somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শনিবারের চিঠি - পর্ব চার

২০ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যে দিন আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল, সেদিন ইচ্ছা করেই অফিস থেকে অনেক দেরী করে বেরিয়েছিলাম। বাসা থেকে বার বার ফোন দিয়ে হুড়ো দেয়া হচ্ছিল। আমার ইচ্ছে করছিল না, সত্যি বলতে, গায়ে হলুদের প্রোগ্রামটা অ্যাটেন্ড করতে। মা কে সেটা ফোনে বললে, মা বললেন - গাধা, তোকে কেউ দাওয়াত দেয় নাই এই অনুষ্ঠানে। এইটা তোরই অনুষ্ঠান। তুই সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিস। তুই না আসলে হলুদ কি সবাই নিজ নিজ কপালে ঘষবে?
.
চিন্তা করে দেখলাম, মায়ের কথা ঠিক। তাই বলে আজকের দিনও এমন ঝাড়ি? খবরদারির জন্যে একজন যথেষ্ট ছিল না জীবনে, যে আর একজন ট্রান্সপোর্ট করে আনছি? আমি আমার অফিস রুমে চেয়ারে বসে মাথা নাড়ি। অফিসের পিসিতে বেজে চলছে শহীদ আল বোখারি মহাজাতকের লেকচার - আপনি এক অনন্য সৃষ্টি...।
.
একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় ফেরার পর বুঝলাম, যে চিন্তায় এতক্ষণ বাসায় ফিরি নি, তা অক্ষরে অক্ষরে ফলতে যাচ্ছে। সবাই আমার কপালে হলুদ ঘষবার জন্যে একদম প্রস্তুত। বাসা ভর্তি মেহমান।
.
আমার রুমে গিয়ে দেখলাম, পিচ্চিরা কয়েকজন আমার বিয়ের জন্যে দেয়া শেরওয়ানির ডালা ছিঁড়ে শেরওয়ানি পাজামা নাগরা বের করে সুন্দর করে খাটে বিছিয়ে তার চারপাশে গোল করে ঘিরে বসে আছে। একজন খুব চিন্তিত স্বরে বলল, আবির মামা, আমাদের কারো গায়ে এই লম্বা জামাটা লাগে না। আমি সব দেখে শুনে হুট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম না, আমার কি করা উচিৎ। বিয়ের শেরওয়ানি পাগড়ী মানুষ জীবনে একবারই পরে, সাধারনত। আমাকে আমার শেরওয়ানির ডালা উন্মোচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে এই ক্ষুদে বিচ্ছুর দল। রাগবো, হাসবো, নাকি পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবো বুঝতে পারছিলাম না। আম্মু আবারো রুমে এসে আমাকে উদ্ধার করলো, পিচ্চিগুলিকে ঝাড়ি দিয়ে রুম থেকে বিদায় করে। তবে নতুন আরেকটা সমস্যা জানলাম। ক্যাটারিং এ অর্ডার করা তেহারির প্যাকেট নাকি এতো ছোট যে, তার দুটোতেও একজনের কুলোচ্ছে না।
.
শ্বাস ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছি না। বাস্তবে আমি এমনই এক মুখচোরা মানুষ, যে একদল মানুষকে রাস্তার উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসতে দেখলে, তাদের মুখোমুখি হওয়ার বদলে রাস্তা পাল্টে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে বের হয়ে যায়। সেখানে আজ বাসা ভর্তি এতো মানুষ! যদিও সবাই আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। একসঙ্গে সবাইকে বাসায় পেয়ে ভালো লাগারই কথা। কিন্তু সকলের আগমনের হেতু আমার বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে - এটাই আমাকে প্রবল অস্বস্তি দিচ্ছিল। এতোটা অ্যাটেনশন পেয়ে আমি অভ্যস্ত না।
.
যা হোক, বলির পাঁঠার যূপকাষ্ঠে বসার মতো করে আমিও গিয়ে বসলাম রুমের এক কর্নারে, যেখানে গায়ে হলুদের সেট ডিজাইন করা হয়েছিল। সুন্দর একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবী উপহার দেয়া হয়েছিল কনেদের তরফ থেকে। সেটা পড়েছিলাম। মা খালারা বললেন - পাঞ্জাবী সুন্দর, কিন্তু এ পাঞ্জাবী আর দ্বিতীয়বার পড়া যাবে না। আমি তো খুব অবাক! কেন? জানতে চাইলেই বললেন, এটাই নিয়ম।
.
হায়রে নিয়ম!
.
গায়ে হলুদের দুটো ধরন আছে, খুব সম্ভবত। একটা হচ্ছে, বর - কনের হলুদ একসঙ্গে হবে। আরেকটা হচ্ছে, হলুদ আলাদা আলাদা হবে, কিন্তু উভয়পক্ষ একে অপরের হলুদে হলুদের সামগ্রী নিয়ে হাজির হবে। আমি একটা তৃতীয় উপায় আবিষ্কার করেছিলাম। আমি বলে দিয়েছিলাম, ভাই, হিজ হিজ হুজ হুজ। রেস্টুরেন্টে খাবার টেবিলে বসে বন্ধুরা যেটা বলে আর কি। যার যার খাবারের দায়িত্ব তার তার। অর্থাৎ, হলুদে আমরা উপঢৌকন নিয়ে যাচ্ছি না একে অপরের বাড়ি। যে যার মতো করে আয়োজন করে হলুদের অনুষ্ঠান।
.
দেখা গেলো, যার বিয়ে, তার কথা মানুষে থোড়াই কেয়ার করে।
.
কনেপক্ষ থেকে এক বহর এসে হাজির হল হলুদের সামগ্রী আর উপঢৌকন নিয়ে, আমাদের অনুষ্ঠানে। আমার বাসার লোকজনকে আমি বহু কষ্টে রাজি করাতে পেরেছিলাম, মুখে হলুদ না দিতে। কনেপক্ষের গেস্টরা মহানন্দে আমার মুখকে পোস্টার বিবেচনায় হলুদ সাঁটিয়ে গেলেন। জানা হল, গায়ে হলুদের আরেক ধরন আছে। সেটা হচ্ছে সারপ্রাইজ। কনেপক্ষ বরপক্ষকে, বা বরপক্ষ কনেপক্ষকে না জানিয়ে হাজির হয়ে যাবে একে অপরের গায়ে হলুদের প্রোগ্রামে।
.
ঘড়িতে যখন রাত সাড়ে আটটা, তখন সিদ্ধান্ত হল যে - যেহেতু কনেপক্ষ এসেছে আমাদের হলুদে, তাই আমাদের বাসা থেকেও হলুদের ডালা নিয়ে যাওয়া হবে কনেদের অনুষ্ঠানে।
.
আমরা ঘরোয়াভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও, কনেপক্ষ হলুদের আয়োজন করেছিল খিলগাঁওএর একটা কনভেনশন সেন্টারে। কোন প্রস্তুতি ছাড়া, আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো আমার ছোটবোনের বান্ধবীদের একটা দল। তালতলা মার্কেটে গিয়ে তারা নিজেরাই হলুদের ডালি কিনে সাজালো। তারপর, সে কনভেনশন হলের সামনে ওদের নামিয়ে দেয়ার পর আমার দায়িত্ব খালাস। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করা হল বটে, আমি যেতে চাই কিনা ওদের সঙ্গে। আমি রাজি হলাম না। এক সার্কাসে বানর নাচ নেচে আরেক সার্কাসে গিয়ে পড়ার আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। আরেক প্রস্থ হলুদ ঘষাঘষি মুখে! বাপরে!
.
রাত সাড়ে নয়টা পাড় হয়ে ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। আপন কফি হাউজে ঢুকে একটা কফি অর্ডার করলাম। আমার দশা তখন ফ্রেন্ডসের প্রথম এপিসোডের র্যা চেল গ্রিনের। মনে হচ্ছে, নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে এসেছি। মুখে অজান্তে হাত চলে গেলে প্রতিবার একটু করে হলুদ উঠে আসছে আঙ্গুলে।
.
কফি হাতে এসে দাঁড়ালাম রাস্তায়। পুরো দিনের ডামাডোলে এই একটুখানি মুহূর্ত, যা আমি একাকী নিজের মতো কাটাতে পারছি। এবং প্রথমবারের মতোই হয়তো, সারাদিনে, বা একটা দীর্ঘ সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো, আমি আবিষ্কার করি - কতো বড় একটা পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে আমার জীবনে।
.
বিয়ে ব্যাপারটা আমার মননে বরাবর সবচে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ছিল। স্থূলভাবে যৌনতার যে সংশ্লেষ এটার সঙ্গে করা হয়, সেজন্যে নয়। আমি সামাজিক এ রীতিকে বরাবর খুব পোক্তভাবে নিয়েছি, কারন আমার মানসিকতা ওভাবে তৈরি। আমার জীবনে স্থায়ী একজন মানুষ, একটা সম্পর্ক জরুরী। পাখির নীড়ে ফেরার মতো। নইলে আমি ফোকাস করতে পারি না আমার কাজে।
.
কিন্তু এই পাখির নীড়ের সহনির্মাতার খোঁজে আমাকে একটা লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এমন অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যারা দারুন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যাদের সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্ক আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটে গেছে। যাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বেদনা একদিকে খুব কষ্টের, আবার ফিরে দেখার জন্য সে বেদনা আমার খুব পছন্দেরও।
.
আপন কফিশপের সামনে একটা মেয়ে, তার বয়ফ্রেন্ডকে হাগ করে রিকশায় উঠে চলে গেলো। ছেলেটা যতক্ষণ না রিকশাটি পুরো মিলিয়ে গেলো রাস্তার শেষপ্রান্তে, ততক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করলো উল্টো দিকে।
.
আমি চিন্তা করে দেখলাম, এটাও আমার জীবনে আর হবে না কখনো। রাস্তা থেকে প্রেমিকাকে বিদায় জানানো। তারপর যার যার বাড়ি ফিরে যাওয়া।
.
টের পেলাম, আমার ভেতরে ভেতরে এক অস্বস্তি দানা বেঁধে উঠছে।
.
আমি হাঁটা শুরু করলাম যে কনভেনশন সেন্টারে আমার হবু বৌয়ের হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে, তার দিকে। রাস্তার উল্টো দিকে এককাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আমার বোনকে ফোন দেবো কিনা - তারা কখন বের হয়ে আসবে, সেটা নিশ্চিত হতে।
.
এমন সময় দেখলাম, ফটোসেশনের জন্য, কনভেনশন হলের কাঁচের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার হবু বউ। সে প্রচণ্ড উৎফুল্ল। আনন্দিত। সবার সঙ্গে মিলে প্রাণ খুলে হাসছে। একটু পর সে চলে গেলো ভেতরে।
.
আমার মনে হল, এটা ঠিক - প্রেমহীনতা ও বিচ্ছেদের যে যন্ত্রণাগুলি আমি এতদিন ধরে বুকে ধারন করে চলেছি, তারা খুব আপন। তারা আমার একটা অংশের মতনই। কিন্তু কাঁচের দেয়ালের ঐপাশে দাঁড়ানো মেয়েটা আমার সমস্ত যন্ত্রণার উত্তর। শি ইজ দা অ্যান্সার টু অল মাই পেইনস।
.
কখনো কখনো বাক্যের শেষের প্রশ্নবোধক চিহ্নকে জোর করে হলেও ওয়ার্ড লিমিটেশনের খাতিরে দাঁড়িতে রূপান্তর করা লাগে। কাঁচের ওপারে দাঁড়ানো হলুদ শাড়িতে ঝলমল করতে থাকা এ কন্যা আমার জীবনের সমস্ত প্রশ্নবোধক চিহ্নকে বদলে দেয়া ফুলস্টপ। যতিচিহ্ন।
.
নিজের গায়েহলুদের অনুষ্ঠানটা নিতান্ত অনুৎসাহে অত্যন্ত ম্যাড়ম্যাড়েভাবে উৎযাপন করে এসেছি। আমার মন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি উৎসারিত হয়, আয়নার ওপাশে থাকা কন্যার হলুদের অনুষ্ঠানে আজ পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ এসে জমা হোক!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:০০
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরূপের সাথে হলো দেখা

লিখেছেন রোকসানা লেইস, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৫



আট এপ্রিলের পর দশ মে আরো একটা প্রাকৃতিক আইকন বিষয় ঘটে গেলো আমার জীবনে এবছর। এমন দারুণ একটা বিষয়ের সাক্ষী হয়ে যাবো ঘরে বসে থেকে ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু স্বপ্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×