somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূতীর খালের হাওয়া ১৮ - থেঁতলানো তেলাপোকা, চৈত্রের ঝরাপাতা, আর কেরামতমঙ্গলের স্রষ্টা

২৪ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, ছবি - দা ডেইলি স্টারের বরাতে)

১।

৪/ ১২/ ০৭

"এই হিম শীতে লিখতে লিখতে দু কাপ চা সাবাড়।
সারা পথ কেঁদেছি অন্বিতার জন্য। সারা পথ। হে ঈশ্বর - তবে তুমি সেই শূন্য উষরতায় নেবেই তাকে। কী অবাক।
আজ আমার অন্বিতা - আর কিছু না ঘটলে স্কুলে ভর্তি হবে। যদি জীবন ওকে টানে। ওর রক্তের ভেতর গাঁথা মৃত্যুর বাজনখ খুলে কি গলে যাবে।
দাও না। ভিক্ষা দাও না আমাকে। আমার বুকের অধিক বুক হয়ে থাকা অন্বিতাকে।
বহুকাল পর - এই মৃত অক্ষর এই কষ্ট পাঠকের কাছে বহন করে নিয়ে যাবে - ডাকহরকরাদের মতো।
কিন্তু ততোদিনে মৃত এইসব বেদনার কবর ঢাকা কঙ্কাল জীবন্ত শরীর নিয়ে দাঁড়াবে কি না পাঠকের সামনে।
এই ভোর আজান প্রকম্পিত সুর ঢুকে যাক না অজানা আমার ভোর।
বেদনা ভেতর। কী অপূর্ব সুর। কুয়ার ভেতর দিয়ে ঊর্ধ্বলোকে সঞ্চারী।
নাজমা - রফি জেগে আছে। রফিকে নিয়ে হাঁটতে বেরুবো।


১৩/১২/০৭

"এইতো খানিক সময়। যাদু যাদুরে।
দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে ভোর নামবে
কৃষ্ণপক্ষ রাত। ঐ যাদুরে যাদুরে ও যাদু।
তারপর মানব জন্মে কতো ঋতু
শস্যকর্তন
মাঠে মাঠে সোনার সর্ষেফুল - সব চাঁদ
তোর সাথে দেখা আর হবে না আর কখনোও।

দেখো এক অন্ধ কবি আউষি ভাষায় বলেছিল -
চোখের জলকে যিনি লবণী করছেন
সমুদ্রকে তিনিই করেছেন অসম।
লবণ সমুদ্র চোখ থেকে বুক থেকে
নিপার অপার।

এই তো খানিক সময়
রইলো তোর খেলনা পুতুল - মিকি মাউসের কাঁদন।
রইলো জন্মদিনের স্মৃতি তোর।
তারপর ছোটো বুকে দ্রুত শ্বাস
কষ্টের কঠিন চাকা
থামাবে যে চিরজন্মের মতো।
রইলো রঙ্গিন জামা শিশুগাছ - বুকের ভেতর
অজস্র পায়ের ছাপ
তারপর নির্মম কার্পাস বসন।
মাটি গোর - সূর্যের আবর্তন।"

~
দিনলিপি, সেলিম আল দীন, পৃষ্ঠা ৩৮৫ - ৩৮৬

২।

সাতসকালে, বাথরুমে বসে আছি, হাতে মশা মারার ব্যাট নিয়ে। আজ বিরক্ত করতে এলো, অনেক মশার সঙ্গে, একটি ক্ষুদ্র তেলাপোকার ছাও। পা দিয়ে পাড়া দিয়ে ওটার ভবলীলা সাঙ্গ করতে একমুহূর্ত দেরী হোল না।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে ভাবলাম, ক্ষুদ্র তেলাপোকা ছিল বটে, কিন্তু তাও তো একটা প্রাণ। জ্যান্ত, জীবন্ত। তেলাপোকার কি হৃৎপিণ্ড থাকে? মানুষের মতো অতটা জটিল তো অবশ্যই নয়, কিন্তু হৃৎপিণ্ড, সে যেকোনো আকৃতিরই হোক না কেন?

একটা প্রাণকে পৃথিবী থেকে মুছে দিলাম একটু আগে, যদিও আমার মনের ত্বক খুবই নরম। আলট্রাসেনসিটিভ। সাধারণত চেষ্টা থাকে, (নিজে সহ্যসীমার চেয়েও চড়াতানে আক্রান্ত না হলে) দূরদুরান্ত থেকে কাউকে কোন রূপ কষ্ট না দেবার। তেলাপোকা মারলে আমার কষ্ট লাগে না কেন? সপ্তাহান্তে শয়ে শয়ে মশা মারি। তাও তো প্রাণ। আমার গায়ে লাগে না, ভয় হয় না, কিছুই না।

ক্ষতিকর, কুৎসিত পোকামাকড়ের প্রাণ, সাধারণত মানুষের কাছে অর্থবহন করে না।

বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম, ব্রাশ করা শেষ করে। ঘরে সকালের জলখাবারের আয়োজন চলছে। তার আগে একটু বিরতি।

বাসার সামনে অনেক গাছ আমার। তার অনেক পাতা, এখনও, এই চৈত্রমাসেও, পড়ে স্তূপাকারে জমা হয়ে থাকে তার নীচে।

ছোট একটা গণ্ডির মধ্যে আমার জীবনের মূল্য আছে। দ্যোতনা আছে। অর্থবহতা আছে। তবে, মহাকালের চোখে, আমার জীবন, এই তেলাপোকার প্রাণের মতই। বা, এই ঝরা পাতার মতোই সস্তা।

আনটিল অর আনলেস ...

৩।

রুমে ফিরে এসে আমার চেয়ারে এসে বসি। ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়েছি। মাথার কাছ থেকে সরানো হয় নি আমার ইদানীংকালে রাতে ঘুমানোর সময়কার সঙ্গী, সেলিম আল দিনের দিনলিপি। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইটি গতবছরের অগাস্টে, করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে যখন বাইরে বের হওয়া শুরু করি, তখন, পাঠক সমাবেশ থেকে কেনা।

বইটিতে সেলিম আল দীনের ২০০১ সালের মে মাস থেকে ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দিনলিপি মুদ্রিত। উপরের দুটো জার্নাল এন্ট্রি, তার মৃত্যুর ঠিক ১ মাস আগের।

আমি বইটি বিছানা থেকে তুলে বুকশেলফে তুলে রাখার বদলে আবার হাতে নিই। ডায়রির পাতায় নিবদ্ধ শেষ দুটো লেখা আবারো পড়ি।

"তারপর মানব জন্মে কতো ঋতু
শস্যকর্তন
মাঠে মাঠে সোনার সর্ষেফুল - সব চাঁদ
তোর সাথে দেখা আর হবে না আর কখনোও ..."


হায়রে মানুষের পৃথিবী দেখার আজন্ম অপূর্ণ সাধ!

পুরো ডায়রিটায় প্রাণোচ্ছল, কর্মী সেলিম আল দীনের বদলে ধ্যানী, অন্তর্মুখী সেলিম আল দীনকে আবিষ্কার করা যায়। ২০০১ সালের মে মাসে যে সময়ে তার স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া উপহারস্বরূপ খাতায় তিনি তার দিনলিপি লেখা শুরু করেন, তখন থেকেই তার শরীরে নানা ঘাতক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। তার ডায়রিতে থেকে থেকে, ঘুরে ফিরে এসেছে মৃত্যুচিন্তা।

শেষ গদ্য জার্নালে তিনি লিখেছেন তার শিশু কন্যা, প্রাণঘাতি রোগের সঙ্গে যুঝতে থাকা অন্বিতার ব্যাপারে তার কষ্টের কথা। শেষ পদ্য হিসেবে জার্নাল এন্ট্রিতেও দেখি মৃত্যুপথযাত্রী শিশুকন্যার প্রতি তার শোকের স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুরণ।

ভুক্তভোগীদের তরফ থেকে বেশ কিছু অভিযোগ সেলিম আল দিনের ব্যক্তিগত জীবনাচার নিয়ে থাকলেও, সেলিম আল দিনের জীবনের প্রতি ভালোবাসা আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে। তার কন্যার শোকে আমার হৃদয়ও দ্রবীভূত হয়। তার কারন তিনি তার লেখায় বলে গেছেন - "বহুকাল পর - এই মৃত অক্ষর এই কষ্ট পাঠকের কাছে বহন করে নিয়ে যাবে - ডাকহরকরাদের মতো।" তার দিনলিপির মৃত অক্ষরেরা সজীব - সজাগ হয়ে উঠে আসে বইয়ের পাতা থেকে। আমাকে ঘিরে পাক খেতে থাকে ঘরময়, চৈত্র প্রভাতের হাওয়ায় ভেসে ভেসে।

প্রভাতের রৌদ্দুর, যা অন্তত আর একবার দেখবার জন্যে হলেও কেরামতমঙ্গলের স্রষ্টা ফিরে আসতে চাইতেন ভঙ্গুর মানুষে ভরা এই পৃথিবীতে, আমার পায়ের কাছে পোষ মানা সারমেয়র মতো লুটিয়ে পড়ে থাকে।

আমার জীবনের মূর্ত জটিলতাগুলোকে আরও জটিলতর করে তুলবার মতো দীর্ঘদিন যাবত আমায় তাড়া করে বেড়ানো একটি প্রশ্ন হল এই - মহাকালের সম্মুখে চোখের পাতা ফেলবার মতই ফেলনা এ জীবনকে অর্থবহ করে তোলা যায় কীভাবে?

সেলিম আল দীনের দিনলিপি এক বার্তা দিয়ে গেছে আমায়। শব্দগরের পরিচয়কে আরও দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা, আর মানুষের জীবনকে ক্রমাগত প্রতিবিম্বিত করতে থাকা, লেখার আয়নায়।

নইলে আমার আর ঐ থেঁতলানো তেলাপোকায় পার্থক্য কোথায়? গড়পড়তা একজন মানুষ হিসেবে বরং পৃথিবীকে আরও বেশী নোংরা আর বসবাসের অযোগ্য অবস্থায় রেখে যাই আমি, আমরা যেকোনো কীটপতঙ্গের চে।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:২৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×