somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শনিবারের চিঠি - পর্ব পাঁচ

২৭ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৭:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
বছরে নভেম্বর মাসটা আমার প্রচণ্ড দৌড়ের ওপর কাটে। যদি পরবর্তী বছর কোন বই প্রকাশ হবার থাকে, তো নভেম্বর মাস হচ্ছে তার গোছগাছের বছর। বই লেখা শেষ করে তার প্রুফ নিশ্চিত করা, ফাইনাল ড্রাফট প্রকাশনা সংস্থার কাছে জমা দেয়া, বইয়ের কাভার আঁকানো। ইউনিভার্সিটিতে তখন পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। তার প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা নেয়া, খাতা দেখা - ইত্যাদি কাজের চাপ বাড়ে। আমার যদি একদিকে পরীক্ষা নেয়ার চাপ থাকে, তাহলে পরীক্ষা দেয়ার চাপ থাকে আমার স্ত্রীর, আমার বোনের। পরীক্ষার পড়ার চাপে ওদের থাকে মেজাজ খিটখিটে হয়ে। উঠতে বসতে ঝাড়ি খাই। এই রুম থেকে ঐ রুমে যেতেও ঝাড়ি খাই। শান্তির মা তখন পরিযায়ী পাখির মতো হিমালয় পানে উড়ে চলে যায় বলে মনে হয়। মন চায় তার পিছু পিছু উড়াল দিতে।
.
যাই হোক, নভেম্বর মাসের চূড়ান্ত চাপ হচ্ছে, কর্মজীবী মানুষদের জন্য, ট্যাক্সের চাপ। বিশেষ করে যদি আপনি ট্যাক্সের জন্য কোন আইনজীবী নিয়োগ না করে থাকেন। যদি আপনার নিজের স্যালারির হিসেব করা লাগে। আমাদের স্যালারি শিট দেয়, সহজেই হিসাব করা যায়। কাজেই গত পাঁচ বছর যাবত ট্যাক্স দিচ্ছি নিজে নিজেই। যা হোক, ট্যাক্সের হিসাবটা শেষ করে কর প্রদানের টাকার চূড়ান্ত অঙ্কটা দেখলে পরের দু' এক রাত মনের কষ্টে ঘুম হয় না। সারাদিন মাথায় ঘুরতে থাকে। মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তখন রাস্তাঘাটে, আসেপাশে তাকাই। নিজেকে প্রবোধ দেই, এই যে খাবলে খাবলে পীচ উঠে থাকা রাস্তা - এ হয়তো আমার ট্যাক্সের পয়সায় বানানো। সরকারি অফিসে যে সম্মানিত স্যারেরা আমাদের হয়ে দেশ পরিচালনা করছেন, তাদের মাসের বেতনও এই ট্যাক্সের তাকায় হয়। সেতু ব্রিজ কাল্ভারট, চার লেনের ঢাকা - চট্টগ্রাম মহাসড়ক, এবং আরও যত সড়ক এগুলোও আমার ট্যাক্সের পয়সায় হয়। খুব জোর করে কিছুদিন নিজেকে দেশের সুনাগরিকদের একজন ভাবার চেষ্টা করি।
.
ট্যাক্সের গল্প তো খালি ট্যাক্স হিসাব করার মধ্যেই শেষ হয় না। ট্যাক্স কোন সরকারি ব্যাংকে গিয়ে দেয়া লাগে। তারপর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়া লাগে নির্দিষ্ট কর অঞ্চলে গিয়ে। ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়া আজকাল বেশ সহজ। ২০১৮ সালে কেবল একবার ঝামেলায় পড়েছিলাম। রিটার্নে সই নিয়ে ফর্ম ফেরত নেয়ার জন্যে প্রকারান্তরে টাকা দাবী করছিল কর্মকর্তা। সে বছর আয়কর মেলা হয় নি বলে। এছাড়া প্রতি বছরই মোটামুটি সাচ্ছন্দের সঙ্গে দিতে পেরেছি ট্যাক্স। এ বছর, আর গত বছর তো ইভেন কোন লাইন ও ছিল না।
.
যা হোক, আমার এই শনিবারের গল্প ট্যাক্স অফিসের কচকচানো নিয়ে নয়। গল্পটা এক সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাকে নিয়ে।
.
ট্যাক্সের টাকা দিতে গেছি এক সরকারি ব্যাংকে। প্রতিবছর মতিঝিলে এই ব্যাংকটাতেই আসি ট্যাক্সের চালান জমা দিতে। একদম প্রথম বছর যে ভদ্রমহিলার কাছে ট্যাক্সের চালান দিলাম, তিনি বেশ হাসিখুশি ছিলেন। আমার তৎকালীন কর্মস্থল, ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের সঙ্গে তার কি একটা যেন সংশ্লিষ্টতাও ছিল। বেশ কথাবার্তা বলতে বলতে, আলাপচারিতার মাধ্যমে ট্যাক্স দিয়ে এসেছিলাম। পরের তিন বছর ক্যাশে যে কর্মকর্তা বসেছিলেন, তিনি এক বয়স্ক ভদ্রলোক। হাসিমুখেরও না, আবার মুখ গোমড়াও না। যা কাজ, করে দিয়েছিলেন তারাতারি।
.
আজ যার সামনে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম, এই ভদ্রলোকের বয়স আমার সমান, অথবা আমার চে বছর দুয়েক কম। খুবই চেতা। দুনিয়াদারী নিয়ে বিরক্ত। ক্যাশিয়ারই বটে। কিন্তু সবাইকে ধমকে ধামকে বাস্তবতা বোঝাচ্ছেন। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে। চালান আর চালানের টাকা বাড়িয়ে দিলাম তার সামনে।
.
- এই যে ট্যাক্স দিতে আসছেন, বোঝা তো যায় যে ম্যাচিউর লোক আপনি। তা হাতের লেখা এমন কেন? বুঝায়ে বলেন তো কি লিখসেন এইখানে?
.
আমার টাকার অঙ্কের ওপর কলম ঘোরায়ে বলা মাত্র আমি প্রায় আঁতকে উঠি। আমার হাতের লেখা নিয়ে আমার তেমন বিশেষ কোন গর্ব নাই। তবে এর আগে এরকম পাবলিক ডোমেইনে হাতের লেখা নিয়ে ঝাড়ি খাই নাই বহু দিন। ধরে নিয়েছিলাম, সে বয়স পার করে এসেছি। যাই হোক।

চালানের নতুন একটা ফর্ম আমাকে দেয়া হলে আমি বসে বসে যতটুকু সম্ভব যত্ন করে লেখা শুরু করলাম আবার। ভাবলাম, হাতের লেখার জন্যে ঝাড়ি দেয়া কোন স্টুডেন্টের অভিশাপেই হয়তো আজ আমার এই দশা। হাতের লেখা বোঝা গেলে আর কাউকে কখনো হাতের লেখা নিয়ে ঝাড়ি দেবো না এই প্রতিজ্ঞা করে আপাতত ভালো ফিল করার চেষ্টা করলাম। এই ফাঁকে আড়চোখে দেখতে থাকলাম ক্যাশে বসা ঐ লোকটিকে।
.
এক পিয়নকে ঝাড়ি দিলেন তিনি কি এক কাজ পছন্দ না হওয়ায়। তার এক কলিগ কিছু একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলে তার সঙ্গেও মোটামুটি দুর্ব্যবহার করলেন। লাইনে, আমার মতো বলির পাঁঠা যে ক'জন ছিলেন, তাদের কথা বাদই দিলাম। অন্তত আরও দু'জনকে নতুন করে চালান ফর্ম ফিলাপ করালেন তিনি। সরকারি ব্যাংক। সেবা দিতে না চাইলেও কিছু করার নেই। এমনিতেও নাকি লসে চলছে, হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপিদের পকেটে। উদ্ধার করা হয় নি এখনও। তবুও সবার চাকুরী বহাল তবিয়তে আছে। এর মধ্যে আমার পুরনো ক্যাশিয়ার ভদ্রলোক এসে হাজির হলে আস্তে করে আমি তার লাইনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি।
ওখানে দাঁড়িয়েও খেয়াল করলাম, অল্প বয়স্ক সে ক্যাশিয়ার এখনও গজগজ করেই যাচ্ছে।
.
আমার একপর্যায়ে মনে হল, ভদ্রলোক সুখী না তার এ প্রফেশনে। চাকুরির বয়স কম বলে এখনও নিজে পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারেন নি এই কাজে। মেনে নিতে পারেন নি নিজের এ ভবিতব্য। সেবা দানকারী প্রফেশনে আছেন বলে আমরা, গ্রাহকরাও তার সেই রাগের ভুক্তভোগি হচ্ছি।
.
ব্যাংক থেকে যখন বেরিয়ে আসছি, তার ওপর আমার রাগ পড়ে এসেছে প্রায়। বরং তার পারস্পেক্টিভ থেকে চিন্তা করে মায়াই লাগছিল তার জন্য।
.
পৃথিবীতে বহু মানুষ চারিত্রিকভাবে বদমেজাজি, বা খারাপ নন। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারনে তারা বদলে যান। দোয়া করা উচিৎ, নিজের জীবন যাতে এমন না হয়। চেষ্টা করা উচিৎ, নিজের অপছন্দের পেশায় যাতে কখনো স্যাটল না করা লাগে। নইলে শুধু নিজের জীবনে অসুখি একজন মানুষে পরিনত হব আমরা, তাই নয়, আসেপাশের মানুষকেও নিজের অজান্তে কষ্ট দিয়ে বেড়াবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৭:৩৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×