পাপ্পু দুর থেকেই ওদের দেখল। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। রনি হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে। সবাই হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। পাপ্পু ধীর পায়ে ওদের সামনে গিয়ে দাড়াল।
তাকে দেখে রনি উৎফুল্ল গলায় বলল, আমাদের ‘এ প্লাস’ চলে এসেছে। এত দেরি! ভর্তির জন্য পড়তে বসে গেছিস?
সে বড় করে হাই তুলল। তারপর বলল, সারাদিন পরে পরে ঘুমালাম। ভাবছি-আগামী একমাসে বই ছুব না।
রাজু বলল, তোকে বই ছুতে হবে না। বই-ই তোর কাছে হেঁটে হেঁটে চলে আসবে।
সবাই হেসে উঠল। সেও হাসল। গতকাল তাদের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা শেষ করে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। মনে হয়েছে ইন্টারের সমস্ত বইয়ের গাট্টি মাথা থেকে নেমে গেছে। ওদেরও হয়তো একই অবস্থা। তাই সামান্য কথাতে হেসে উঠছে। মন আনন্দে থাকলে খোঁচা দেয়া কথাও গায়ে লাগে না। পাপ্পুরও লাগল না।
সে বলল, বই আসবে তবে পাঠ্য বই না। গল্পের বই।
রনি তাচ্ছিলের ভঙ্গিতে বলল, আমি বইয়ের ধারে কাছে নাই। আমি এনিমেশন শিখব।
রাজু বলল, এনিমেশন শিখে কি করবি?
কার্টুন ছবি বানাব।
তুই তো নিজেই একটা জীবন্ত কার্টুন। তুই আবার কার্টুন বানাবি?
রনি রাগী গলায় বলল, তুই কি করবি?
আমি ভ্রমনে বের হব। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন আর কুয়াকাটায় । সমূদ্রের পাড়ে পাড়ে ঘুরব।
একা একা ঘুরবি! সানি লিওনকে নিবি না!
সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।
ইমন বলল, চল আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসি।
কোথায় যাওয়া যায়?
ঠিক হল-সবাই মিলে ফ্যান্টাসি কিংডমে যাবে এবং আগামীকালই। চাঁদা এক হাজার।
রাজু বলল, যাব কিভাবে?
রনি বলল, যাওয়া নিয়ে চিন্তা করিস না। আব্বুর অফিসের গাড়ি আছে। নিয়ে আসব। সাথে ড্রাইভার।
সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল- ইয়াহু।
আড্ডা ভাঙ্গার আগে রাজু পাপ্পুর দিকে তাকিয়ে বলল, পাপ্পু সময়মতো চলে আসিস। গতবার কিন্তু পিকনিকে যাসনি। পরীক্ষার প্রিপারেশন শেষ হয়নি-হেনতেন কত কথা...
পাপ্পু একটু হেসে বলল, এবার মিস হবে না। এখন তো পরীক্ষা নেই।
পাপ্পু ঘরে চলে এলো। এতদিন পরীক্ষার পড়া নিয়ে সংগ্রাম করেছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে সংগ্রাম করার কিছু নেই। সে মার রুমে ঢুকল। মা মাগরিবের নামাজ শেষ করে উঠলেন।
পাপ্পু বলল, মা এক হাজার টাকা দিতে পারবে?
এত টাকা দিয়ে কি করবি?
ফ্যান্টাসি কিংডমে যাব।
মা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন।
একা?
না। আমরা পাঁচজন যাচ্ছি।
মা বিরক্তমুখে বললেন, ওখানে যাওয়া কি দরকার? কি আছে? শুধু শুধু টাকা খরচ!
সুন্দর সুন্দর রাইড আছে। রাইডে চলব।
পরে যেও।
পরে আবার কখন? কিছুদিন পরই তো ভর্তি পরীক্ষা। তখন কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে না?।
মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। হয়তো যুক্তি বোঝার চেষ্টা করছেন। তারপর বিছানার নিচ থেকে চকচকে একটা একহাজার টাকার নোট বের করে দিলেন। বললেন, এরপর আর কোথাও ঘুরতে যেতে চেও না।
পাপ্পু মাথা কাত করে সায় দিল।
পরদিন পাপ্পু তিনটার আগেই বের হল। আবাহনী মাঠের কাছাকাছি আসতেই সে থমকে দাড়াল। মধ্যবয়স্ক একজন লোক টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। লোকটির পরনে পরিস্কার জামা কাপড় কিন্তু চোখ-মুখে দিশেহারা ভাব। সারা মুখ ঘামে ভেজা।। আচমকা তার হাত ধরে বলল, বাবা আমি খুব বিপদে পড়েছি!
বলতে বলতেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। পাপ্পু হকচকিয়ে গেল। একি?
সে লোকটির মাথার কাছে গিয়ে বসল। তার মুখের দু’পাশে ফেনা জমছে। সে বুঝতে পারছেনা কি করবে? চোখে-মুখে পানির ছিটে দিতে পারলে ভালো হত। সে অস্থিরভাবে এদিক সেদিক তাকাল। দেখতে দেখতে ভীড় জমে গেল। ধরাধরি করে লোকটিকে ফুটপাতের একটি চায়ের দোকানে নিয়ে আসা হল। লম্বা একটি টুলে শোয়ানো হল। কয়েকবার পানির ঝাপটা দিতেই সে চোখ মেলে তাকাল। সবাই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লোকটিকে দেখছে। সে উঠে বসল। ভদ্রগোছের সরল ধরনের চেহারা।
ভীড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, চাচা হঠাৎ পড়ে গেলেন? মৃগী বেরাম আছে?
লোকটি মাথা নাড়ল। সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল, আহ!
কি হয়েছে খুলে বলেন?
লোকটি যা বলল তার সারমর্ম হল- সে বিক্রমপুরের একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। তার ছোট মেয়ের চোখের সমস্যা। ঢাকায় এনে তাকে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করায়। মা ও মেয়েকে হাসপাতালে রেখে সে আজ ধানমন্ডিতে আসে। তার পুরনো এক ছাত্রকে খুঁজতে। সে ডাক্তার হয়েছে। আবাহনী মাঠের কাছে আসতেই ছিনতাইকারীরা তাকে ধরে। সবকিছু ছিনিয়ে নেয়।
লোকটির কথা শেষ হলে উৎসুক জনতা তাকে একের পর এক প্রশ্ন শুরু করে।
ছিনতাইকারী ক’জন ছিল? কি নিয়ে এসেছিল-গাড়ি, না হোন্ডা? হাতে কি ছিল-পিস্তল না চাকু? কখন ঘটনা ঘটেছে? কত টাকা নিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভীড়ের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলল, চাচা আপনে চিক্কুর দিলেন না ক্যা? আমরা তো এইখানেই বসা ছিলাম।
লোকটি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, উপায় ছিল না ভাই। হোন্ডায় তিনজন বসা ছিল। একজন নেমে মধুর ভঙ্গিতে বলল,
আঙ্কেল আপনার বাসা মোহপম্মদপুর না?
আমি বললাম, না।
ছেলেটি বলল, ও সরি ভুল হয়ে গেছে।
সে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি হাত না মিলিয়েই বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে।
ছেলেটি থমথমে মুখে বলল, আঙ্কেল, হাত বাড়ালাম। পছন্দ হল না?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাত বাড়ালাম। ছেলেটি হ্যান্ডসেক করার ছলে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। হঠাৎ তার গলার স্বর, ভাষা বদলে গেল। তুই তুকারি শুরু করল।
দাঁতে দাঁত চিপে বলল, তোরে যদি মাইরা এই ড্রেনে ফালাইয়া রাখি, কেউ তোরে বাঁচাতে আইবো?
আমি ঘামতে শুরু করলাম। হোন্ডা থেকে বাকি ছেলেগুলো নেমে আমাকে এমনভাবে ঘিরে দাড়িয়েছে যেন তারা আমার বহুদিনের পরিচিত। পাশ দিয়ে প্রাইভেট কার যাচ্ছে। কে কার দিকে তাকায়?
ছেলেটা বলল, আমরা হিরোইন এডিক্টটেড। পকেটে যা আছে ভালোয় ভালোয় দিয়া দে...
লোকটা থামল। সে বড় বড় নিঃশ্বাস নিঃশ্বাস নিচ্ছে। যন্ত্রনায় তার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। দোকানদার তাকে একগ্লাস ফিল্টার পানি এগিয়ে দিল। সে এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু খেল। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, আমার সব শেষ হয়ে গেল! এতদিনের জমানো টাকা!
একে একে ভীড় পাতলা হয়ে গেল। তাদের কাহিনী শোনার আগ্রহ শেষ হয়েছে। আর কিছুতেই আগ্রহ নেই। যাবার আগে কেউ কেউ পরামর্শ দিল- ‘থানায় গিয়ে একটা জিডি করেন’।
পাপ্পু হুট করে চলে যেতে পারল না। কোথায় যেন বাঁধো বাঁধো লাগছে। লোকটা যন্ত্রনাকাতর মুখে বসে আছে। তাকে বেশ অসহায় লাগছে। একবার আপন মনেই যেন বলল,
ঢাকায় এসে একি বিপদে পড়লাম! মেয়েটার এখন কি হবে?
পাপ্পুর ভেতরটা হঠাৎ কেমন যেন করে উঠল। সে কোন কিছু না ভেবে মানিব্যাগ বের করল। এক হাজার টাকার নোটটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিল। সে টাকার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে নিল না। পাপ্পু তার পকেটে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বলল,
আঙ্কেল এটা রাখেন। এখন আপনার কাজে লাগবে।
বলেই সে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করল। একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল, লোকটি কাঁদছে আর শাটের হাতা দিয়ে চোখ মুছছে।
বাসায় এসে সে সোজা ছাদে উঠে গেল। খোলা আকাশের নিচে অনেকক্ষন দাড়িয়ে রইল। এক অজানা আনন্দে তার মনটা ভরে আছে।
সূর্য ডুবছে। অস্তগামী সূর্যের শান্তভাব আর তার মনের প্রশান্তভাব মিলে তার মধ্যে অদ্ভুত এক ফ্যান্টাসি তৈরী করল।
মোবাইলে কল এলো- কিরে তুই কোথায়?
পাপ্পু নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, আমি ফ্যান্টাসিতেই আছি! তোরা আয়!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৪৮