আমার রিকশা যখন দয়াগঞ্জের মোড়ে জ্যামে আটক, রাজধানী সুপার মার্কেটের দিক থেকে ছুটে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাবল ডেকার বাস তখন দাঁড়িয়ে আছে ঐ জ্যামেই, রাস্তার বিপরীতে। আমি সেই বাসের দোতালায়, ছেলেদের বসার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা জায়গায় আমাকে দেখতে পাই। হাতে সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে। পড়ছি। একটু পর, হাতের বই নামিয়ে রেখে বাসে বসা আমি তাকিয়ে থাকি দয়াগঞ্জ মোড়ের জামে মসজিদের উঁচু মিনারের দিকে।
আমার রিকশায় এখন দুপুর বারোটা।
ঐ বাসে বসা আমার ঘড়িতে এখন কয়টা বাজে?
সন্ধ্যা হচ্ছে হবে হয়তো।
এখন কি মাস?
মার্চ শেষ করে এপ্রিলে পড়লাম তো?
২০১১ - ১২ সালের দিকে এই সময় আমার ইংরেজি বিভাগে মিড এক্সাম চলছিল।
সেই আমিই বসা তো বাসের ধারে?
চিন্তিত, ক্লান্ত, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা?
২০১১ সালের সন্ধ্যা ৬টার সময়কার আমি তাকিয়ে আছি দয়াগঞ্জ মোড়ের মসজিদের মিনারের দিকে।
২০২১ সালের দুপুর ১২টার সময়কার আমি তাকিয়ে আছি উল্টোপাশের বাসে বসা আরেক আমি'র দিকে।
আজ থেকে দশ বছর আগের আমি'র চেহারায়, চোখে মুখে সদ্যপ্রাপ্ত তারুণ্যের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস, একই সঙ্গে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার বিষণ্ণ ছায়া -আমি স্পষ্ট পড়তে পারি রিকশায় বসে।
আমার মোবাইল টুনটুন করে বেজে ওঠে। মাসের এক তারিখ। বেতন এসে জমা হয়েছে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীর।
আমি ব্যাংক ব্যালান্সটা খেয়াল করি।
ছোট একটা শ্বাস ফেলি।
মুখে বলি, আলহামদুলিল্লাহ।
না চাইতেও আমার মনে পড়ে যায়, দু'বছর আগে আমার বিয়ের দিনগুলির কথা।
আমার বিয়ে আমার পছন্দের ছিল। আমার পরিবার প্রাথমিকভাবে সম্মত ছিল না। বিশেষ কোন ইস্যু বা সমস্যা নয়। মায়ের একমাত্র ছেলে। নিজের পছন্দ মতো কনে খুঁজে বের করার খুব আগ্রহ ছিল বাসার সবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয়, পেশা - জীবনের পূর্বতন গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত একদম একগুঁয়ের মতো নিজে নিজে নেয়ায়, জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার বেলায়ও কারো সাহায্য নিতে চাই নি।
এ সমস্যাটাই এককথায় দু'কথায় সাময়িকভাবে বড় হয়ে দেখা দেয়। প্রবল আত্মমর্যাদার তাড়নায়, রাগে, জেদে, আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার বিয়ের পুরো খরচ একা বহন করবার। সত্য কথা বলতে, বিয়ে করবার জন্যে যে টাকা জমানো লাগে - এই প্রাকটিক্যাল পরামর্শ আমাকে কেউ আগে দেয় নি। কাজেই, সেভিংস খুব বেশী কিছু ছিল না। তাই আল্টিমেটলি সাহায্য নেয়া লাগে পরিবারের। আমার অনড় অবস্থান দেখে পরিবারও একসময় নরম হয়ে আসে। এখন তো সবই ঠিকঠাক, আলহামদুলিল্লাহ।
সদ্য আসা টেক্সট ম্যাসেজ নিশ্চিত করে, আমার অ্যাকাউন্টে এখন যে পরিমাণ অর্থ জমা আছে, সেটা দিয়ে একটা মধ্যবিত্ত গোছের বিবাহের পুরো খরচ, আমি একা বহন করতে পারি আজকে।
দুটো বছর অপেক্ষা করলে ভালো হতো কী?
এই প্রশ্নকে মাথার মধ্যে বেশীক্ষণ ঘুরপাক খাবার সুযোগ দিই না।
কি করলে কি হত - এটা নিয়ে চিন্তা করে এনার্জির বাজে খরচ করবার পক্ষপাতী নই আমি।
আমি বরং আবার আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করি সেই দোতালা বাসে বসা দশ বছর আগের আমি'র দিকে।
কিন্তু রাস্তার ওপর সে বাসকে আমি আর খুঁজে পাই না।
আমাকেও খুঁজে পাই না।
যেন ভোজবাজির মতো সব বাতাসে মিশে গেছে।
আমি আবারো ছোট করে শ্বাস ফেলি।
আমার খুব মায়া হয় দশ বছর আগের আমার জন্যে। যে আমি ঐ যে বাসে বসেছিলাম, অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে কৌতূহল, ভয়, বিষণ্ণতা, প্রত্যয় উদ্দীপিত চোখে।
আমার শুধু আজ নয়, প্রায়ই এরকম হয়।
অতীতে, অনিশ্চয়তার দিনগুলোতে যে রাস্তাসমূহ দিয়ে আগে প্রায়ই যাতায়াত করতাম, আজ, জীবনে - জীবিকায় থিতু হয়ে যাওয়ার পর যখন সেই রাস্তাগুলো দিয়ে পুনরায় গতায়াত করি, হঠাৎ করেই আমার আসেপাশের বাস্তবতা বদলে যায়।
আমি অতীতের দিনগুলোর পাতায় হাঁটা শুরু করি।
অতীতের আমিকে দেখতে শুরু করি আমার আসেপাশে।
সেই আমার মুখের আনন্দের রেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করি।
বর্তমান জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করি - আমার আনন্দের উৎসগুলো কতোটা বদলে গেছে।
সেই আমার মুখের বেদনার চিহ্নগুলো পড়ার চেষ্টা করি,
বোঝার চেষ্টা করি বর্তমানে কতোটা শক্ত হয়েছি আমি।
সেই আমার মুখের উৎকণ্ঠাগুলোর উৎসমুখ খোঁজার চেষ্টা করি, বুঝতে যে -
আমার আজ আর গতকালের উৎকণ্ঠার উৎসগুলোর ফারাক কতো।
মনে পড়ে, ছাত্রজীবনে, এক রমজানের ঈদের আগে, পত্রিকায় লেখাবাবদ পাওয়া মাসের বেতন হাজার তিনেক, বা বত্রিশশো টাকা প্যান্টের পকেটে রেখে, ফার্মগেট থেকে ভিক্টোরিয়া পার্কের পুরো রাস্তা বিহঙ্গ বাসে পকেট খামচে ধরে ঝুলে এসে নেমেছিলাম। ঐ টাকা, ঐ নাভি পর্যন্ত টইটুম্বুর বাসে, ঐ ক্রুশাল সময়ে পকেটমার হয়ে গেলে আমার নিজের মতো করে ঈদ উৎযাপন মাটি হয়ে যেতো।
অথচ আজ এ পরিমান টাকা পকেটে থাকলে তা আর আগের মতো টেনশন উদ্রেক করে না।
এই দুই মানসিক অবস্থার তফাতের মধ্যেই আসলে আমার - আমাদের বড় হয়ে ওঠা।
শবে বরাত গেলো কয়েকদিন আগে। কতো দোয়া করেছি আগের বছর, করোনা লকডাউনের মধ্যে, করোনা প্রথম ধাপের আতঙ্কে ঠাসা দিনগুলোতে, অর্থনীতির চাকা সচল থাকবার, পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকবার জন্যে। এ বছরের শবে বরাত যখন এলো, হিসেব করে দেখেছি, একটা দোয়া নেই, যেটা অপূর্ণ রয়ে গেছে এই দুই শবে বরাতের ব্যবধানে।
আমি আজও জানি না, আমি কখনোই খুঁজে বের করতে পারবো না, কীভাবে, শুধুমাত্র এটুকু সময়ের মধ্যে যা কিছু পেয়েছি, তারজন্যে কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করে শেষ করবো।
আমার মনে হয়, আমাদের জীবনের একটা মৌলিক সমস্যা হচ্ছে - আমরা কেবল চেয়েই যাই। আমাদের চাওয়ার তাড়া এতো বেশী যে, খুব কমই আমাদের পেছনে ফিরে মিলিয়ে দেখার ফুসরত হয় যে, জীবনে কি কি পেলাম। ধন্যবাদ বলার সুযোগ হয় না খোদাকে। বা যে যাকে বিশ্বাস করি, তাঁকে।
আমার মনে পড়ে, আমার রুমের দরজা বন্ধ করার পর আমি আর আমার স্ত্রী মিলে মানুষ মোট ছয় জন।
একজন আমি নিজে সবার অজান্তে অগোচরে, কারো প্রভাববলয়ের বাইরে, একদম অরিজিন্যালি যেরকম, সেই জন।
একজন আমার স্ত্রীর সামনে আমি নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করি, সে।
একজন হচ্ছে আমার সেই ইমেজ, আমি বলতে আমার স্ত্রী যাকে তার কল্পনায় তৈরি করে নিয়েছে।
একইভাবে, একজন হচ্ছে একদম একাকীত্বের সময় আমার স্ত্রী আদতে যেমন, তিনি।
একজন আমার সামনে আমার স্ত্রী তার যে সত্ত্বা/চেহারাকে দেখায়, সে।
আরেকজন, আমার স্ত্রীর যে ইমেজ আমার কল্পনায় গাঁথা, তিনি।
দুজন মানুষের এই ছয়টা সত্ত্বা মিলেমিশে এখনও আছি, মানবীয় সম্পর্কের সব লেনদেন সহই।
কি পরম বিস্ময়ের ব্যাপার!
জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গী রাখলে ছোট বড় কতো অসংখ্য অগণিত বিষয়েই মাথা আপনাতে নীচু হয়ে আসে।
এসব চিন্তা করতে করতে আমার রিকশার চাকা যখন সামনে ঘুরতে থাকে, আমার সাথে সাথে ছুটে চলতে থাকে আরও হাজার হাজার দিনের হাজার হাজার আমি।
কোন এক আমি তার প্রথম প্রেমের প্রস্তাবনার সফলতায় উৎফুল্ল।
কোন এক আমি মাথা নিচু করে হেঁটে চলে ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের প্রথম মিড এক্সামে ফিজিক্সে পাশমার্ক তুলতে না পারার দুঃখে, একদম মাটির সঙ্গে মিশে।
কোন এক আমি ইন্টারমিডিয়েটে আবার ঢাকা বোর্ডে ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপসহ গোল্ডেন পাওয়ার গর্বে উদ্বেলিত।
কোন এক আমি আমার মায়ের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন।
কোন এক আমি তারাশঙ্করের কবি উপন্যাস প্রথমবারের মতো পড়ার পর দিশেহারা হয়ে হেঁটে চলেছি রাতের ঢাকার পথ ধরে।
এরকম শত শত আমি, হাজার হাজার আমি, ছোট এবং বড় আমি, চলন্ত রিকশার চাকার ঘূর্ণনের সঙ্গে তাল রেখে, আমার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে, এবং বের হতে থাকে। তাদের সবার সংযোগে, সংমিশ্রণেই তো আজকের আমি।
আমার অসহায় লাগে।
আমি আকাশে চোখ রাখি।
আমার মনে পড়ে আমার শক্তির মূল উৎসকে।
আমার কৃতজ্ঞতাবোধ হয়।
আমি কখনো এটা মনে করি নি, একজন মানুষের পক্ষে সৃষ্টির সবগুলো রহস্যের সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব।
আমি জীবনের পথে বিনীত থেকেছি।
কৃতজ্ঞ থেকেছি।
জীবনের প্রতি বিনয়, কৃতজ্ঞতাবোধ - কঠিনতর সময়ে আমার পা'কে রুঢ় ভূমিতে শক্ত করে প্রোথিত করেছে।
কখনো কখনো আমার এতো অস্বাভাবিক রকম অবাক লাগে, যে অবস্থা, যে দিন, যে অনিশ্চয়তায় ঘেঁষা সময়গুলো আমি পেছনে ফেলে এসেছি - জীবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। ডুবে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। অথবা ভাসতে ভাসতে এমন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে গিয়ে ভুঁই খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল না, যেখানে থিতু হলে আমি আর আজকের আমি থাকতাম না।
আমার আসেপাশের অনেকেই ডুবে গেছে, অনেকে স্রোতের টানে ভেসে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু এই যে চারপাশে ঘটতে থাকা অসংখ্য ঘটনার ঘনঘটা, বিদ্যুতের প্রবাহের মতো তরঙ্গায়িত হচ্ছে, ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার শরীরকে, আমার মনকে, প্রভাবিত করছে ইতিবাচক ও নেতিবাচকভাবে, এই খরস্রোতা জীবনের বাঁকে কেউ একজন আমায় এক অদৃশ্য মায়ারজ্জুর বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে বলেই তো আমি ভেসে আছি।
আমি তাকেই খুঁজি অবিরাম, যার হাতে সেই মায়ারজ্জুর অপর প্রান্ত।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০২১ রাত ১০:১৯