১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই ৪ এপ্রিল এদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী (১৯৭১ সালের ২ আগস্ট দি ইস্ট পাকিস্তান রাজাকারস অর্ডিন্যান্স, ৭১ এর মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং ৭ আগস্ট ১৯৭১-এ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে সরাসরি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধীনে আনা হয় অক্সিলিয়ারি ফোর্স হিসেবে) রাজাকার বাহিনীর মুখ্য নির্দেশদানকারী গোলাম আযম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হোতা সামরিক শাসক এবং তৎকালীন গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে তাকে ‘পূর্ণ সহযোগিতার’ আশ্বাস দেন (দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ এপ্রিল, ১৯৭১)। ২৫ মার্চের সেই মর্মš'দ গণহত্যাকাণ্ডের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে, সশরীরে এবং বিভিন্নভাবে নির্দেশ দিয়ে গোলাম আযম তার অপরাপর দোসর মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ গংদের নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে তার সেই “পূর্ণ সহযোগিতা” চালিয়ে গেছেন। ১১ এপ্রিল ১৯৭১ এ দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য ছিলÑ “এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ‘তথাকথিত স্বাধীন বাংলা’ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে চিরতরে গোলামে পরিণত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়”। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগীদের মনোভাব ২৫ মার্চের নৃশংস গণহত্যার ১৫ দিন পরেই তাদের নেতা গোলাম আযম এবং নিজামীর মুখ থেকে এভাবেই নিঃসৃত হয়েছিল।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তার পক্ষে এই নৃশংস গণহত্যা এবং নারী নির্যাতন সম্ভব হয়েছিলো জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামীর মতো দলের সক্রিয় সহযোগিতার কারণে। জামাতে ইসলামী শুধু পাকিস্তানি হানাদারদের সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নিজেরাও হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের জন্য রাজাকার, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠন করেছিল। ’৭১ এ ঘাতক আল বদর বাহিনীর (যে বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন জামাতের বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী) প্রধান দায়িত্ব ছিল তালিকা প্র¯'ত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করা।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির সা¤প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী “পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার, আল বদর, আল শামস এবং তাদের অন্যান্য সহযোগীরা ১৯৭১ সালে দেশে যে ব্যাপক গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালায় তাতে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়!’’ এর বাইরের হিসাব হয়তো আগামীতে আমরা পাবো! “এ পর্যন্ত গণকবর এবং গণহত্যার নিদর্শন সংবলিত জায়গাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে প্রায় ৯২০টি। ৮৮টি নদী ৬৫ টি ব্রিজের ওপর সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৪ লাখ ৬০ হাজার নির্যাতিত নারীর পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।” হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনে পাকিস্তানি দখলদারদের সহযোগীরা সারাদেশে শুধুমাত্র সহযোগী হিসেবেই ছিল তা নয় এই নৃশংস গণহত্যার প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর চাইতেও নৃশংস ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে (ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, কম্পটনস এনসাইক্লোপিডিয়াতেও গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ত্রিশ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে প্রথম ৬ মাসে (মার্চ-আগস্ট, ১৯৭১) তারা (পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা) হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ করে কেবলমাত্র ৬৯.৭১ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। (সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, পৃষ্ঠা ৪৪৬, ভারত সরকারের বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




