somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মূল্যায়নধর্মী পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ 'বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য' (কাব্যগ্রন্থ) - পিয়াস মজিদ

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
১।
কবি পিয়াস মজিদের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা, তার কবিতার বইগুলো কিনবার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন - আমাকে আবিষ্কার করো, আমার কবিতাসমূহের মধ্যে। আমার অবাক লেগেছিল।
টি এস এলিয়টকে নিয়ে অনেক প্রচলিত মিথের একটা হচ্ছে, বয়স ত্রিশের নীচে কোন কবির কবিতা তিনি পড়তে চাইতেন না। কারণ, একজন কবি যে তার ক্রাফটের ব্যাপারে দরদি, সিরিয়াস, তার প্রমান হচ্ছে পরিণত বয়সে এসেও তার কাব্যচর্চা অব্যাহত থাকা। একজন সক্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে (যদিও আমাকে কথাসাহিত্যি পরিচয়ে প্রায় কেউই চেনে না) আমি তাদের লেখাই পড়ি, যাতে কিছু শেখার বাঁ নেয়ার আছে, তাই কালের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলা কবি - সাহিত্যিকের লেখা ছাড়া পড়ার সুযোগ হয় কম। জীবন সংক্ষিপ্ত, কর্মভারে ভারাক্রান্ত। তারমধ্যেই পঠন, তার মধ্যেই সাহিত্য রচনা। তাই সমসাময়িক সাহিত্যিকদের লেখা খুব বেছে পড়তে হয়।
.
সত্য যে, কবি পিয়াস মজিদ নানাবিধ পুরস্কার, এবং সম্মাননার ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তিনি যখন প্রথম দিনই তার কবিতার বই কিনবার পর আমাকে বললেন, 'আমাকে আবিষ্কার করো আমার কবিতার মধ্যে' আমার মনে হল, এই আবিষ্কার করবার কথা বলার সৎসাহস কোন শিল্পী বা সাহিত্যিকের মনের মাঝে কোন পুরষ্কার এনে দিতে পারে না, যদি না তিনি নিজের কাজের মানের ব্যাপারে, নিজের ক্রাফটের প্রতি নিষ্ঠা - অনুরাগ - আত্মত্যাগের ব্যাপারে ভেতর থেকে প্রবল আত্মবিশ্বাসী না হন। কবি পিয়াস মজিদের কাব্যগ্রন্থ 'বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য' (২০২০) - এর মূল্যায়নধর্মী পাঠপ্রতিক্রিয়ায় প্রবেশের পূর্বে এই ছোট ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক বিধায় শেয়ার করলাম।
.
২।
'বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য' কবি পিয়াস মজিদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যা আমি পাঠ করলাম। প্রথমে কাব্যগ্রন্থটিতে কবিমানসের যে ছায়া সন্নিপাত ঘটেছে, তার ওপর আলোকপাত করা যাক।
.
'বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য' কাব্যগ্রন্থের মুল সুর, শোকের তানে বাঁধা। শুধু শোক নয়, নিদারুন শোক, বঞ্চনা, এবং হতাশা। বিস্রস্ত বর্তমানে আটক আত্মার আঁধারমুখী নিম্নগমন।
.
কবির চোখে যে বসন্তের আগমন আজকাল ঘটে, তার পেট্রোলপোড়া কর্পোরেটঘ্রানে মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকা মানুষের আকুল চোখে চেয়ে থাকা কোকিলের কুহুতানের দিকে, যা হয়তো আদিম অরগ্যানিক বসন্তের শেষ স্মারকরূপে রয়ে গেছে পৃথিবীতে। কবি আরও বলেন - 'পৃথিবী মানে/ নিমকহারামের দেউড়ি' , তা সে পুরান ঢাকা হোক কি পুরান পোখরা। 'একমাত্র মর্গেই সুসম ফোটে / বকুলতলা।' (নেপালে, ৪৯)
.
হতাশ কবি 'জ্ঞানের গর্ত' থেকে হাতড়ে বেরিয়ে আসতে চান। উত্তীর্ণ হতে চান 'গানের গম্বুজ' এ (সুগারস্ট্রিটে হেমলকবৃষ্টি, ৫১)। 'ধূসর' কবি ছুটে যান 'একটা হরিৎ বনের কাছে'। আফসোস - সে কবিকে দেয় না তার 'সবুজের ভাগ'। সে কবিকে প্রস্তাব দেয়, তার সঙ্গে 'কফিনের কূলে' গমনের (কফিনের কূলে, ১৭)।
.
৩।
প্রেম হতে পারে যান্ত্রিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির এক উত্তম উপায়। কিন্তু কবিমানস বেদনার পাথারে ভেসে বেড়ায় এখানেও।
.
'খয়েরি' কবিকে কেউ 'নীল তীব্রতায়' দ্রবীভূত নোটবুক উপহার দেয়। কবি স্বপ্ন দেখেন - 'ভাবা গেলো তোমার নীলে লিখে রাখব / খয়েরি আমাকে'। মূলত 'মৃত্যুলিপি' লিখবার দায়পালন করতে করতে কখনো কখনো, লোভে পড়ে, পথচ্যুত হয়ে লিখে ফেলেন তিনি - 'দুর্লভ জীবনের দু' - চার অক্ষর।' (নীল নোটবুকের গান, ১৫) কিন্তু এতো স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের জয়গান গাওয়া নয়।
.
কবির উপলব্ধি - 'গুমোট গরমেও ঘাম প্রার্থিত হয় / যদি তাতে লেগে থাকে হৃদয়ের নুন।' (পার্ক স্ট্রীটের ট্রিট, ৩৭)। কিন্তু হায়, সে হৃদয়ের নুনই বা কোথায় পাওয়া যায়? কবি বরং অভিযোগ করেন, বা আক্ষেপের সুরেই হয়তো বলেন - 'পৃথিবীতে প্রেমের কবিতা সব / ফিকে হয়ে আসে / তবু কেন ফিরে ফিরে ফিঙ্গে ডাকে!' (প্রয়াত ভোরের স্মৃতিতে, ৩০)
.
এই ফিঙ্গের ডাকের যাতনায় হয়তো কবির মনে থাকে যে এখনো কর্পোরেট পৃথিবীর বুকের বিকিকিনির বাজারে পুরদস্তর রোবট হয়ে ওঠেন নি তিনি। বরং তিনি তার আকাঙ্খিত মানবীকে জুড়ে দেন এক নান্দনিক শর্ত -
.
'তোমার ভাষার শরীর থেকে খুলে নিতে হবে সব
অলংকার, অনুপ্রাস, উতপ্রেক্ষামালা
তারপর এই রিক্তের গহনায় সাজাব তোমাকে
নতুন নন্দনে।'
.
এবং এর বিনিময়ে তিনি দিতে চান, তা কাব্যগ্রন্থের মূল সুরানুগ, মৃত্যুর দ্যোতনাবাহী -
.
'যে তুমি কুৎসিত আমার সাজঘর বেছে নেবে
সে আমি তোমার মনোনীত মৃত্যু বেছে নেব।' ( মেঘের মঞ্জিল, ২৩)
.
পরিশেষে হতাশ কবি বলেন -
.
'আত্মা - ঝরা আমাকে তুমি আর কতোটা
অক্ষত দেখতে চাও শ্মশানপৃথিবীর বুকে?
জিন্দেগি এখন বিলয়ের বন্দেগি...'
.
এবং কবির চূড়ান্ত আক্ষেপ -
.
'তুমি আজ কতো দূরে আমার প্রেম থেকে
তোমার ঘৃণা থেকে কতো দূরে আমি আজ!' ( মেঘের মঞ্জিল, ২৩)
.
বিচিত্র কবির প্রেমোপলব্ধি। একদিকে যেমন হতাশার প্রক্ষেপন, ঠিক বিপরীতেই তার পরিদের আকর্ষণে ঊন থেকে সম্পন্ন হয়ে ওঠার গাঁথা -
.
'এই মানুষজনমে
পরিদের যৌন অভিজ্ঞান আহরণের
আনন্দ - আর্তিতে
ঊন থেকে হই
ক্রমশ সম্পন্ন।' (জীবনবাদাম, ৩৮)
.
৪।
.
কাব্যগ্রন্থে কবিকে কখনো দেখা যায় নেপালের পোখরায়, কখনো বৃষ্টিস্নাত কোলকাতায়, কখনো মধুবাগানের মোড়ে, কখনো পরিবাগ এবং ভুতের গলিতে, কখনো খরাকুসুমপুর পার করে মেঘ অম্লানপুর। বোঝা যায় বাস্তব এবং কাল্পনিক - উভয় জগতের লোকোমোটিভ, বা গতিশীল সংমিশ্রণে তার জীবন। তবে অবাক লাগে, যখন এক শবে বরাতের রাতে কবিকে আমরা আবিষ্কার করি গোরস্তানেও -
.
'শবে বরাতের রাতে
কবরগাহ হেঁটে হেঁটে দেখা
জীবনের দরবারে
সমাধির বিন্যাস কতোটা কেমন!' (পরমের পাখি, ৩৬)
.
জীবনের দরবারে সমাধির এ বিন্যাস ঢুঁড়ে দেখতে গিয়েই কবি আবিষ্কার করেন আত্মিক - আধ্যাত্মিক জীবনের অমোঘবচন -
.
'আমি এক প্রেম - অনাথ
নাথের লীলা বুঝে না - বুঝে
শুধু কারও বেদরদি বুকের দরগায়
আজন্ম অন্ধকার চূর্ণ করে
জ্বালাতে থাকি হৃদয় - মোমের বাতি।
জীবনের পাঁচ ঋতুর
এমন এবাদত - আকুলেও আসেনি
মৃত্যুময় একটি বসন্ত।' (পরমের পাখি, ৩৬)
.
৫।
.
শৈশব থেকে বিচ্যুত মানুষ যে আত্মাহীন শবদেহ প্রায়, এও কবির উপলব্ধি। কবির শয়নে স্বপনে তার শৈশব স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লা - 'ঘুমের ভেতর চলে যাই ফেলে আসা শহরে, / যেহেতু আমার যাবৎ জাগরণ ঘুমোয় সে শহরে'
.
তার মনে প্রশ্ন জাগে - 'সেখানে, বিগত বালকের চলাফেরার চিহ্ন কি কেউ খোঁজে?'
.
কবিতার শেষে আকুল হয়ে এই প্রশ্নও তিনি শুধান, তার শ্রোতাকে -
.
'বরং তুমি ত্বরিৎ / জানাও আমাকে / একজীবনের গাড়িতে / ঢাকা থেকে কুমিল্লা / কত দূরে / কত দূরে ...' (শহর ও সোনালি সংগোপন, ১৪)।
.
পৃথিবীর চোখে বড় হবার, বা বড় হয়ে উঠবার যে খুনে, রক্তাক্ত প্রক্রিয়া সে ব্যাপারে সচেতন কবি বেদনাভারাতুর কণ্ঠে বলেন -
.
'বড় হতে গিয়ে মানুষ যেভাবে / গলা টিপে হত্যা করে / তার ভেতরের সরল শরৎ,
.
এভাবে আমিও / মধুবাগানের মোড়ে / হাঁটতে গিয়ে দেখি / হারিয়ে ফেলেছি /জীবনের জরুরি সব / বিষাক্ত লাবনি'
.
কিন্তু জীবন কবিকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়। সুযোগ দেয় আর একবার শৈশবের সরল শরতে ফিরে যেতে। কিন্তু সে সরলতায় প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়াও রক্তাক্ত -
.
'আবারও শরৎ এল, / এইবার জীবনের / ঋতুহীন যত জটিল অর্জন / খুন করে, লাল রক্তমাখা আমি / অপু ও দুর্গার সাথে ছুটতে থাকব / শরৎশোভা মাঠে;' (রক্তশোভা শরৎ, ৪৫)
.
৬।
.
অপু দুর্গার সূত্রে মনে পড়লো, কবি এই সাহিত্যিক রেফারেন্সিং বাদেও, কাব্যগ্রন্থে বেশ কিছু কবিতা লেখেন, তার পছন্দের মানুষদের স্মরণে, যাদের কেউ কেউ তার জীবনে সরাসরি জরিত ছিলেন। কেউ কেউ ঐতিহাসিক। তার কাব্যগ্রন্থে উঠে আসে প্রয়াত স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন, রিপন চৌধুরী আপন, ফাহিম সব্যসাচী ও কমল অনির্বাণ, এবং নেতাজি সুভাষ বোস। তার কাব্যের প্রেরণা হিসেবে উপস্থিত হন - কুসুমকুমারী দাস, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি, গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ, এবং মির্জা গালিব। তাদের নিয়ে, তাদের দ্বারা প্রাণিত হয়ে, তাদের ওপর লিখতে গিয়েই কবি আবিষ্কার করেন কাব্যের শক্তি।
.
স্থপতি ও কবি রবিউল ইসলাম প্রসঙ্গে কবিতার শেষ পংক্তি -
.
'বছরের প্রথম কুয়াশায় / একমাত্র কবিই / বেছে নিতে পারে / তার কাঙ্খিত কবর।' (হিম হাংরি, ১৩)
.
সুভাষ বসু প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে -
.
'একমাত্র কবির অক্ষরে / নেই কোনো / অন্তিম নিশ্বাস, / ইতি শতবর্ষী সুভাষ।' (ইতি শতবর্ষী সুভাষ, ৩৯)
.
সে তো গেলো কবিতার কথা, কবির ব্যাপারে তার মূল্যায়ন সেই হতাশা মাখাই -
.
'কবিতায় নদী অনন্তে ধায় / বাস্তবের কবি পুড়ে যায় / আড়ালি আগুনের উৎপ্রেক্ষায়।' (বস্তুত, ৫০)
.
৭।
.
কাব্যগ্রন্থটির কারিগরি দিকে কিছুটা মনোনিবেশ করা যাক।
.
টেকনিক্যালিটির দিক থেকে কাব্যগ্রন্থে কবি পিয়াস মজিদের দুর্দম ঝোঁক পরিলক্ষিত হয় অনুপ্রাস নির্মাণে। একদম প্রথম কবিতা, 'বসন্ত, কোকিলের কর্তব্যে - 'প্রেমের পাসওয়ার্ড' , 'বুকের ব্যাকুল বাগান' , 'বিকিকিনির বাজার বিশাল' থেকে নিয়ে শেষ কবিতা 'বেঁচে থাকার বসন্ত বাগানে' এর - ' শীতার্ত শব্দগন্ধে' , কিংবা 'বসন্তবাগান'। কবিতায় প্রতি বাক্যের শেষে এন্ড রাইমিং মেলানোতে এ কবির খুব একটা আগ্রহ পরিলক্ষিত না হলেও, প্রায় প্রতিটি কবিতার পংক্তিসমূহের মধ্যে এক গীতল অন্তঃছন্দ পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে হাজির করে পরবর্তী পংক্তির দ্বারে।
.
টুকরো টুকরো অপরিচিত শব্দগুচ্ছ তৈরি কবি পিয়াস মজিদের এ কাব্যগ্রন্থের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। উদাহরনত - জলের জরায়ু, পিপাসার পুষ্প, আত্মার আতর, প্রানপুকুরপাড়, গোলাপি গিলোটিন, বিলয়ের বন্দেগি, বিনাসের কমলা কুঠার, ক্রুশের কাজল, কুঁড়ে তাজঘর, দিঘল রোদনরাজ রাত, গ্রীস্মাভাত, নিরাশাকরোজ্জল, ইন্দ্রজাল - ব্রেইল, মরমি মঞ্জিল, মরণময়ূর, পরমপেখম, সমাধিবাগিচা, পিস - পাপী প্যাগোডা, প্রাণের প্যালেট, শিল্প - রানিভূত, বাশকের সিম্ফনি, ইত্যাদি।
.
ক্ষেত্রবিশেষে এই শব্দগুচ্ছ তৈরির ঝোঁক কবিকে রিডানডেন্সির দিকে ধাবিত করে বলে আমার মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ - 'ভাষাবাক্যের বাড়িঘর' শব্দগুচ্ছের বিশেষণ, ও যৌগিক শব্দ - 'ভাষাবাক্য' । (সুগারস্ট্রিটে হ্যামলকবৃষ্টি, ৫১)
.
একই সঙ্গে, রেফারেন্সিং এর ক্ষেত্রেও কবি তার এ কাব্যগ্রন্থে সীমিত পরিসরের লেন্স ব্যবহার করেছেন। সোমেন চন্দ, শক্তি, বিভূতিভূষণ, কুসুমকুমারী দাস থেকে নিয়ে মির্জা গালিব, রুমি হয়ে মারকেজ। টি এস এলিয়টের কবিতা পড়তে গেলে যেমন লাইনে লাইনে পুরান - ইতিহাস - ধর্মগ্রন্থ - দর্শনের পাতা উল্টে বোঝা লাগে, কবি তার পাঠককে সে কষ্টের মধ্য দিয়ে নিয়ে যান নি।
.
কবির দুটো কবিতার ব্যাপারে আমার আলাদা দুটো অব্জারভেশন আছে।
'আঁধারশীলা' কবিতায় আলো আর অন্ধকারের কথোপকথন কবি জয় গোস্বামীর ঈশ্বর আর প্রেমিকের সংলাপ কবিতার মতো ডায়লগ আকারে এগোয়।
.
আবার কবির খরা ও তরঙ্গ পড়লে তার প্রেমময় পাঠ যেমন সম্ভব, একইভাবে মেটাফরিক সেন্সে তিস্তা ব্যারেজ নিয়ে বাংলা - ভারতের সম্পর্কের দোটানাও প্রস্ফুটিত হয় -
.
'জল চাই জল / তৃষ্ণার কালে খুলে দেবে তো তোমার নহর?' (খরা ও তরঙ্গ, ২৭)
.
৮।
.
শেষমেশ এ প্রশ্নটি চলেই আসে মনে, কোকিলেরও কর্তব্য বিধান করা লাগবে?
.
কবিতার প্রস্তাবনাসমূহ খেয়াল করলে দেখা যায়, কবি ব্যাথাতুর হৃদয়ে বলছেন - 'বুকের ব্যাকুল বাগান' আজ 'বিকিকিনির বিশাল বাজার'। 'ফাল্গুনফুল', 'প্রেমের পাসওয়ার্ড' ভুলে গিয়ে তার জৌলুশ ও রঙ হারিয়েছে। তবুও কোকিলকে গাইতে হবে বেঁচে থাকার গান।
আক্ষরিকভাবে কবির যে প্রস্তাবনা, তার সঙ্গে আমি মানসিকভাবে সম্মত হতে পারি না।
.
মনুষ্যসৃষ্ট আপদ, তথা সমস্ত পালাপার্বণের কর্পোরেটাইজেশন থেকে নিয়ে বুকের গহীনে প্রোথিত আবেগানুভূতিগুলোকেও বাজার দরের দস্তুরে আবদ্ধ করে ফেলার এ ক্রুঢ় বাস্তবতা - এর প্রেক্ষিতে কোকিলের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া কোন গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনা নয়, আমার মতে। বা, আমাদের , বাজারি মানুষের সে অধিকারও বা কোথায়? অথবা, কোকিল, যে কিনা মূক প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারও যে দায়িত্ব থাকতে পারে, কর্তব্য থাকতে পারে, এ ভাবনাটিও হয়তো মানুষের সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট ধারা, বা শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ করবার যে প্রবণতা - তার বহিঃপ্রকাশ।
.
শুধুমাত্র মেটাফরিক প্রেক্ষিতে আমি এই বক্তব্যে সম্মত হতে রাজি আছি। কবি স্বয়ং যদি কোকিল হন, তবে হ্যাঁ, তার কাঁধে এই দায়িত্ব বর্তায়, মানবতার বাজারহাটে বসে মানুষের আদিম, মুক্ত, বাধনছাড়া, বল্গাহীন প্রবণতাসমূহকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বসন্তগীত রচনার।
.
৯।
.
কবি পিয়াস মজিদের এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সম্মাননা পুরষ্কার ইত্যাদি এক সাইডে সরিয়ে রেখে, বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের সমাদৃত সব কবি ও কবিতার নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে যদি নিজের বক্তব্য রাখি - এই কবিকে আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, এবং তাকে আমাদের পঠনের তালিকায় রাখতে হবে। সমকালীন বাংলাদেশে সক্রিয় ও সমাদৃত কবিদের মধ্যে কবি পিয়াস মজিদ হয়তো তরুণতম, কিন্তু তার পৃথিবী দেখার চোখ, সংবেদনশীল হৃদয়, আত্মার ক্ষুধা, এ সবকিছুর কাব্যিক বহিঃপ্রকাশের সক্ষমতা, সর্বোপরি কবিতার প্রতি তার যে নিষ্ঠার প্রকাশ তিনি গত দু' দশকের কাছাকাছি সময় ধরে প্রদর্শন করেছেন - তা যেকোনো মননশীল কল্পনাপ্রবণ মানুষের চিত্তকে ঘা মেরে জাগিয়ে তোলে।
.
তবে, এ পিয়াস মজিদকে পত্রপত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে একটি - দুটি কবিতা, বা কবিতার গুচ্ছ পাঠ করে আবিষ্কার করা মুশকিল। একবিংশ শতকের বাংলাদেশি বাংলা কবিতার এ মুখপাত্রকে বুঝতে হলে অন্তত তার একটি কবিতার বইয়ের পূর্ণাঙ্গ পাঠ প্রয়োজন। সে হিসেবে তার 'বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য' বইটি হতে পারে কবির মানসজগত পরিভ্রমনের এক দারুন প্রারম্ভিক বিন্দু।
.
কবি পিয়াস মজিদের কবিতা, নিজগুনে এ মনোযোগী পাঠের দাবীদার।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:১৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×