somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাঠমোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে আমার জীবনে চর্চিত ইসলামের তফাৎ যেখানেঃ প্রসঙ্গ, ইসলামে নারী

২৫ শে জানুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১।
যে যেখানে বসে এই লেখাটি পড়ছেন, খানিক সময়ের জন্যে ভাবুন যে আপনি সোফা বা চেয়ারে নন, বসে আছেন চট বা সাধারণ কাপড়ের ওপর। ভাবুন, আপনার চারপাশে - আপনার মাথার ওপর কোন আধুনিক স্থাপত্যকলার অনুসরনে নির্মিত পাথুরে দেয়াল আর সিলিং নেই, আছে তাবু, অথবা মাটির প্রলেপ বিশিষ্ট ঘর। সেই কামরায় অত্যাধিক গরমের মোকাবিলায় এসি, বা অত্যাধিক ঠাণ্ডা কমানোর জন্যে রুম হিটার নেই। যোগাযোগের জন্যে মোবাইল - কম্পিউটার নেই। পড়বার জন্যে বই নেই। দেখবার জন্য টিভি নেই। খাবার প্রিজারভ করার জন্যে রেফ্রিজারেটর নেই, চট করে খাবার গরম করার জন্যে ওভেন নেই। দূর যাত্রার জন্যে বাস - ট্রেন - প্লেন কিছুই নেই। ঘরের লাগোয়া টয়লেট নেই, নিরবচ্ছিন্ন পানির প্রবাহ নেই, মন চাইলেই চট করে হট শাওয়ার নেয়ার ব্যবস্থা নেই।

এমন একটা সময়ের কথা চিন্তা করুন যখন আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্যে রাস্তায় পুলিশ নেই, আইন প্রণয়নের কোন সুনির্দিষ্ট সংবিধান নেই, দেশ রক্ষার জন্যে কোন মিলিটারি নেই, এমনকি দেশের / নেশন ষ্টেটের কনসেপ্টও তখনও আবিষ্কার হয় নি। মোটামুটি গোত্রভিত্তিক জীবনব্যবস্থা, এবং জোর যার মুল্লুক তাঁর - এই হচ্ছে সমাজের বাস্তবতা।

মনে করুন ২০২২ এ নয়, আপনি বাস করছেন আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে। ১৯০০ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে কন্যা দায়গ্রস্থ পিতাদের উদ্ধার করতে বর্ণব্রাহ্মণরা বিয়ের সেঞ্চুরি করতো (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উল্লেখে তাঁর বই 'একা এবং কয়েকজন' এ), একবার বিয়ে করে, পণের টাকা নিয়ে , বাসর রাত পার করে সেই যে বামুন ঠাকুর উধাও হতেন - কনে তাঁর জীবদ্দশায় আর দ্বিতীয়বার তাঁর স্বামীর দেখা পেতেন কিনা সন্দেহ। ৭ -৮ বছরে বিধবা নারীদের কাশীতে পাঠিয়ে দেয়া হত এই সেদিনও (দেখুন মিরা নায়ারের ওয়াটার, ২০০৫)। নারীরা পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ভোটের অধিকার পেলেন ১৯২০ সালের দিকে। হিস্টরি (হিজ - স্টোরি) বাদ দিয়ে "হারস্টোরি" রচনা করার জন্যে নারীদের অধিকার সংক্রান্ত ফেমিনিস্ট আন্দোলনগুলো শুরু হল ১৯৭০ এর দশকে, বৃহৎ পরিসরে। আমি নিশ্চিত নই, এখনও ভারতীয় উপমহাদেশে সকল নারী পিতার প্রপার্টি রাইট পান কিনা।

এ সব তথ্য মাথায় রেখে যদি চিন্তা করেন, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণে এটা আমাদের মস্তিষ্কে ধরা পড়বার কথা যে - ৬১০ খৃষ্টাব্দে রাসুল (সঃ) এর নবুয়ত পাওয়ার পর নারীদের অবস্থার যে অগ্রমুখী পরিবর্তন হয়, তা অ্যারিথমেটিক্যাল প্রগ্রেশন (১,২,৩,৪,৫ ... এভাবে) নয়, বরং জিওম্যাট্রিক প্রগ্রেশন (১, ২, ৪, ১৬, ২৫৬ ... এভাবে)।

যে সমাজে যখন তখন নারীদের তুলে বাসায় এনে রেইপ করা হত, কন্যা সন্তান জন্মালে তাকে অশুভ লক্ষণ বিবেচনায় জীবন্ত কন্যা সন্তানকেই দাফন করে দেয়া হতো - রাসুল (সঃ) এর নেতৃত্বে সেই বর্বরতম সমাজে পরিবর্তন এলো নারীদের নিয়ে মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়ায়, তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠায়, তাদের প্রপার্টি রাইটসে।

রাসুল (সঃ) তাঁর পবিত্র হাতের পাশাপাশি দুটো আঙ্গুল তুলে ঘোষণা দিলেন যে ব্যক্তি তাঁর কন্যাকে সুষম উপায়ে বড় করে তুলবেন, সে ব্যক্তি এবং রাসুল (সঃ) জেন্নাতে এমনভাবেই পাশাপাশি থাকবেন, যেমনটা পাশাপাশি হাতের দুই আঙ্গুল।

ধরুন আপনি মুসলিম নন। রাসুল (সঃ) কে কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আপনি বিবেচনা করেন না। চিন্তা করে দেখুন, একটা প্রবলরকমের পুরুষতান্ত্রিক, একে অপরের রক্তপিপাসু গোত্রভিত্তিক সমাজে, রাসুল (সঃ) যদি কেবল সাম্রাজ্য বিস্তার আর রাজা হবার বাসনা করতেন, উনি সেই পুরুষতন্ত্রের চাকাকেই আরও মসৃণ করে তুললেন। অথচ ঘটনা কি ঘটলো? রাসুল (সঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাঁর মুখে শোনা গেলো নারীদের পিতা - স্বামীর সম্পত্তিতে লিগ্যাল রাইটসের কথা। একটা নির্দিষ্ট চ্যাপ্টার কোরআনের মাধ্যমে বিশ্বাসীরা প্রাপ্ত হল - যা কেবল মাত্র নারী - পুরুষের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে। যদি আপনি শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাসী হন, যদি আপনি তাওহীদে বিশ্বাসী হন - আপনি নারীর এ সমস্ত অধিকার, যা ইসলাম এবং রাসুল (সঃ) নিশ্চিত করেছেন, তা এড়িয়ে যেতে পারবেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কোন ধর্মগ্রন্থের একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় কি আলাদা করে নারী - পুরুষ সম্পর্ক এবং নারীদের অধিকার নিয়ে আলাপ করেছে? এতোটা সূক্ষ্মভাবে? এতোটা জোর দিয়ে? আমার জানা নেই।

রাসুল (সঃ) এর আমলে নারীরা যুদ্ধে সঙ্গী হতেন, সফরে সঙ্গী হতেন, কূটনীতিক বিষয়ে রাসুল (সঃ)কে উম্মুল মুমিনিনগণ পরামর্শ পর্যন্ত দিয়েছেন। তারা মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেন। রাসুল (সঃ) এর ওফাতের পর উম্মুল মুমিনিনগণ রাসুল (সঃ) এর হাদিসের দরস দিয়েছেন।

ইসলামের একদম প্রাথমিক সময়ে এই ছিল নারীদের অবস্থা। ২০২১ সালের সঙ্গে তুলনা না করে ৬০০ খৃষ্টাব্দের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করুন বিষয়টি। তাহলে আপনার মনে হতে বাধ্য যে - রাসুল (সঃ) হাত ধরে নারীর যে অগ্রগতি হয়েছিল, তা পূর্বের হাজার বছরের তুলনায় প্রায় কোয়ান্টাম লিপ। রাসুল (সঃ) এর সময় থেকে আমরা যত দূরে সরে এসেছি, সামাজিক স্ফেয়ারে নারীদের পদচারনা এবং অবস্থান যেন দিনকে দিন আরও দুর্বল এবং ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছে। কিন্তু কেন?

২।
প্রশ্ন আসে, আমাদের ব্লগাররা, যারা দরসে নিজামি পাশ করে এখন ইসলামের খেদমতের নামে পোস্ট দিচ্ছেন - তারা এ কোন ইসলামের রুপ দেখাচ্ছেন আমাদের, যাতে নারীদের "বেড়ালের মতো আদুরে" আর "কুকুরের মতো প্রভুভক্ত" বলা হয়? এ কি খোদায়ী বিধান? রাসুল (সঃ) এর কালাম? নাকি তাদের নফসানিয়ত, এবং মনগড়া কেচ্ছাকাহিনী?

আমি নিয়মিত কোরআন তাফসির সহ পাঠ করি আলহামদুলিল্লাহ। কোরআনের একটা মুজেজা আমার জীবনী আমি নিয়ত প্রত্যক্ষ করি। আমি যেকোনো সময় যদি কোন ইস্যুতে পেরেশান থাকি, সেদিন কোরআনের তাফসির আমাকে সে সম্পর্কে দরকারি দিক নির্দেশনা প্রদান করে। কোরআন তো এমনই। হুদাল্লিল মুত্তাকিন। যারা মুত্তাকী (নিজেকে দাবী করছি না), যারা সাবমিশনের মাধ্যমে পথের দিশা খোঁজে - কোরআন তাদের পথ দেখায়।

সূরা আহযাবের তাফসির পড়ছিলাম গতদিন, মুফতি শফি সাহেব রাহিমাহুল্লাহের তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনের ১৫০০ পৃষ্ঠার অ্যাব্রিজ ভার্শনে, মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের বঙ্গানুবাদে। মদিনা মুনাওয়ারায় নাযিল হওয়া এ সূরার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জড়িত আহযাব, তথা খন্দকের যুদ্ধে রাসুল (সঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিমরা জয়ী হওয়ার পর আমাদের উম্মুল মুমিনিন, বা সম্মানিত নবীপত্নীগণ সম্মিলিতভাবে তাদের খোরপোশ ভাতার বৃদ্ধি দাবী করেন। রোম ও পারস্যের সম্রাজ্ঞীদের উদাহরন দেখিয়ে তারা বলেন, নবীপত্নী এবং উম্মুল মুমিনিন হিসেবে তাদের আরও স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসের সঙ্গে জীবন কাটানোর অধিকার আছে। রাসুল (সঃ) এর প্রতি এই প্রস্তাবের জবাবেই সূরা আহযাব নাযিল হয়। এখানে উম্মুল মুমিনিনদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিৎ তা নিয়ে বিস্তারিত দিক নির্দেশনা নাযিল হয়। প্রাথমিকভাবে এ সুরার মাধ্যমে উম্মুল মুমিনিনদের দুটো অপশন দেয়া হয়। এক, পার্থিব জগতে সাদাসিধে জীবন, এখন যেমন আছে, সেটাই বরন করে নেয়া এবং আখিরাতে এর বিনিময় লাভ করা। অথবা, দুই, তারা সম্মানজনক উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। দ্বিতীয় অপশন বেছে নেয়ার আগে রাসুল (সঃ) উম্মুল মুমিনিনদের জন্যে বিশেষভাবে পরামর্শ দেন, তাদের পিতামাতার সঙ্গে আলাপ করে নিতে। পরবর্তীতে কোন উম্মুল মুমিনিন রাজি হন নি রাসুল (সঃ) এর স্ত্রীর মর্যাদা ত্যাগ করতে।

এই সূত্রেই, উম্মুল মুমিনিনদের কৃতকর্তব্য অনুসারে আরও কিছু আয়াত নাযিল হয়। আমি তাফসিরের পাতা থেকে হুবহু টুকে দিচ্ছি -

"হে নবীপত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। এটা আল্লাহর জন্য সহজ। তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসুলের অনুগত হবে এবং সৎকর্ম করবে, আমি তাকে দু'বার পুরষ্কার দেবো এবং আমি তার জন্য সম্মানজনক রিজিক প্রস্তুত রেখেছি। হে নবীপত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে কথা বোলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে - মূর্খতার যুগের অনুরূপ নিজেদের প্রদর্শন করবে না। নামাজ কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত - পবিত্র রাখতে।" সূরা আহযাব, মাদানি, আয়াত ৩০ - ৩৩। তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন

উল্লেখ করা জরুরী যে এই আয়াতসমূহের তাফসিরে মুফতি শফি সাহেব (রহঃ) তাঁর বিচারবুদ্ধি থেকে সংযোজন করেন যে, রাসুল (সঃ) এর গৃহের চর্চার অনুবর্তী হয়ে সাধারণ মুসলিম নারীদেরও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের ভেতরে থাকাই আল্লাহ পছন্দ করেন। আর কমবেশী এই আয়াতগুলো দেখিয়েই আমাদের ওয়ায়েজ হুজুররা আরও একধাপ আগে বেড়ে বিধান জারি করেন যে - নারীদের অবস্থান ঘরের ভেতরেই। বাহিরে আসার অনুমতি তাদের কোরআন দেয় নাই।

খেয়াল করে দেখুন, এই পার্টিকুলার আয়াতসমূহ নাযিলের প্রেক্ষাপট খুব স্পেসিফিকভাবে উম্মুল মুমিনিন - নবী পত্নীগণের সঙ্গে জড়িত। রাসুল (সঃ) এর সম্মানিত স্ত্রীগনের চারিত্রিক পূত পবিত্রতার প্রতি যেন কেউ আঙ্গুল তুলতে না পারে, ফেতনা এবং কেওস সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্যে স্পেসিফিকভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়ার জন্যে। বলা হয়েছে তারা যেন নারীদের স্বাভাবিক কোমল স্বরে অচেনা পুরুষদের সঙ্গে আলাপচারিতায় লিপ্ত না হয়। বরং রাসুল (সঃ) এর হামসফর, হামনাওয়া হওয়ার জন্যে তাদের দুই পৃথিবীতে যে অপরিসীম অতুলনীয় মর্যাদা দেয়া হয়েছে - তাঁর মর্যাদা রক্ষা করে উপযুক্ত গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপচারিতায় লিপ্ত হতে। এবং এই আয়াতগুলোর মধ্যে আরও নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে - উম্মুল মুমিনিনগণ মোটেই সাধারন নারীদের মতো নন। তাদের বিধানও সাধারণ নারীদের তুলনায় ভিন্ন। তাদের যেকোনো সৎকর্ম, বা অসৎকর্ম দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে তাদের জন্য। এই আয়াতগুলির শুরু এবং শেষও স্পেসিফিকভাবে উম্মুল মুমিনিনদের অ্যাড্রেস করবার মাধ্যমে।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই আয়াতের উল্লেখ করে যখন বর্তমান সমাজে সাধারণভাবে নারীদের গৃহাভ্যন্তরে থাকতে বলা হয়, শিশুকন্যার বাবাদের মসজিদ মিম্বর থেকে বলা হয় যে - আপনার, আপনাদের মেয়েদের প্রাথমিক স্কুল পাশ করার পর পড়াশোনা বন্ধ করে দেন - তখন মাওলানারা এই সূরার নাযিল হওয়ার কনটেক্সটটা কি স্রোতাদের সামনে স্পষ্ট করে দেন? কেন তারা এই আয়াতসমূহের শানে নুযূল এড়িয়ে যান?

এই সূরা নাযিল হওয়ার পরেও রাসুল (সঃ) এর জীবদ্দশায় নারীরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েছেন, প্রয়োজনে ব্যবসা করেছেন, জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে শ্রম দিয়েছেন, জঙ্গে জামালে উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাজি: ) সরাসরি যুদ্ধের ময়দানেও উপস্থিত ছিলেন। বলা হয় জমানা নাকি খারাপ এসেছে এখন, তাই নারীদের মসজিদে যাওয়া অনুচিত। অনুচিত তাদের পড়াশোনা, জীবন জীবিকা নির্বাহ করার প্রয়াস। কি দুর্ভাগ্যজনক আলাপ!

৩।
অবশ্য এ কাউন্টার আর্গুমেন্ট প্রাসঙ্গিকভাবে আসতে পারে যে , যা রাসুল (সঃ) নিজের এবং নিজের পরিবারের পছন্দ করেছেন, বা নিজ জীবনে প্র্যাকটিস করেছেন, তা সবই আমাদের জন্যেও সুন্নত। কাজেই উম্মুল মুমিনিনদের অনুসরন করে আমাদের ঘরের নারীরাও ঘরেই থাকুক।

ইংরেজি ষষ্ঠ শতকে রাসুল (সঃ) সেলাই ছাড়া চাদর ভাঁজ করে গায় দিতেন। তখন সেলাই করার টেকনিক সহজলভ্য ছিল না। যারা রাসুল সঃ এর সুন্নত বিবেচনায় নিজের পরিবারের নারীদেরও ঘরের ভেতরেই আটকে রাখতে চান, তারা সেলাই ছাড়া দুই চাদর পরে বাজারে অফিসে যান? রাসুল (সঃ) এর অনুকরণে তাবুতে বা মাটির ঘরে বাস করেন? বাথরুমে গিয়ে পানি ছাড়া কেবল ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করেন? দাত ব্রাশ না করে কেবল মেসওয়াক করেন?

খেয়াল করলে দেখা যাবে বরং অনেক মাওলানা সাহেবেরই আজকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। ব্যাংকে ডিপিএস জমা দেয়ার লাইনে দাঁড়িয়েও মাঝে মাঝে দেখা পাই দাড়ি - কোর্তাওয়ালা মাওলানা সাহেবদের।

সবকিছু ছেড়েছুড়ে কেবল বাকি রয়ে গেলো নারীদের পড়াশোনা ছাড়া ঘরে আটকে রাখার সুন্নতটুকুই, যাতে নারীদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের কেবল সন্তান উৎপাদনের মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা যায়?

৪।
কেন এই লেখা? আমি পুরুষ, আমি মুসলমান। আমি বাংলাদেশে বসবাস করি। এ দেশে প্রচলিত কাঠমোল্লাতন্ত্র যেভাবে নারীদের একপেশে করে রাখতে চাইছে, আমার তো তাতে লাভই। তাহলে আমি কেন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি? কেন কাঠমোল্লা সমাজ যেভাবে কোরআন হাদিসের অর্থকে ম্যানিপুলেট করে নারীদের জীবনযাত্রার অগ্রগতি থামিয়ে দিতে চায়, তাতে আমার বিরুদ্ধাচরণ?

প্রথমত, ইসলাম আমাকে নানাভাবে মানুষ, এবং নফসের গোলামী থেকে মুক্তি দিয়েছে। ইসলামের গায়ে আমাদের মতো প্রাকটিশিওনারদের জন্যে, কাঠমোল্লাতন্ত্রের জন্যে যে বর্বরতার দাগ লাগে, তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হওয়া বিবেচনা করি। আল্লাহতা'লা সৃষ্টিগতভাবে নারীপুরুষের মাঝে ভিন্নতা রাখলেও তা একে অপরের উপর সম্মান বা প্রভুত্ব এনে দেয় বলে আমি মনে করি না। কিছু প্রেক্ষিতে (যেমন গায়ের জোর, সাধারণভাবে) যদি নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব থাকেও, আমি মনে করি না এ নিয়ে মুসলিম পুরুষদের জিগির তোলার কিছু আছে। এটা গর্ব করার মতো কোন মাপকাঠী না।

দ্বিতীয়ত, কাঠমোল্লাদের নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের কারনে আমাদের সমাজের শিক্ষিত নারীদের মধ্যে প্রবলভাবে ধর্মবিদ্বেষ দেখা দিচ্ছে। মানুষ, আত্মিকভাবে নীড় খুঁজে ফেরা এক প্রাণী। এক আল্লাহর প্রতি কমপ্লিট সাবমিশন মানুষের রূহকে নীড়ের সন্ধান দেয়। কিন্তু সিজনাল ব্যাবসায়ি ওয়ায়েজদের স্যাক্সিস্ট বক্তব্যের কারনে সেই নীড়ের প্রতি বিতৃষ্ণা যাগে আমাদের শিক্ষিত নারীসমাজের। এটাও এক কারন, এই লেখা লিখবার।

তৃতীয়ত, নারীদের পুরুষদের অধীনস্থ হয়েই থাকতে হবে- ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যে বা যারাই এই দাবী করে, এই দাবীর ইনহ্যারেন্ট অন্তঃসারশূন্যতাও আমাকে বাধ্য করেছে লেখাটি লিখতে। একটা সময় ছিল, যখন নারী নেতৃত্বের সহজাত বিকাশ সম্ভব ছিল না। সারা পৃথিবীজুড়েই পরিবেশটা ছিল পুরুষতান্ত্রিক। কিন্তু আজ যখন পেশীশক্তির বদলে মেধা মননের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করা হচ্ছে, ছেলে শিশু আর মেয়ে শিশুকে সমান গুরুত্ব এবং সুযোগ সুবিধা দিয়ে বড় করা হচ্ছে - অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মেধা মননে মেয়ে শিশুটি ছেলে শিশুটিকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় গায়ের জোরে এটা দাবী করা যে - যতই নারী - পুরুষ সমদক্ষতাসম্পন্ন হোক, তবুও ইসলামের মতে পুরুষকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে, পুরুষকেই নেতৃত্বে থাকতে হবে - এটা যে কোন র‍্যাশনাল মানুষের কাছে অযৌক্তিক , এবং ইসলামের নামে হঠকারিতার চর্চা বলে প্রতিভাত হবে।

৫।
অবশ্যই শ্লীলতা শালীনতা যেকোনো মানুষের একটা গভীর অর্থবহ জীবনযাপনের হাতিয়ার। কিন্তু বুঝতে হবে, পর্দার বিধান কেবল নারীদের জন্য নয়। পুরুষদের জন্য একইরকম উপায়ে চক্ষু, শরীরের খেয়ানত করা হারাম, যেমন নারীদের জন্যে তা হারাম। কাজেই সমাজে অশালীনতার প্রচার প্রসার রোধে কেবল নারীদের গৃহে বন্দী করার ফন্দি করলে চলবে না, পুরুষের নিজের প্রতি যে বিধিবিধান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (সঃ) দিক থেকে এসেছে, সেগুলো আগে অ্যাপ্লাই করা উচিৎ।

ইসলামের নামে নারীদের প্রতি স্যাক্সিস্ট , এসেনশিয়ালিস্ট, নোংরামো বন্ধ হোক। আমার বোনেরা স্বহস্তে কোরআন, কোরআনের তাফসির, হাদিসের গ্রন্থাবলী তুলে নিক। স্বয়ং খোদার কাছে, খোদার রাসুলের সুন্নাহের মাঝে নিজের মুক্তির দিশা খুঁজুক। যে বোনটি নানারকম কুঅভ্যাসে, বাজে চর্চায়, বাজে সার্কেলে পড়ে নিজেকে সর্বনাশের চরম সীমায় ঠেলে দিয়েছে, তারও অধিকার আছে ফিরে আসার এক আত্মিক, আধ্যাত্মিক শান্তিময় জীবনের দিকে। কোন মোল্লাতন্ত্রের অধিকার নেই তাকে খোদার দিকে রুজু হওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখবার, যেমন অধিকার নেই কোন ইসলামবিদ্বেষী সত্ত্বা বা সংগঠনের।

ছবিঃ বিমূর্তচিত্রে রাসুল (সঃ) দুহিতা মা ফাতেমা জাহরা (আঃ সাঃ )

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪৬
১৫টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খালেদা জিয়ার মৃত্যু রাজনীতির মাঠে বিরাট শূন্যতা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৯

 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি দলটির হাল ধরেন। সেনানিবাসে গড়ে উঠা দলটাকে রাজপথে বেড়ে উঠতে গৃহবধূ থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"তোমরা জানাযা করে দ্রুত লাশ দাফন কর।"

লিখেছেন এমএলজি, ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:৩০

রাসূল (সাঃ) বলেছেন, "তোমরা জানাযা করে দ্রুত লাশ দাফন কর।" বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ কাজটি করা হয়নি বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে।

বিষয়টি সত্য কিনা তা তদন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যক্তি বেগম খালেদা জিয়া কেমন ছিলেন?

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:০৪

ব্যক্তি বেগম খালেদা জিয়া কেমন ছিলেন?

ইয়াতিমদের সাথে ইফতার অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া, ছবি https://www.risingbd.com/ থেকে সংগৃহিত।

তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রীও তিনি। তাকেই তার বৈধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বছরশেষের ভাবনা

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৮


এসএসসি পাস করে তখন একাদশ শ্রেণিতে উঠেছি। সেই সময়ে, এখন গাজায় যেমন ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে, তখন বসনিয়া নামে ইউরোপের ছোট একটা দেশে এরকম এক গণহত্যা চলছিল। গাজার গণহত্যার সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

উৎসর্গ : জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP)

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৩৮



খিচুড়ি

হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে—“বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা—
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×