দেখুন তো, কত টাকা পকেটে ভরে বোম্বে চলে গেলেন রানী মুখার্জিরা। এখানে আরও একটা প্রশ্ন। এত বিপুল অর্থ বাংলাদেশ থেকে চলে গেল, তার জন্য কী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয়া হয়েছিল? বাংলাদেশ ব্যাংক যদি অনুমতি না দিয়ে থাকে, তাহলে স্বপন চৌধুরী কিসের ভিত্তিতে শাহরুখ, রানী ও ইশা কোপিকারকে টাকাটা দিলেন? এটা তো তাহলে অবৈধ। আমার অনুরোধ থাকবে এনবিআরের কর্মকর্তাদের প্রতি, আপনারা বিষয়টি খতিয়ে দেখুন। আমাদের বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমসের কর্মকর্তারাই বা কী করলেন? এত অর্থ চলে গেল অবৈধভাবে। তাদের কি করার কিছুই ছিল না? মাঝেমধ্যে তো কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা আটকে দিয়ে আপনারা সংবাদপত্রের খবর হন। প্রশংসা পান। তাহলে রানীদের ক্ষেত্রে কী হলো? তাদের ব্যাগ কি তল্লাশি হয়েছিল? না হয়ে থাকলে যিনি বিমানবন্দরের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি কি তার দায়িত্বে অবহেলা করলেন না? ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হয়েছিল, শাহরুখ খান সুন্দরবনের জন্য ভোট দেবেন। কই, তিনি তো দিলেন না। এই ব্যর্থতার জন্য এখন কি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদত্যাগ করবেন? এ ব্যর্থতা তো তার। শুধু সুন্দরবন কেন? শাহরুখ খান এই ডিসেম্বরে এলেন। এই ডিসেম্বর মাস আমাদের জন্য বিজয়ের মাস। এত মানুষ বাংলাদেশের জন্য মারা গেল। শাহরুখ তাদের জন্য কিছু কথা বললেন না। গর্ব করার মতো বাংলাদেশের অনেক কিছু আছে। তার মুখ থেকে একটি বারও সেই নামগুলো উচ্চারিত হলো না। দুই ভাই দুটি ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন শাহরুখ খানের। কথা ছিল তা নিলামে তোলা হবে। এসব কথা বলে বাহবা নিয়েছিলেন স্বপন চৌধুরী। কিন্তু নিলামে তোলা তো দূরের কথা, ওই দুই ভাইকে শাহরুখ খানের কাছে নিয়ে যাওয়াই হয়নি।
না, আমি ব্যক্তি শাহরুখ খানের বিরুদ্ধে নই। বরং অনেকের মতো আমিও তার ফ্যান। সময় পেলে আমিও তার ছবি দেখি। ভালো অভিনয় করেন তিনি। কিন্তু তাকে নিয়ে এটা কী হলো বাংলাদেশে? ভারতীয় নর্তকিদের নগ্ন নৃত্য প্রদর্শনীর জন্য নিশ্চয়ই আমরা উদ্যোক্তাদের অনুমতি দিইনি। এসব নগ্ন নৃত্য তো আমাদের সংস্কৃতির কথা বলে না? আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে এ রকমটি যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটা নীতিমালা করা দরকার। বাণিজ্যিকভাবে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। কোনো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাহায্যের জন্য যদি করা হয়, তাহলে অনুমতি দেয়া যেতে পারে। ভারতীয় শিল্পীরা বাংলাদেশে এসে গান গেয়ে যদি শিশুদের জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করে দিয়ে যেতে পারেন, যদি নির্যাতিত নারীদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে দিয়ে যেতে পারেন, আমি তাকে স্বাগত জানাব। কিন্তু গান গেয়ে আর অর্ধনগ্ন হয়ে নৃত্য প্রদর্শন করে সুড়সুড়ি দিয়ে অর্থ নিয়ে যাবে, আমি তার বিপক্ষে। এ ধরনের গান শোনার আমাদের প্রয়োজন নেই। কই আমাদের রুনা লায়লা, বেবী নাজনীন কিংবা সাবিনা ইয়াসমিনকে কি ভারতীয়রা কখনও কনসার্টের জন্য ডাকে? আমাদের জেমস তো ভালোই গান। ক’বার তিনি ভারতে গেছেন? আমাদের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা তো হরহামেশাই বিদেশে যান কনসার্ট করতে। ক’বার তারা ভারতে গেছেন? আসলে ভারতীয়রা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত যে অনেক কিছু দিয়েছে বা আগামীতে আরও দিতে পারবে, এটা স্বীকার করার ন্যূনতম সৌজন্যবোধ নেই ভারতীয়দের।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভারতীয় শিল্পীদের ঢাকায় এসে অনুষ্ঠান করার নামে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এনবিআরকে এসব ক্ষেত্রে রাখা হচ্ছে অন্ধকারে। অতীতে এভাবে অনেক ভারতীয় শিল্পী ঢাকায় এসেছেন। অনুষ্ঠান করেছেন। সম্মানী নিয়েছেন। সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না এবং আদৌ ভ্যাটও দেয়া হয়নি। শাহরুখ খানের কনসার্ট আমাদের চোখ খুলে দিল। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কোনো দেশ, পাত্র, বিবেচ্য নয়। আমরাও তাই মনে করি। নির্মল আনন্দের জন্যই সঙ্গীত। কিন্তু সঙ্গীতের নামে বেহায়াপনা কেন, কনসার্টের নামে অর্ধনগ্ন নৃত্য কেন? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এভাবে কোনো বাঙালির অর্ধনগ্ন নৃত্যানুষ্ঠানের অনুমতি দেবে? গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালায় এ ধরনের নৃত্যানুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার খবর একাধিকবার পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। তাহলে ঢাকায় শেফালী জরিওয়ালার অর্ধনগ্ন নৃত্যানুষ্ঠানের অনুমতি কারা দিল? কেন দিল? ভ্যাট ফাঁকি দেয়া ও অবৈধ অর্থ পাচারের যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নষ্ট হয়। শাহরুখ খানের ক্ষেত্রেও হয়েছে। সুতরাং আমরা চাই, এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে।