১।
"আগার মিলে খোদা তো,
পুছুঙ্গা খোদায়া
জিসম মুঝে দে কে মিট্টি কা
শিসে সা দিল কিউ বানায়া ..."
সঞ্জয় লীলা বানসালির মুভি হাম দিল দে চুকে সানামের বিখ্যাত একটা গান - "তাড়াপ তাড়াপকে ইস দিল সে আহ নিকালতি রাহি ..."র দ্বিতীয় অন্তরার কিছু লাইন দিয়ে শুরু করলাম লেখাটা। সঞ্জয় সাহেব এখন তার সব মুভির সুর নিজে করলেও, তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মিউজিশিয়ান - কম্পোজার ইসমাইল দরবার সাহেবের সঙ্গে তিনি বেশ কিছু গান করেন। তার এক অনন্য কম্পোজিশান, আরও অনেকগুলো গানের সঙ্গে, এই বিচ্ছেদি গানটাও। গানটায় কণ্ঠ দেন একসময়ের বলিউডের সেরা প্লেব্যাক সিঙ্গার 'কে কে'। এই গানটার
কোক স্টুডিও আনপ্লাগড ভার্শনে তিনি গান রেকর্ডিং এর পিছে কিছু না জানা গল্প শেয়ার করেন। গানটি রেকর্ড করবার মাঝেই স্টুডিওতে কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিলে, তারা স্টুডিওতে অপেক্ষা করতে করতে পুনরায় যখন রেকর্ড করা শুরু করেন, তখন ঘড়ির কাটায় রাত চারটা। 'কে কে' বলেন, তিনি স্টুডিওর বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিরন্তন ছুটে চলা মুম্বাই শহরের ঝিমিয়ে পড়া ভাবকে ভেতরে অনুধাবন করেন, অনুধাবন করেন শহরের মানুষদের অসংখ্য বলা না বলা গল্প, কথা রাখা না রাখার কাহিনী, বিশ্বাস স্থাপন ও বিশ্বাসভঙ্গের আফসানা, এবং স্টুডিওর ভেতরে প্রবেশ করে, গানের সুরে কণ্ঠ দিয়ে জন্ম দেন বিচ্ছেদী গানের জনরার এক অবিস্মরণীয় মাষ্টারপিস।
কিছু কিছু গান আছে, যা ঐ মাঝরাত থেকে শেষরাতেই শুনতে ভালো লাগে, তখনি অন্তরে অনুভূতির সঠিক তারগুলোকে অনুরণিত করে। কিছুকিছু কবিতা যেন লেখাই হয় ঐ সময়টাকে মাথায় রেখে। কিছু কিছু অনুভূতি আছে, যারা ঐ মাঝরাত থেকে শেষরাত ছাড়া দিনের অন্যান্য সময়ে বাস্তবতার ভিত্তিতে দাঁড়াতেই পারে না, হাস্যকর মনে হয়। আমার প্রিয় আইরিশ সিঙ্গার - সংরাইটার ড্যামিয়েন রাইস যেমন বলেন -
" Leave me out with the waste
This is not what I do
It's the wrong kind of place
To be thinking of you
It's the wrong time, for somebody new
It's a small crime
And I got no excuse
And is that alright?"
২।
আমরা শৈশব নিয়ে বেশী স্মৃতিচারণ করি। বয়স খানিকটা বেড়ে গেলেই ফিরে ফিরে চাই শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলিতে। এর একটা কারন হয়তো এই যে, জীবনের বত্রিশ রকম চেহারা বাদে, সেই সময়টায় কেবল জীবনের দুশ্চিন্তাবিহীন সুন্দর দিকগুলোই প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে চোখের সামনে, মনের ভেতর। কিন্তু, আমাদের সবার জীবনেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় আমাদের কৈশোর পেরুনো, যৌবনে পা রাখা রাতজাগা সময়গুলোও, এটা আমরা অনুভব করলেও আলোচনায় আনতে প্রায়ই ভুলে যাই। রাত বারোটা থেকে নিয়ে ভোররাত চারটা পর্যন্ত সময়টুকু আমরা কিশোর - তরুণ - যৌবনে প্রায়ই নকচারনাল / রাতজাগা প্রাণীতে পরিণত হই। এই রাতজাগার অভ্যাস আমি পিছনে ফেলে এসেছি বেশী দিন নয়, দুই - আড়াই বছর হবে হয়তো। তার আগে, দিনের সবচে পছন্দের সময় ছিল আমার ঐ রাত বারোটা থেকে নিয়ে তিনটা, কোন কোন রাতে চারটা - সাড়ে চারটা পর্যন্ত।
কি করতাম ঐ সময়?
কতোকিছুর স্মৃতিই তো জমে আছে, সব তো বলার মতোও না। প্রেম করতাম মূলত, কবিতার বই পড়তাম, কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম, গান শুনতাম, নতুন গানে সুর বসাতাম। যে উপন্যাসের বই আমার খুব ভালো লাগতো, সেটা শেষ করবার পছন্দনীয় সময় ছিল সারা রাত জেগে পড়তে পড়তে, ভোরবেলার সময়টুকু, যখন আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে। মনে হতো, একটা গল্পের পৃথিবীর পাট চুকিয়ে নতুন আর এক পৃথিবীতে পা রাখছি আমি, এই নবসূর্যোদয়ের সঙ্গে। এছাড়া, প্রেম নামের বায়বীয় অনুভূতি, কিছুদিন বেহেস্তের অনুভূতি জাগিয়ে পুনরায় বাতাসে উবে গেলে তার বিচ্ছেদযন্ত্রণা সবচে বেশী কাতর করে রাখতও এই সময়টা।
মনে পড়ে, পিয়ানো শিখতাম যে দিনগুলোতে, ২০১১ - ১২ সালের দিকে, গভীর রাত ছিল আমার পিয়ানোর লেসন প্র্যাকটিস করবার সময়। রাত বারোটার পর বসতাম সাধারণত। আমার স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে এখনও মাঝেমাঝে রাতে খাবার পর বসা হয় কিবোর্ড সামনে নিয়ে। আমার বোন সেদিন আমাকে বলল, ঘুমানোর আগে আমার কিবোর্ডের টুংটাং শুনে ওর মনে পড়ে গিয়েছিল পুরনো ঢাকার আই জী গেইট ব্যাংক কলোনিতে আমাদের ফেলে আসা শৈশব - কৈশোর জীবনের কথা, যখন আমি একইভাবে রাত জেগে পিয়ানো লেসনস প্র্যাকটিস করতাম।
মনে পড়ে, চাকরী জীবনে প্রবেশ করার পরেও, জীবনসঙ্গী বাছাই করে যখনও থিতু হইনি, তখন মাঝরাত্রির গান নামে একটা ফেসবুক সেগমেন্ট আয়োজন করতাম। নিজের, বা কাভার সং রেকর্ড করে রাত আড়াইটা - তিনটার দিকে আমার ফেসবুক প্রোফাইলে সে গান আপলোড করতাম। মতিঝিল থেকে ফার্মগেটে আমার তৎকালীন অফিস / ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের সাথে লোকাল বাসে দেখা হয়ে যেতো, তাদের সঙ্গে কথা হতো সে গান নিয়ে।
যেমন, আমারমাঝরাত্রির গান শিরোনামে একটা আলাদা গানই আছে, যার লিরিক এরকম -
"রাত্রি তখন গভীর, ঘড়িতে তিনটা এক
স্নায়ু ভুগছিল শীতল মাদকতায়
বুকে দারুণ তোলপাড়, অস্থির এক ব্যাথা
কে যেন বলছে স্বপ্ন খুঁজে দেখ!
...
কারো বৌ বাচ্চায় সাজানো সুখের ঘর
কারো একলা জীবন ধুধু বালুচর
কেউ ভিড়ের মাঝেও একলা বসে কাঁদে
কারো একলা জীবন ভালো, বাকি সব পর।
শূন্য হৃদয়ে শূন্য ঘরে বসে,
বুঝলাম আমি তোমায় ভালোবাসি
ফর্মালিটির পর্দা পড়ুক খসে
বুড়োবুড়ি মোরা হবো বসে পাশাপাশি ..."
আমার, আর আমার ইংরেজি বিভাগের এক প্রাক্তন - দুজনেরই পছন্দ ছিল জয় গোস্বামীর কবিতা। একা থাকার রাতগুলোতে জয় গোস্বামীর কবিতা আবৃত্তি করবার মতো করে পাঠ ছিল অভ্যাস -
"কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, তুমি আমার সামনে দাঁড়ালেই আমি
তোমার ভিতরে একটা বুনো ঝোপ দেখতে পাই।
ওই ঝোপে একটা মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া আছে।
অনেকদিন ধ'রে আছে। কিন্তু আশ্চর্য যে
এই মৃতদেহ জল, বাতাস, রৌদ্র ও সকলপ্রকার
কীট - বীজাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। এর পচন নেই।
বন্য প্রাণীরাও এর কাছে ঘেঁষে না।
রাতে আলো বেরোয় এর গা থেকে।
আমি জানি মৃতদেহটা আমার।
কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, এই জারিজুরি এবার ফাঁস হওয়া প্রয়োজন।
আর তা হবেও, যেদিন চার পায়ে গুঁড়ি মেরে গিয়ে
পা কামড়ে ধ'রে, ওটাকে, ঝোপ থেকে
টেনে বার করব আমি ..."
('বিবাহিতাকে' , কাব্যগ্রন্থ - " ওঃ স্বপ্ন" )
আমার মনে পড়তো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একমাত্র বন্ধু দুখাই নরকান্দ্রনাথ, ওরফে চিশতি অনিমেশের কথা, দুজনে মিলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের খোলনলচে বদলে দেয়ার স্বপ্ন দেখতাম যে দিনগুলোতে, টিএসসির সোডিয়াম বাতি স্নাত সে রাতগুলোর কথা। আমার মনে পড়ে, আমার বন্ধু ওর আইনের পড়াশোনা শেষ করতে পারে নি। অনার্স শেষ করার আগেই ও ড্রপআউট করে। ও বলতো, ও এক পারিবারিক অভিশাপের চক্রে আটকা পড়া মানুষ। ও বলতো, ওর বাবাও সেই অভিশাপের শিকার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আইনের পড়াশোনা আর শেষ করে বের হতে পারে নি। ও বলতো, একই অভিশাপ অজগর সাপের মতো গিলে খাবে ওকেও। আমার মন চাইতো ওকে বলতে, এই অভিশাপের ঘের আমরা একসঙ্গে পেরুবো, হাতে হাত ধরে, দুই ভাইয়ের মতো। কিন্তু মানুষের প্রত্যেকের জীবনের লড়াই আলাদা আলাদা, সে লড়াই একার লড়তে হয়, পরম একাকী, প্রভাস্বর শূন্যতা প্রস্ফুটিত হয়ে থাকা সেই একাকী জায়গায় মানুষের যুঝতে হয় একাই, সঙ্গী হলে এক খোদা হতে পারেন - এটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগে। আমি ততদিন খাদ বেয়ে উপরে উঠে এসেছি। আমার বন্ধু দুখাই নরকান্দ্রনাথ, যা ছিল কবি হিসেবে তার ছদ্মনাম, সেই নরকে বসেই কালাতিপাত করলো কিছু দিন। তারপর ডুব দিলো শুন্যে।
ওর একটা গানের কথায় আমি সুর বসিয়েছিলাম, তাও সেই মাঝরাতেই। আমার খুব পছন্দের একটা লিরিক ছিল সেটা -
"চোখ ভেঙ্গে আসা ঘুমে
মাঝরাতে বেডরুমে
আবছায়া যত কালি ও কাগজে
ঘূর্ণিপাকে আমার মগজে
যত কবিতা
সব ভনিতা
তোমাকে শোনাতে চাইছি আর কি ...
তুমি জেগে আছো কী?
তুমি জেগে আছো কী?"
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিল ও, তার ছদ্মনাম রেখেছিল ও রেডওয়াইন। সে মেয়েকে নিয়েই লেখা এই গান। ঘুম আসছে না। স্মরণে বারবার ঘুরেফিরে আসছে সেই মেয়ে। তাকে নিয়েই অসংখ্য অগণিত শব্দ ঘুরে ফিরে আসছে ঘূর্ণিঝরের মতো মনের আকাশে। জন্ম নিচ্ছে একটার পর একটা কবিতা। এ সবকিছুই আসলে তার পর্যন্ত পৌঁছাবার একটা উপলক্ষ্য মাত্র। উপলক্ষ্য, এই মাঝরাতে তার সঙ্গে একবার কথা বলবার, ফোনে। কিন্তু সে কি জেগে আছে? জেগে যদি না থাকে, তাহলে তো ফোন করে তাকে ডিস্টার্ব করা হবে। কি করা? সে কি জেগে আছে? তুমি জেগে আছো কী?
কিছু প্রেম বেঁচে যায় পরিণতি লাভ না করে। আমার তেমনি এক স্বল্পদিনের প্রণয়ের কথা মনে পড়ে।
আমি তখন দীর্ঘদিন স্থায়ী এক সম্পর্ক চিরস্থায়ীভাবে হারানোর শোকে কাতর। এই একটা মেয়ে কোথা থেকে ঝড়ের মতো উদয় হয়েছিল সেই বিষণ্ণ শৈত্যের ঋতুতে। তাকে দেখতাম বাংলাদেশের সেরা সব মিউজিশিয়ানদের কণ্ঠলগ্না হয়ে ঘুরে বেড়াতে। তাও যে সে মিউজিশিয়ান না, হাবীব ভাই, তাহসান ভাই, বা অর্ণবদা'র সঙ্গে। তাদের স্টুডিওতে, বা অ্যালবাম লঞ্চের প্রোগ্রামে। আমাকে খুঁজে বের করেছিল সে ফেসবুকে। তখন আমি দিনরাত সম্পর্ক হারানোর বেদনায় কান্নাকাটি পোস্ট দিয়ে বেড়াতাম।
মেয়েটা এসে আমাকে বলল, সে আমাকে কেয়ারফ্রি ভাবে বেঁচে থাকা শেখাবে। কার্পেডিয়াম থিম, বা 'সীজ দা ডে' , বা আজকের দিনটা এমনভাবে বাঁচো, যেন কোন আগামীকাল নেই - এই তত্ত্ব ততদিনে আমি কেবল এন্দ্রু মারভেলের মেটাফিজিক্যাল কবিতায় পড়েছি। আমার বাস্তব জীবনে তার কোন প্রমাণ প্রয়োগ নেই।
আমার মনে পড়ে, সেই মেয়েটা আমাকে বলেছিল ওর একসময়ের প্রেমিক কীভাবে ওকে ড্রাগের সঙ্গে জড়িয়ে ড্রাগে অভ্যস্ত করে ফেলে,এবং পরে এই ড্রাগের চক্করে পড়ে কীভাবে ওকে জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়।
আমার মনে পড়ে আমাদের একরাতের কথোপকথন।
'- উড ইউ বি মাই টয় টুনাইট?
- ( দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর) নৌ, আই গেস ...
- কেনো!!!
- বিকজ, দেন দেয়ার উড রিমেইন নৌ ডিফারেন্স বিটুইন মি অ্যান্ড দা আদার বয়েস হু হ্যাড বিন ইওর টয় ফর আ নাইট। হুম ইউ নেভার কল্ড ব্যাক এগেইন।
- প্রবাব্লি আই কল্ড দেম অ্যাগেইন ...
- প্রবাব্লি ইউ হ্যাভন্ট!
- ( দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর) হোয়াই ডু ইউ নিড টু বি দ্যাট ডিপ অল দা টাইম আবির! ...'
অসাধারণ মিউজিকের টেস্টওয়ালা মেয়েটি বর্তমানে থিতু এক তরুণ সিনেমা নির্মাতার সঙ্গে। স্রষ্টা ওদের জীবনকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করুন।
৩।
২০১৮ সাল হচ্ছে সেই বছর, যে সময় থেকে আমি ধীরে ধীরে ঘৃণা করতে থাকি এই নাইট আউলের জীবন। আমি টের পাই, আমার রাতগুলো ক্রমশ কাটতে থাকে কবিতার বই, গানের সঙ্গে নয়, বরং ফেসবুকের নীল - সাদা স্ক্রিনে তাকিয়ে তাকিয়ে। আমার মনে পড়ে, একজন রমণী, যার সঙ্গে আমার পরিচয় পরিণয়ে পরিণত হয় নি, এবং যে আমাকে সবচে বেশী মানসিক কষ্টের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল , তার সঙ্গে কথোপকথন। প্রচণ্ড ঝগড়াঝাটির মুহূর্তে একদিন আমার চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরতে থাকে (ছেলেরাও কাঁদে ভাই। এটা স্বীকার করবার মধ্যে অন্তত আমার কোন লজ্জা নাই।)। উক্ত রমণী অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে এ আমার কি নতুন ঢং। আমার মনে পড়ে, শেষরাতে, আমি তাকে যে জবাব দিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, আমার শৈশবে এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে আমি আমার খোদার সামনে দাঁড়াতাম। আর আজকে আমার অধঃপতন আমাকে কই নিয়ে দাঁড় করিয়েছে! একজন মানুষের হাতে আমি ক্ষমতা তুলে দিয়েছি, আমাকে এতটা কষ্ট দেবার ...
বলা বাহুল্য, সেই সম্পর্ক আর টেকে নি। সম্ভবত, তার জীবনে ছাড়াছাড়ির পেছনে শোনা সবচে উদ্ভট কারনগুলির একটা।
আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পছন্দের বিয়ে। তার সঙ্গে পরিচিত হবার আগে আমি নিজের কাছে কয়েকটা প্রতিশ্রুতি করেছিলাম। তারমধ্যে একটা ছিল, আমি মুখবইয়ের পাতায় আমার জীবনসঙ্গী খুঁজবো না। বাস্তব জীবনে যার সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন কারো সঙ্গে আর কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, আমি লাইফে একটা চেইঞ্জ এনেছিলাম। ঘুমিয়ে পড়তাম দশটার দিকে। উঠতাম সকাল ছয়টায়। কাজেই সেই মাঝরাত, শেষরাতের রোমান্টিসিজম আমার বিয়ের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
রাত জাগতে একটা সময় পর্যন্ত ভালো লাগে। তারপর ক্লান্তি এসে পড়ে। ফেসবুকের পাতায় একসঙ্গে পাঁচজনের সঙ্গে চ্যাট করাটা, ভুল উইন্ডোতে রিপ্লে না দিয়ে, সেটাও একটা বয়স পর্যন্ত স্কিল বলে মনে হয়। তারপর, একটা সময় গিয়ে এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে যে নিঃসীম শূন্যতা, হলোনেস, সেটা চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হয় ধীরে ধীরে।
৪।
সবশেষ রাত জাগলাম গতপরশু। লাইলাতুল বারাত ছিল। কিছু প্রার্থনা, কিছু বিরতি নিতে নিতে ফজরের সময় চলে এলো। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আকাশের শুকতারা - দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পর তার পুরাতন বন্ধুকে দেখে মুচকি হাসলো যেন। আমিও হাসলাম বিনিময়ে। এমন সময় ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ার দমকে আমার ভেতর থেকে আরেক আমি, ছিটকে বেরিয়ে এলো আমার শরীর থেকে। আমার চোখের সামনে পাক খেতে খেতে দমকা হাওয়ার ঘূর্ণিপাকের সঙ্গে উড়ে চলল সে। মুগদা - টিটিপাড়া হয়ে জসিমুদ্দিন রোড - মতিঝিল - গুপিবাগ - টিকাটুলির মোড় - দয়াগঞ্জ - সূত্রাপুর - গ্যান্ডারিয়া - ফরিদাবাদ হয়ে আই জী গেইট ব্যাংক কলোনি, এ - ১ /১ নং ফ্ল্যাটে আমার রুমের সামনে নিয়ে হাজির করিয়ে দিলো আমাকে। ঘড়িতে তখন রাত চারটা।
আমার পুরনো বাড়িতে, আমার রুমের জানালার এপাশে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে উঁকি দিয়েই আমি দেখতে পেলাম আমাকে। আমার দশ বছর আগের সেই আমি, বসে আছে জানালার ঐ ধারে। হাতে গিটার, চোখ বন্ধ তার, চোখে পানি ঝরছে, আর সেই আমি গেয়ে চলছে - "আমি অপার হয়ে বসে আছি, ওহে দয়াময়, পারে লয়ে যাও আমায়, পারে লয়ে যাও আমায় ..."। আমার মন চাইলো আমি ওকে ডাকি। আমার মন চাইলো, আজ হতে দশ বছর আগের আমিকে ডেকে আমি জিজ্ঞেস করি - সে কোন পারে যেতে চায়? সে কেন পারে যেতে চায়? সে কার হাত ধরে পারে যেতে চায়? সে কারে ডাকে, এই শেষ রাতে?
আমার ডাকা লাগে না। আমার কৈশোরের আমি, জানালার ঐ পাড় থেকে আমাকে দেখে ফেলে। এগিয়ে আসে। জানালা খুলে দেয়।
কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই কোন কথা না বলে চুপচাপ থাকি। একটু পর সে নিজেই প্রথম মুখ খোলে।
- 'তুমি বদলে গেছো অনেক!'
- 'আমরা আলাদা কেউ নই।' আমি ভুল শুধরে দিই।
- 'তাও ঠিক।' একটু থেমে আমার আমি আবার প্রশ্ন করে
- 'কেমন আছো তুমি? কেমন আছি আমরা?'
- 'তোমার প্রার্থনা গৃহীত হয়েছে ভাই।' আমি হাসিমুখে উত্তর দিই, 'তুমি পাড়ে পৌঁছাবে।'
একটু থেমে যোগ করি
- 'বরং, তুমি পাড়ে পৌঁছেছো বন্ধু ...'
আমার আমি, আরেক আমি হাত বাড়িয়ে দেয় জানালার কাঁচের ওপার থেকে। আমিও হাত বাড়িয়ে দিই। কিন্তু আমি, আমার আমির হাত ছুঁতে পারি না। আমার শরীর আবার হালকা হয়ে, হাওয়া হয়ে যায়। আমি ফের উড়ে চলি। আমার আমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, উরধে, উরধে। তার মুখে হাসি। তার চোখে পানি।
আমি ফের এসে মিলিত হই গ্রিন মডেল টাউনে আমার শরীরের সঙ্গে। শুকতারা তখন প্রায় নিভুনিভু। সুবেহ সাদিকের আলো ফুটে উঠি উঠি করছে।
আমি শুকতারাকে বলি - বন্ধু, অন্তরে কষ্ট নিয়ে যে তরুণ, বা তরুণী আজ বিছানায় গিয়েছে, একাকীত্ব - আর অপূর্ণতার কষ্ট নিয়ে, তাদের এই সংবাদ পৌঁছে দিও যে, তাদের কষ্ট কেটে যাবে একদিন, শীঘ্রই।
তারা যেন আশা না ছাড়ে।
তারা যেন খোঁজ বন্ধ না করে।
আগে নিজের খোঁজ।
তারপর মনের মানুষের।
আমি খোদার সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াই, শুকতারা তখন আকাশে একলা জ্বলজ্বল করছে।
ছবিসুত্রঃ " Whirling Dervishes II — Sharmeen Malik "
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২১ দুপুর ১:৩৬