(৪)
নামিরার সাথে আমার ওয়াদা করতে হয়েছিলো যে , ওকে নিয়ে একটা দিন রিকশায় ঘুরতে হবে । মেয়েটার এহেন পাগলামী পূর্ণ কথাবার্তা আমার কাছে হাস্যকর লেগেছিলো । তবে সে কষ্ট পেতে পারে, এই ভেবে কিছু বলি নি । সারা দিন রিকশা নিয়ে ঘুরতে অনেক সমস্যা । কারন আমার ফুফা যদি জানতে পারেন , তাহলে বাসায় আর থাকা লাগবে না । এদিকে নামিরাকেও মানা করতে পারছি না । শেষ পর্যন্ত একটা তারিখ ঠিক করলাম ।
আমার প্রতিদিনের কর্মসূচির ছকে বাঁধা জীবন থেকে দু ঘন্টা বের করে নিতে কষ্ট হলো । একটা শুক্রবারকে বেছে নিলাম । এদিন বিকালে ফুফুদের একটা দাওয়া আছে । ঠিক করলাম এ সুযোগে নামিরার সাথে ঘুরতে বের হবো ।
শুক্রবার দেখতে দেখতেই চলে এলো , জীবনে প্রথমবারের মত কোন মেয়ের পাশে রিকশায় বসলাম । আর রিকশা এমন একটা বাহন যেখানে দুজন মানুষ পাশাপাশি বসলে, তাদের মাঝখানে ভদ্রতাসূচক দূরত্বটাও উধাও হয়ে যায় । আমি ভীষন বিব্রত বোধ করছিলাম । এদিকে নামিরার কোন বিকার নেই । সে স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে । আর তার মুখ দিয়ে মেশিনগানের ব্রাশফায়ারের মতো করে ফর্ ফর্ করে কথা বেরুচ্ছে ।
নামিরা আজকে খুব বেশি সাজেনি । তার পরনে হালকা নীল রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ । আর কপালে ছোট শিশির বিন্দুর মতো একটা টিপ । খুবই সাধারন সাজ । তবে এতোদিন পর , মানে প্রায় দেড় থেকে দু মাস পর নামিরাকে আজকেই প্রথম মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলাম । মেয়েটার মধ্যে একটা সরলতা আছে, আছে একটা সুন্দর মন। মুখটা ভীষন মায়াময় । তার উপরে চোখে কাজল দিয়েছে সে । এই কাজল জিনিসটা মেয়েদের রূপকে নাকি দ্বিগুন করে দেয় । আগে শুনেছিলাম, আর আজকে দেখেও নিলাম । মেয়েটা হঠাৎ হঠৎ হেসে উঠছে আর তার গালে টোল পরছে ।
আমাকে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে নামিরা জিজ্ঞেস করলো "কি হলো । কি দেখছো ?"
লজ্জ্বা পেলাম । খুব লজ্জ্বা পেলাম । উত্তর দিতে পারলাম না । নামিয়ে কি বুঝলো কে জানে , সে মুচকি হাসলো । তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ডান হাতটা আলতো করে ধরলো । আমি রীতিমত ইলেক্ট্রিক শক খেলাম । নামিরা মৃদু কন্ঠে বলল "তুমি এতো ভয় পাও কেন ? ছেলে মানুষের এতো ভয় থাকলে চলে ?"
কি বলবো আমি ? বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ কোন মানুষ কি কিছু বলার পর্যায়ে থাকে ? আমি শুধু নার্ভাস ভঙ্গিতে ঢোক গিললাম । দুইটা ঘন্টা যেন রকেটের বেগে কেটে গেলো ।
তবে ঐ দুই ঘন্টাই যে আমার জীবনে কিছু নতুন পরিস্থিতি আর অনুভূতির জন্ম দিবে তা আমি ভাবতে পারি নি । নামিরা নামের মেয়েটা আমার মনের শুষ্ক রুক্ষ জমিতে হঠাৎ করেই স্নিগ্ধ বর্ষার রুপ নিয়ে হাজির হলো । সিক্ত করলো আমাকে আর তার জন্য আমার মনে ভিতরে একটা জায়গা করে নিলো । কিন্তু আমি ভয় পেতাম । অনেক ভয় । নামিরা কোথায় ! আর আমি কোথায় ! অসম কিছু পার্থক্য রয়ে যায় সর্ম্পকটার মাঝে । রাতে বসে বসে নামিরার সাথে আমার সর্ম্পকের জটিল সূত্রগুলো মিলাতে চেষ্টা করতাম । কিন্তু ফলাফল বার বারই শূন্য আসতো. .
এদিকে ঢাকা ভার্সিটির পরিক্ষা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে । আর হাতে আছে মাত্র ৪ দিন । হাজারটা সমস্যা মাথায় নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে আমাকে । মা ফোন করেছিলেন । বাবার অসুস্থতাটা প্রকট আকার ধারন করেছে । এদিকে পকেটে টাকাও নেই । মা বহুকষ্টে এ মাসে হাজার তিনেক টাকা পাঠিয়েছেন । এখন আছে মাত্র তিনশো । যেটা বাস ভাড়া হিসেবে লাগবে । ইদানিং ফুফা একটু বেশিই গালিগালাজ করছেন । অকথ্য কিছু ভাষা ব্যাবহার করছেন ।
জীবন এখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে । তার উপর নামিরার ব্যাপারটা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হচ্ছে । মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছি নিজের অজান্তেই । এটাই অনেক বড় ভুল । অনেক বড় একটা সমস্যা দাঁড় করিয়ে দিয়েছি । যেখানে বাস্তবতার অন্তরালে ঢাকা পরে সব আবেগ, যেখানে জীবন মানে পাথর কুঁদে তৈরি করা পথ, সেখানে ভালবাসা নিয়ে চিন্তা করা নিতান্তই বিলাসীতা । অথবা শৈল্পিক মনের ভাবনা ।
ফুফুর বাসায় থেকে হাজারটা সমস্যার মাঝে যেখানে লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতেই নাভিঃশ্বাস উঠে, সেখানে প্রেম নিয়ে চিন্তা করার কোন অবকাশ থাকে না । তাই আমি নামিরাকে নিয়ে আর চিন্তা না করার চিন্তা করলাম । আমার মস্তিস্কের কমান্ড সেক্টর থেকে মনের কাছে নিদের্শ আসলো "মিঃ মাইন্ড , এবোর্ড মিশন" ।
কিন্তু মন কি আর সামরিক বাহিনীর নিয়মে চলে ? সে ঠিকই তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো । আবেগ আর বাস্তবতার যুদ্ধের মাঝখানে পরে রীতিমত দিশেহারা বোধ করলাম ।
(৫)
এদিকে ঢাকা ভার্সিটির পরিক্ষার আর মাত্র ২ দিন বাকি । হটাত্ই নামিরা ফোন করলো । সে আমাকে গুলশান লেকের কাছে আসতে বলল তাড়াতাড়ি । নামিরাকে বেশ অস্থির মনে হলো । ভয় পেয়ে গেলাম । যত দ্রুত সম্ভব গুলশান লেকের কাছাকাছি পৌঁছালাম । তারপর যা হলো তা কল্পনাতীত । নামিরা আমাকে প্রপোজ করে বসলো । মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি । তার চোখ দুটোতে ভয়, শংঙ্কা, উত্কন্ঠা আর অশ্রুর মিশ্রন দেখতে পেয়েছিলাম ।
তাকে তখন যে কি বলবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না । তাকে তাই বললাম , আমার সিদ্ধান্ত আমি পরীক্ষার পর জানাবো । বলেই আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে চলে এলাম । ফুফুর বাসায় ফিরে এলাম । ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলাম অনেক্ষন । রাত ১২টার দিকে নামিরার মেসেজ আসলো । সেখানে লেখা ছিলো "আমি অপেক্ষায় থাকবো ।" . . মেয়েটার পাগলামী দেখে মনে হলো তাত্ক্ষনাৎ হ্যা বলে দিই । বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম ।
পরীক্ষার দিন এসে গেলো দেখতে দেখতে । পরীক্ষা দিতে বাসা থেকে বের হলাম । আকাশটা বেশ কালো । বৃষ্টি হবে বোধ হয় । অক্টোবর মাসে বৃষ্টি হওয়াটা অদ্ভুতই বটে । যাই হোক পরীক্ষাটা বেশ ভালই হলো । আমার সব পরিশ্রম সার্থক মনে হলো । অনেক দিন পর নিজকে টেনশন ফ্রি লাগছে । ঠিক তখনই বাসা থেকে ফোন আসলো । মা ফোন করে জানালেন , বাবা আর নেই । কাকতালীয় ভাবেই হোক আর প্রাকৃতিক ভাবেই হোক আকাশ প্রচন্ড শব্দে গর্জে উঠলো । বৃষ্টি নামলো ঝুপ করে ।
থমকে গেলো কর্মব্যাস্ত ঢাকা , থমকে গেল পথচারী , থমকে গেল আবহাওয়া আর সেই সাথে থমকে গেলাম আমি ।
(৬)
ওয়েটিং রুম এ বসে আছি । কাঁধে ব্যাগ, হাতে সেই ট্রাভেলার্স ব্যাগ । মানিব্যাগটা আজকে প্যান্টের পকেটেই আছে । সেটা হারানোর ভয় আজকে নেই । শেষ সম্বল তিনশো টাকা দিয়ে বাসের টিকেট জোগাড় করেছি । মোবাইলে ব্যালেন্স আছে মাত্র ৫ টাকা ।
মোবাইলে একটা মেসেজ টাইপ করছিলাম এতোক্ষন । মেসেজটা আরেকবার পড়লাম. . .
"নামিরা ।
কখনো কখনো একজন মানুষের অনুভূতিগুলো আর একজন মানুষের অনুভূতিগুলোর সাথে মিলে যায় । তাদের ধ্যান ধারনা , চিন্তা ভাবনা , সব প্রায় একই রকম হয় । কিন্তু তাদের পথ এক হয় না । বিপ্রতীপ কোণের নাম শুনেছো নিশ্চয়ই । যেই কোণের মাপ , আকার , আকৃতি সবই এক । শুধু তারা পরস্পরের বিপরীত ।
ঠিক তোমার আমার অবস্থানটাও বিপ্রতীপ কোণের মত । যাদের সব অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং আশা পরস্পর বিপরীতেই থেকে যায় ।
ভালো থেকো"
মেসেজের send অপশনে গিয়ে নামিরার নামটা খুঁজে বের করলাম । নামটার দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকলাম । মমতা আর ভালবাসায় ভরা কিছু স্মৃতি মনে পরলো । দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক থেকে । send করে দিলাম মেসেজটা । Delevary report আসার পর সেট থেকে সিমটা খুলে নিলাম । তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলের চাপ প্রয়োগ করে ভেঙে ফেললাম সেটাকে ।
উঠে দাড়ালাম । বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে । বাসে উঠার জন্য মানুষের হুড়োহুড়ি নেই আজকে । বেশ শান্তভাবেই উঠতে পারলাম । একটু পর বাস চলতে আরম্ভ করলো ।
পিছনে রয়ে গেলো কর্মব্যাস্ত ঢাকা, বৃষ্টিভেজা আর রোদে পোড়া রাজপথ, কর্মমুখর মানুষ আর কিছু বিপ্রতীপ অনুভূতি ।
লেখকের কথা :-
গল্পটাতে অনেক কিছুই অসম্পূর্ন লাগতে পারে । যেমন প্রশ্ন উঠতে পারে যে ছেলেটা তারপর কি করলো ? সে কি ভার্সিটিতে টিকেছে ? সে কি নামিরার সাথে আর যোগাযোগ করেছে ?
ছেলেটার শেষ সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে, একজন নিন্মমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সে । তার পরিবারের দায়িত্ব এখন তার উপর বর্তায় । যার ফলে তার ফিরে আসাটা হয়তো সম্ভব নয় । অন্যদিকে ফুফার দুর্ব্যাবহারের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলাম ছেলেটার প্রতিদিনের দুর্ভোগের কথা । অনেক দিন পর গল্প লিখলাম । অনেক কিছুই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে এতোদিনে । যাই হোক ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি ।
ধন্যবাদ ।
-: উত্সর্গ :-
উত্সর্গ করলাম প্রিয় দাদাভাই জয়দা , প্রিয় শিহাব ভাই , রিক ভাই , নূহাপু , নিম্মিপু , প্রখ্যাত রাগ বিশেষজ্ঞ মেঘলা তাসনিম আপা , অনেক অনেক অনেক প্রিয় তৃপ্তিপু , প্রিয় নিশম ভাই , গুল্লুমুল্লু রিয়াপু , জানু আপু মেঘলা ফারজানা , প্রিয় ডাক্তারনি ও বিশিষ্ট থ্রেট স্পেশালিস্ট রিমু আপা আর অবশ্যই শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় কবি নিরব ভাইকে ।
এই মানুষগুলো সব সময় আমাকে আগলে রেখেছেন । অনেকটা ঝড়ের মধ্যে বিপদে পরা পাখির ছানাকে যেভাবে মানুষ দু হাতের মাঝখানে আঁকড়ে ধরে রাখে , ঠিক সেভাবে । একটা সময় আমার দুঃখের অন্ত ছিলো না যে আমার কোন শ্রদ্ধেয় বড় ভাই নেই অথবা মিষ্টি প্রিয় বড় বোন নেই । আজকে সেই আফসোস মাঠে মারা গেছে ।
এই মানুষগুলো প্রত্যেকটা সময় , প্রত্যেকটা সুখ দুঃখের অনুভূতির সাথী ছিলেন আমার । ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না । তাদেরকে অনেক অনেক বেশি ভালবাসি । শুধু চাইবো তাদের সাথে আমার সর্ম্পকটা যেন সন্নিহিত কোণের মতো থাকে । যেখানে আমি একটা কোণ আর তারা আরেকটা কোণ । এবং যাদের উত্পত্তি একটা নিদিষ্ট বিন্দু থেকে । অর্থাৎ যে যেখানেই থাকি না কেন , আমাদের উত্স যেন একটাই থাকে । মাঝে মাঝে যখন অতীত স্মৃতি ঘাটতে ইচ্ছা হবে তখন যেন খেই হারিয়ে ফেলতে না হয় ।