যারা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখা, সূতির খালের হাওয়া আমার ডায়রি বিশেষ।
আমার স্ত্রী'র সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল শেষ করে লিখতে বসেছি। দুজনেই একদম ছন্নছাড়া, কামলা (হ্যারিস নয়, আক্ষরিক অর্থে) বেশে , খুবই আনরোম্যান্টিক, খোঁজখবর নেয়া জাতীয় কিছু কথাবার্তা বলে বিদায় নিলাম। তিনি আমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছেন কিছুদিন যাবত। আমিও এই সুযোগে রুমের চেহারা আমার ব্যাচেলর দিনগুলোর মতো বানিয়ে ফেলেছি। যাওয়ার দিন সকালে যে মগে কফি বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তা আধোয়া অবস্থায় পড়ে আছে আজ তিনদিন। আমার মুজোজোড়া কোন কারন ছাড়াই ঝুলছে খাটের হেডবোর্ডে। পোশাকআশাক আর বইপত্তর ছড়িয়ে আছে রুমজুড়ে। ঘুম থেকে উঠছি বেলা দশটায়। ঘুমাতে যাচ্ছি রাত তিনটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ব্রেক চলছে। একটা গবেষণার কাজ ছাড়া বাঁধা কোন দায়িত্ব এ মুহূর্তে নেই।
আমি গর্বিত এরকম আগোছালো অবস্থায়, তা নয়। এমনটাও নয় যে ঘরদোর সামলানোর দায়িত্ব কেবলি ওর। রুম গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার। ও বাসায় থাকলে ভয়ে ভয়ে সময়মত গুছিয়ে রাখি। নইলে একটু দেরী হয়। যেমন, এইবার তিনদিন দেরী হয়েছে মাত্র।
এই মুহূর্তে যেটা চিন্তা করছি, সেটা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলে অনেকটা এরকম দেখাবে।
খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের জীবনের অপূর্ণ প্রেমের কাহিনীগুলোই আমাদের মনে বাজে বেশী। যে সম্পর্কগুলি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে, যে সম্পর্কগুলো কুড়িতেই ঝরে গেছে, অথবা চারাগাছ থাকা অবস্থায় উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে যাদের অকালমৃত্যু হয়েছে, অথবা মহীরুহ হয়ে ওঠার পথেই ঝড়ে ভেঙ্গে পড়েছে, বা কেউ কেটে ফেলেছে - এমন সব সম্পর্কের গল্পগুলো অতি দীর্ঘদিন যাবত আমাদের মনে জাগরূক থাকে। ছোট ছোট ঘটনা। বড় বড় ঝগড়া।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার দীর্ঘ চার বছরের প্রেমিকা যখন প্রথমবার, এক শীতের সকালে ডিপার্টমেন্ট করিডোরে হেঁটে এসে আমার সাথে কথা বলেছিল, সেই দৃশ্য আমার চোখে আজও ভাসে। হয়তো তার চোখেও ভাসে। এই কারনেই হয়তো, আমরা দুজনেই আজ বিবাহিত এবং নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্যেও একে অপরকে ফেসবুকে ব্লক করে রেখেছি। শেষ কথা হয়েছে পাঁচ বছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষদিন। তবুও। তার ওয়েল বিয়িং আমার জীবনে এখনো প্রাসঙ্গিক। যেমন প্রাসঙ্গিক তার জীবনে আমার ওয়েল বিয়িং। কিন্তু প্রাসঙ্গিক নয় আমাদের একের জীবনে অপরের কোন সরাসরি উপস্থিতি। আমি জানি, আশা করি সেও জানে, আমাদের আর কখনো কথা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। দেখা হওয়াও চরম অস্বস্তির উদ্রেক করবে পরস্পরের জন্যে। বিয়ে পৃথিবীর সমস্ত মানবীয় দুর্বলতার উরধে। অন্তত তাই তো হওয়া উচিৎ।
আমার প্রেমিকা, এবং প্রেমিকাদের নিয়ে আমার অনেক সৃজনশীল কাজ আছে। গান আছে। কবিতা আছে। ফিকশন আছে। আমি চিন্তা করি, এবং চিন্তা করলে মাঝেমাঝেই অস্বস্তি লাগে যে আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কোন সৃজনশীল কাজ, এখনো সেরকম কিছুই নেই। এই সমস্যা মনে হয় না একা আমার। রবীন্দ্রনাথ তার জীবনের কয়টা গান তার স্ত্রীকে নিয়ে লিখেছিলেন, তার ওপর মনে হয় না কোন গবেষণা আছে। লেখেন নি বললে ভুল হবে না। বা লিখলেও, তার অতি অসংখ্য মনোরম প্রেমের গানের তুলনায় তার সংখ্যা নিতান্ত অপ্রতুল।
খেয়াল করে দেখবেন, সাহিত্যিকরা তাদের উপন্যাস - কবিতার বই উৎসর্গ করেন তার স্ত্রীর নামে প্রায়ই। যদিও ভেতরে যে গল্পটা থাকে, তা হয়তো তার স্ত্রীকে নিয়ে নয়। আমি এ নিয়ে অনেক ভেবেছি, এবং আমার মনে হয়েছে যে, বিয়ে হওয়ার আগের গল্পটা যত সুন্দরই হোক না কেন, বিয়ের পর প্রায় সবাইকে একই দিনলিপির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাতে বৈচিত্র্য কম। হারানোর ভয় কম। না পাওয়ার মধ্যেও হঠাৎ করে একটুখানি পেয়ে যাওয়ার হর্ষ কম।
ব্যক্তিজীবনে স্বামী হিসেবে নিজের দায়িত্ব সতর্কভাবে, যত্ন, এবং ভালোবাসার সঙ্গে পালন করে এলেও, আমার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিপ্রকাশে আমার স্ত্রী কেন অনুপস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়। অপরাধবোধে ভোগায়।
নিজেকে দেয়া নিজের প্রবোধবানী, খানিকটা ক্লিশে শোনালেও, এরকম -
আমাদের জীবনসঙ্গীর তুলনা চলে অক্সিজেনের সঙ্গে। চারপাশ জুড়ে আছে সে, যদিও তার উপস্থিতি সে সবসময় জোরেসোরে জানান দেয় না। তাকে ছাড়া আমাদের জীবন অচল, তবুও তাকে আমরা গদ্যে- কবিতায় গ্লোরিফাই করি না। একমুহূর্ত তাকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না, তবুও কখনো আমাদের এই দুশ্চিন্তা এসে ভর করে না যে কখনো আমাদের তাকে, অর্থাৎ অক্সিজেনকে, ছেড়ে থাকতে হবে। আমাদের জীবনসঙ্গীর তুলনা চলে ভাতের সঙ্গে ( যেহেতু ভাত বাঙ্গালী জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ)। আপনি টেকআউটের বার্গার ভালোবাসতে পারেন, ভালোবাসতে পারেন পিজা হাটের পিজা, বা অ্যাপেলিয়ানোর ফ্রাইড রাইস। কিন্তু আপনি দিনের পর দিন বার্গার, পিজা, বা ফ্রাইড রাইস খেয়ে থাকতে পারবেন না। আপনার ভাতের কাছেই ফেরত আসতে হয়। ভাতকে নিয়ে কিন্তু আমরা রোম্যানটিসাইজ করি না। আমাদের জীবনসঙ্গীর তুলনা চলে আমাদের অতিপুরাতন, কিন্তু অতিআপন টিশার্টটির সঙ্গে, যার রং চটে গেছে, জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গেছে, তবুও আমরা প্রতিরাতে ঐ টিশার্ট পরেই ঘুমাতে যাই। ওটা যেন আমাদের শরীরের একটা অংশেই পরিনত হয়ে যায়।
স্ত্রীকে নিয়ে হুট করে আবেগী কবিতা হয়তো লেখা হয়ে ওঠে না, কিন্তু বিয়ের পর আপনি অনুভব করবেন স্ত্রীকে ছাড়া একা বাইরে ভালো কোন রেস্টুরেন্টে খেতে ইচ্ছে করে না। যেকোনো মূল্যবান, মিনিংফুল ইভেন্ট মিনিংলেস হয়ে অর্ধেক হয়ে যায় স্ত্রীর উপস্থিতি ছাড়া। প্রথমবারের মতো প্রেমিকার হাতে হাত রেখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার থ্রিল হয়তো বিয়ের সম্পর্কে থাকে না, কিন্তু গভীর রাতে, জাস্ট নিশ্চয়তার জন্যে বিছানার পাশে হাত দিয়ে আপনার অর্ধাঙ্গীর উপস্থিতি টের পেয়ে পুনরায় গভীর ঘুমে ঢলে পড়ার অর্থবহতা টের পাওয়া যায়। দীর্ঘক্ষন রেস্তোরায় অপেক্ষার পর পরিপাটি সুন্দর প্রেমিকাকে দেখতে পাওয়ার আনন্দ বিয়ের সম্পর্কে নাই বা থাকলো, নিজেকে দুর্বল, অসহায়, একদম আনকোরা র' অবস্থায় কারো সামনে মেলে ধরেও যে ভালোবাসা পাওয়া যায়, এক স্ত্রী ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রেই বা এমনটা সম্ভব?
একজন ব্যক্তিমানুষ সৃজনশীল হোক বা না হোক, তার জীবনে মহাকাব্য একটাই, তা তার জীবন - স্বয়ং। আর সে মহাকাব্যের অতিগুরুত্বপূর্ণ সহলেখক, তার স্ত্রী। সেই স্ত্রীর নামে মহাকাব্য না লেখা হলেও তিনি তার রচিত সকল মহাকাব্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই রবেন, যেমন রবিঠাকুর বলেন - 'তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম......'
(লেখাটি আপাতদৃষ্টিতে একজন পুরুষালি মনোভাব থেকে লেখা হয়েছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এটা নারী লেখিকা, পেইন্টার, অভিনেত্রী, ফিল্মমেকার এবং তাদের স্বামীর ব্যাপারেও প্রযোজ্য। ছবিসূত্রঃ পিন্টারেস্ট)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ১২:০৪